৭ টাকার পেঁপে যেভাবে ২৫ টাকা হয়

৭ টাকার পেঁপে যেভাবে ২৫ টাকা হয়
স্থানীয় বাজার থেকে কিনে ঢাকায় পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করছেন ব্যবসায়ীরা। ছবি: স্টার

মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে এক কেজি কাঁচা পেঁপের দাম কত? এটা নির্ভর করবে আপনি কার কাছ থেকে কিনছেন তার ওপর। স্থানভেদে এক কেজি পেঁপের দাম ৭ টাকা থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

কেন এত পার্থক্য?

উৎপাদন পর্যায়ে একজন কৃষক প্রতি কেজি পেঁপে বিক্রি করেন ৭ টাকা করে। তবে রাজধানীর কাজীপাড়ার কোনো বাজারে পৌঁছালে সেটার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ টাকা কেজি। 

মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরত্ব পার হয়ে ৩ বার হাত বদলের ফলে দাম বেড়ে যায় ৩ গুণেরও বেশি।

দ্য ডেইলি স্টারের সাম্প্রতিক এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খুচরা বিক্রেতাদের হাতে পৌঁছানোর পর কাঁচা পেঁপের দাম হয়ে যায় আকাশচুম্বী। হাত বদলের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে দাম বাড়ে তা খতিয়ে দেখতে গত ২৯ ও ৩০ অক্টোবর সরেজমিনে ঘুরে আসেন দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদক।

তিনি দেখতে পান, গত ২৯ অক্টোবর সিংগাইরের চর নয়াডাঙ্গী গ্রামের পেঁপে চাষী কাজী মোবারক হোসেন (৪০) চর নয়াডাঙ্গী বাজারে ২৩ হাজার ১০০ টাকায় ৩ হাজার ৩০০ কেজি কাঁচা পেঁপে বিক্রি করেন।

৭ টাকার পেঁপে যেভাবে ২৫ টাকা হয়
ছবি: স্টার

মোবারক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পরিবহন ও শ্রমিক খরচ বাদ দিলে প্রতি কেজি পেঁপের জন্য আমার সাড়ে ৬ টাকা করে লাভ থাকে।'

মোবারক গত ৩ বছর ধরে সাড়ে ৩ বিঘা জমি লিজ নিয়ে পেঁপে চাষ করছেন। প্রতি বিঘা পেঁপে চাষ করতে (জমি লিজের ১৫ হাজার টাকা সহ) তার খরচ হয় ৫৫ হাজার টাকা। 

এ বছর প্রতি কেজি পেঁপে ৫ টাকা থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি করে তিনি প্রায় দেড় লাখ টাকা লাভ করেছেন।

মোবারক বলেন, '৩ মাস আগেও আমি পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে প্রতি কেজি পেঁপে ১০ টাকায় বিক্রি করতাম। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের পর দাম কমে দাঁড়ায় ৫ টাকায়, বর্তমানে সেটা বেড়ে ৭ টাকায় পৌঁছেছে।'

সিত্রাংয়ের কারণে তার অধিকাংশ পেঁপেগাছ উপড়ে গেছে। তবে আগামী বছর প্রায় ৭০ হাজার টাকা লাভের আশা করছেন তিনি।

মোবারক বলেন, 'ফলন ভালো হওয়ায় আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।'

৩৮ বছর বয়সী জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা হয় দ্য ডেইলি স্টার প্রতিবেদকের। জাহাঙ্গীর ১০ বছর ধরে কাঁচা পেঁপের ব্যবসা করছেন। বর্তমানে তিনি চর নয়াডাঙ্গী থেকে কাঁচা পেঁপে কিনে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বিক্রি করেন।

গত ২৯ অক্টোবর তিনি চর নয়াডাঙ্গী বাজার থেকে ৭ টাকা কেজি দরে ৯ হাজার ২৯৫ কেজি কাঁচা পেঁপে কেনেন ৬৫ হাজার ৬৫ টাকায়।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কারওয়ান বাজারের স্থানীয় পাইকারী ব্যবসায়ীদের কাছে প্রতি কেজি পেঁপে ৮ টাকা ২৫ পয়সায় বিক্রি করেছেন তিনি। তবে তার আগে পরিবহন, ওজন করা, পাটের বস্তায় ভরা, শ্রমিক খরচ, ট্রাফিক পুলিশকে ঘুষ, কারওয়ান বাজারে গাড়ি পার্কিং এবং খাবার খরচ বাবদ প্রায় ৯ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছিল।

তিনি বলেন, 'পেঁপেগুলো বিক্রি করে আমার আড়াই হাজার টাকা লাভ হয়।'

জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে পেঁপে কেনেন কারওয়ান বাজারের ফজল মিয়া। গত ২৫ বছর ধরে তিনি ফলের ব্যবসা করছেন। ফজল মূলত যশোর, চুয়াডাঙ্গা, সাভার ও সিঙ্গাইর এলাকা থেকে এসব সবজি কেনেন।

প্রতিকেজি পেঁপেতে পরিবহন ও শ্রমিকের মজুরি বাবদ ৫০ পয়সা ব্যয় ধরে সিঙ্গাইর, যশোর ও চুয়াডাঙ্গা থেকে ২০০ বস্তা পেঁপে কিনেছিলেন ফজল।

এর পর ৩০ অক্টোবর প্রতি কেজিতে তিনি ২৫ পয়সা লাভ রেখে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সাড়ে ৮  টাকায় বিক্রি করেন।

তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি গত ৫-৭ বছরে এত বেশি কাঁচা পেঁপে উৎপাদন হতে দেখিনি।'

৭ টাকার পেঁপে যেভাবে ২৫ টাকা হয়
ছবি: স্টার

এই প্রতিবেদক মিরপুরের কাজীপাড়ার রাস্তার দেখতে পান কারওয়ান বাজার থেকে কেনা এক কেজি কাঁচা পেঁপে ২৫ টাকায় বিক্রি করছেন বিক্রেতারা।

বিক্রেতা মনির হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, তিনি সাড়ে ৮ টাকা দরে ৫০ কেজি কাঁচা পেঁপে কিনেছেন। পরিবহন খরচসহ প্রতি কেজিতে তার ব্যয় হয় সাড়ে ১২ টাকা করে।

তিনি বলেন, 'আমি প্রতি কেজি পেঁপে ২৫ টাকায় বিক্রি করছি। কিছু বিক্রি হবে ২০ টাকায়, আবার কিছু অবিক্রিত থেকে যাবে। গড়ে কেজিতে ১০ টাকা করে লাভ করতে পারব।'

কেন এত বেশি লাভ করছেন জানতে চাইলে মনির বলেন, 'মাসিক বিদ্যুৎ বিল ও অন্যান্য খরচের পাশাপাশি তাকে দৈনিক ৩০০ টাকা 'ফুটপাত ট্যাক্স' দিতে হয়।

তিনি বলেন, '১৫০ কেজি সবজি বিক্রি করে আমার ১ হাজার টাকা লাভ থাকে। '৫০ কেজি পেঁপে বিক্রি করে আমার মাত্র ৫০০ টাকা লাভ থাকবে।'

'৫ বছর আগেও আমাদের এত লাভের দরকার হতো না। তার কারণ সে সময় প্রতিদিন এত বেশি খরচ ছিল না। কিন্তু আজকাল প্রতি কেজি পেঁপে ২ টাকা করে কিনলেও ১৫ টাকার নিচে বিক্রি করতে পারব না', বলেন তিনি।

'আমার পরিবার আমার আয়ের ওপর নির্ভরশীল এবং আমি যদি প্রতিদিন ১ হাজার টাকা উপার্জন করতে না পারি তাহলে আমার বাড়িতে খাবার জুটবে না এবং বাচ্চাদের পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে', যোগ করেন তিনি। 

যোগাযোগ করা হলে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অনেক দিন ধরে দেশে এমন অবস্থা চলছে। ভোক্তারাও এ নিয়ে প্রতিবাদ না করায় ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত লাভের সুযোগ পাচ্ছে।'

তিনি বলেন, 'ক্যাব এ ধরনের সমস্যার বিষয়ে সোচ্চার, কিন্তু ভোক্তাদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ এবং সচেতনতা ছাড়া ফলপ্রসূ কিছুই অর্জন করা যায় না।'

 

Comments

The Daily Star  | English
BNP demands national election by December 2025

2014, 2018, 2024 polls: BNP to sue former ECs, officials today

BNP is set to file a case against officials involved in the last three national elections with Sher-e-Bangla Nagar police today. The party will also lodge a formal complaint with the Election Commission in this regard, BNP leaders said yesterday.  

4h ago