২ চা বাগানে ৪ বছর ধরে বকেয়া মজুরি পাচ্ছেন না ৩৬০ শ্রমিক

চা শ্রমিক
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে ইমাম ও বাওয়ানী চা বাগানের শ্রমিকদের কর্মবিরতি। ছবি: স্টার ফাইল ফটো

বার বার আশ্বাস দিয়েও বকেয়া টাকা পরিশোধ না করায় আশ্বাসে আর আস্থা রাখতে পারছেন চা শ্রমিকরা। গত ১ মাস ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার ইমাম ও বাওয়ানী বাগানের চা শ্রমিকরা।

চলমান তলব, রেশন, বকেয়া মজুরি, বোনাস, উৎসব ভাতা, ভবিষ্যৎ তহবিলের বকেয়া টাকা, চিকিৎসা, স্থায়ী বাসস্থান নিশ্চিত করার দাবিতে দফায় দফায় নানা কর্মসূচি পালন করে আসলেও কার্যত এর কোনো সমাধান হয়নি।

এসব দাবি নিয়ে গত ১ মাস ধরে লাগাতার কর্মবিরতি পালন করে আসছে ওই ২ চা বাগানের প্রায় ৩৬০ শ্রমিক।

চা শ্রমিকদের অভিযোগ— বাংলাদেশীয় চা-সংসদ ও বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে সম্পাদিত শ্রমচুক্তি অনুযায়ী নবীগঞ্জের ইমাম ও বাওয়ানী চা বাগানের ৩৬০ শ্রমিকের বকেয়া পরিশোধ করছে না মালিকপক্ষ।

এ নিয়ে গত ২৫ জুন চা শ্রমিকদের ৭ দফা দাবি বাস্তবায়ন করার জন্য ইমাম টি এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে লিখিতভাবে জানায় চা শ্রমিকরা। তাদের অভিযোগ আমলে না নেওয়ায় গত ৩ থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করেন তারা।

শ্রমিকদের অভিযোগ—ইমাম ও বাওয়ানী চা বাগানের ৩৬০ শ্রমিকের শ্রমচুক্তি মোতাবেক শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি/এরিয়ার অর্থ বাবদ ২০১৯-২০ ও ২০২১-২২ অর্থ বছরের ৮১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা, এরিয়া বোনাসের ১৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা মালিকপক্ষ পরিশোধ করছে না।

এ ছাড়াও, চা বাগান শ্রমিক ভবিষ্যৎ তহবিলের (পিএফ) ৫৫ লাখ ৮৯ হাজার টাকা মালিকপক্ষ পিএফ কার্যালয়ে জমা না দেওয়ায় অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকরা পিএফ অর্থ পাচ্ছেন না।

অন্যদিকে, ডাক্তার না থাকায় চিকিৎসা সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।

গত ১১ জুলাই বিকেলে সংকট সমাধানে শ্রীমঙ্গল বিভাগীয় শ্রম অধিদপ্তরের সমঝোতায় বৈঠকে বসে ইমাম টি এস্টেট লিমিটেড ও বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ।

সেসময় ইমাম টি এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান জিকে মাইনুদ্দিন চৌধুরী ১৮ জুলাইয়ের মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি/এরিয়ার অর্থ পরিশোধ ও ৩০ আগস্টের মধ্যে ভবিষ্যৎ তহবিলের টাকা পিএফ কার্যালয়ে কিস্তি আকারে জমাসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার আশ্বাস দেওয়া হয়। সেসময় উভয় পক্ষের মধ্যে এ নিয়ে চুক্তি হয়।

এরপর ১২ জুলাই থেকে কাজে যোগ দেন শ্রমিকরা।

গত ১৮ জুলাই বকেয়া মজুরি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় মালিক পক্ষ। আবার নতুন তারিখ হিসেবে ২০ জুলাই বকেয়া পরিশোধের আশ্বাস দেওয়া হয়। সেই তারিখেও বকেয়া পরিশোধ করেনি মালিকপক্ষ।

১২ জুলাই হতে ২০ জুলাই পর্যন্ত চা শ্রমিকরা বাগানে কাজ করলেও ৮ দিনের দৈনিক তলব (মজুরি) ও রেশন শ্রমিকদের দেয়নি মালিকপক্ষ। ফলে ২১ জুলাই থেকে আবার কর্মবিরতি পালন শুরু করেন শ্রমিকরা।

গত ২২ জুলাই ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন চা শ্রমিকরা। ২৬ জুলাই দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে ইমাম ও বাওয়ানী বাগানের চা শ্রমিকরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন। পরে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে বৈঠকে বসেন চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ।

সেসময় চা শ্রমিকদের দাবি পূরণসহ বর্তমান মালিকপক্ষের ইজারা দ্রুত বাতিল করে নতুন মালিক নিয়োগ করে বাগান পরিচালনার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা।

জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে মালিকপক্ষ ৩০ জুলাই বকেয়া অর্থ পরিশোধের আশ্বাস দেয়। সেই তারিখে টাকা না দেওয়ায় ২ আগস্ট মহাসড়কে মিছিল ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।

গত শনিবার ১৯ আগস্ট দুপুরে হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রফিকুল ইসলাম সরেজমিনে ইমাম ও বাওয়ানী চা বাগানে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সেসময় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট প্রিয়াংকা পালসহ উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও বাগানের ম্যানেজার উপস্থিত ছিলেন।

অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) রফিকুল ইসলাম শ্রমিকদের বলেন, আগামী ২২ আগস্ট দুপুরে সচিবালয়ে ইমাম ও বাওয়ানী চা বাগানের সংকট সমাধানে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে মালিকপক্ষকে থাকতে বলা হয়েছে। সেখানে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে। সচিবালয়ে বৈঠকের উদ্যোগ গ্রহণ করায় গতকাল শ্রমিকদের কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়।

ইমাম চা বাগানের সভাপতি রামভজন রবিদাশ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বার বার আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েও মালিকপক্ষ বকেয়া পরিশোধ করেনি। আমরা মানবেতর জীবনযাপন করছি। গত ১ মাস ধরে ২ বাগানের ৩৬০ শ্রমিকের পরিবার অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। বার বার আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন না করায় মালিকপক্ষের ওপর ভরসা করা যায় না। আশ্বাসের বেড়াজাল থেকে বের হয়ে দ্রুত এই সংকট সমাধানে কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়া হউক।'

বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইমাম ও বাওয়ানী চা বাগানের মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে বৈষম্য করছে। বার-বার আশ্বাস দিয়েও তারা টালবাহানা করছে। ২১ আগস্ট আমরা কয়েকটি বাগান মিলে বৃহৎ কর্মসূচি দিয়েছিলাম। পরে জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে যে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি পূরণে সচিবালয়ে ২২ আগস্ট মালিকপক্ষকে নিয়ে বৈঠক হবে। এজন্য আমরা কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত করেছি।'

ইমাম ও বাওয়ানী চা বাগানের মহাব্যবস্থাপক ফখরুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাগান পরিচালনায় মালিকপক্ষ নানা অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে।'

নবীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহীন দেলোয়ার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শ্রমিকদের বকেয়ার পাশাপাশি বাগান কর্তৃপক্ষের কাছে সরকার ৮০ লাখ টাকা ভূমি উন্নয়ন কর পায়। কোনোটিই তারা শোধ করছে না। এ জন্য ইজারা বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।'

Comments

The Daily Star  | English

Penalty less than illegal gains fuels stock manipulation

While fines are intended to deter future offences, questions remain over their effectiveness if the amount is lower than the illegal gain.

12h ago