নরসিংদীর ৫ আসনে নৌকার মনোনয়ন চেয়েছেন ৪২ জন

আওয়ামী লীগের মনোনয়ন

নরসিংদীর পাঁচটি সংসদীয় আসনে আগামী দ্বাদশ সংসদ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন ৪২ জন। 

মনোনয়ন প্রার্থীদের অনেকের বিরুদ্ধে আছে নানা অভিযোগ। আবার অনেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন আলোচিত হতে। 

কেউ আবার বলছেন, দলের ফান্ড বৃদ্ধি করাই এত মনোনয়নপত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্য।

নরসিংদী-১ (সদর)

এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ৮ জন। তারা হলেন-বর্তমান সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম হিরু, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জিএম তালেব হোসেন, সাধারণ সম্পাদক কাজী মোহাম্মদ আলী, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান কামরুল, কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য উপকমিটির সদস্য ব্যবসায়ী আলী হোসেন শিশির, বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক মোমেন সরকার, ড. আবুল হোসেন হানিফ, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা দারুস সালাম শাকিল।

একই আসনে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন নরসিংদী পৌরসভার সাবেক মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল। তার বিরুদ্ধে রয়েছে দলে বিভাজন তৈরির অভিযোগ। এছাড়াও তিনি নরসিংদী পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মানিক মিয়া হত্যা মামলার আসামি। 

মনোনয়নপত্র নেওয়া দারুস সালাম শাকিল ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০১৮ সালে তৈরি করা তালিকাভুক্ত মাদক চোরাকারবারি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দারুস সালাম শাকিল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাকে ফাঁসাতে কয়েকটি মূল ধারার সংবাদ মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়েছে, যার  প্রতিবাদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও নিজেও করেছেন। যারা এসব মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করেছেন, তারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রানালয়ের কপি দেখাতে পারবেন না।'

২০১৮ সালে কোনো আইনি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন কি না, এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, 'সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।'

তবে, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির ৭ তারিখে তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতাদের সই করা প্রতিবাদলিপি দেন তিনি যেখানে তার নাম উল্লেখ নেই।

মনোনয়ন চেয়েছেন কেন্দ্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য উপকমিটির সদস্য আলী হোসেন শিশির। তার বিরুদ্ধে রয়েছে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ঋণখেলাপির অভিযোগ। 

এছাড়া, নরসিংদী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ১ কোটি ৫৮ লাখ ৪৯ হাজার ৯৮০ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার মালিকানাধীন মেসার্স সোনালী ট্রেডার্স ও ফেব্রিক্সের বিরুদ্ধে। তার কাছে বিল পেতে গত বছরের ৮ নভেম্বর জেলা প্রশাসককে চিঠিও দেয় নরসিংদী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে আলী হোসেন শিশির ডেইলি স্টারকে বলেন, '৩৩৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। আমরা ইতোমধ্যে ১০৫ কোটি টাকা ব্যাংকে রিটার্ন দিয়েছি। করোনার জন্য দুই বছর ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের জন্য একবছর ঠিকমতো ব্যবসা পরিচালনা করতে না পারার বিষয়টি ব্যাংক বিবেচনায় নেবে আশা করি। আমরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। সুতরাং আমাকে ব্যাংক ডিফল্টার বলার সুযোগ নেই।'

বকেয়া বিদ্যুৎবিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'আমার মালিকানাধীন টেক্সটাইলের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধও একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। সুতরাং এগুলোর সঙ্গে নির্বাচনের মনোনয়ন পাওয়া বা না পাওয়া জড়িত নয়।'

তিনি এগুলোকে 'ব্যক্তিগত বিষয়' হিসেবে অভিহিত গণমাধ্যমে প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন।

তবে, নরসিংদী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি- ১ এর উপচালক মনির হোসেনের সগ্নে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের বকেয়া পরিশোধ না করায় আমরা আলী হোসেন শিশিরের মালিকাধীন মেসার্স সোনালী টেডার্স ও ফেব্রিক্সের বিদ্যুৎ সংযোগ কয়েকমাস আগে বিচ্ছিন্ন করতে বাধ্য হয়েছি। এখনো টাকা পরিশোধ করেননি। তাই নতুন সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি।'

নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জি এম তালেব হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি জাতীয় পার্টির পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। 

এ প্রসঙ্গে জি এম তালেব হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ১৯৮৫ সালে লাঙ্গল প্রতীকে জামায়াত নেতা হান্নানের সাথে হেরে যাই, জোর করে ভোট মেরে হারিয়ে দেওয়া হয়। তখনো জাতীয় পার্টির জন্য লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয়নি। আমি ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আছি। আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে আমাকে জাতীয় পার্টির লোক বলা হয়েছিল। কিছু ব্যক্তি সুবিধা নেওয়ার জন্য, এখন একই উদ্দেশ্যে মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে, যার কোনো ভিত্তি নেই।'

নরসিংদী-২ (পলাশ)

এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন ৩ জন। তারা হলেন-বর্তমান সংসদ সদস্য ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি সৈয়দ জাবেদ হোসেন ও সাবেক বিচারপতি মনসুরুল হক চৌধুরী। 

সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপের ছোট ভাই বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য কামরুল আশরাফ খান পোটনের মালিকানাধীন পোটন ট্রেডার্সের বিরুদ্ধে রয়েছে সার আত্মসাতের কেলেঙ্কারির অভিযোগ। যা সারাদেশে ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে।

নরসিংদী-৩ (শিবপুর)

এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন ১২ জন। তারা হলেন-বর্তমান সংসদ জহিরুল হক ভুঁঞা মোহন, সাবেক সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মাহমুদুল কবির সাহিদ, জেলা আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক মাহফুজুল হক টিপু, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম ভুঁইয়া রাখিল, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, সাবেক এমপি প্রয়াত রবিউল আওয়াল খান কিরণের ছেলে ফজলে রাব্বি খান, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আ ফ ম মাহবুবুল হাসান, শাহীন হায়দার পিয়াস, মোহসিনা জান্নাত রিমি, মাসুদ হায়দার, নুরুউদ্দিন মোল্লা। 

এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূঞা মোহন ও তার ভাই জোনায়েদুল হক ভূঞা জুনুর বিরুদ্ধে উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ খান হত্যা মামলার আসামিদের সঙ্গে সখ্যতার অভিযোগ রয়েছে। 

গত ২৫ ফেব্রুয়ারি উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ খান নিজ বাসায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ৩১ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। 

মনোনয়ন প্রত্যাশী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের বিরুদ্ধে হারুনুর রশীদকে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রের যোগান ও হত্যাকারীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আছে।

এ অভিযোগ প্রসঙ্গে আসাদুজ্জামান আসাদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মামলা প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক নেতার নামে আছে। আমি যড়যন্ত্রের শিকার। আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। আমি আশাবাদী আমাকেই দল সঠিক মূল্যায়ন করবে এবং আমিই এগিয়ে যাব।'

হত্যা মামলার আসামিদের সঙ্গে সখ্যতার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূইয়া মোহন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমি দলীয় মনোনয়ন সংগ্রহ করে ফটোসেশন করেছি। পেছনে ২০০ লোক ছিল। এখন কে হারুনুর রশিদের হত্যা মামলার আসামি, আমার জানার সুযোগ ছিল না। আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাকে ফাঁসাতে ও বিতর্কিত করতে কেউ তাদের আমার পাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। হারুনুর রশিদ খানের হত্যায় কারা জড়িত আমি জানি না, তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার বিষয়ে অবগত আছেন।'

এছাড়া, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নৌকার বিরুদ্ধে লড়েছেন দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।

নরসিংদী-৪ (মনোহরদী-বেলাব)

এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন ৭ জন। তারা হলেন-বর্তমান সংসদ সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, তার ছোট ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খায়রুল মজিদ মাহমুদ চন্দন, সহসভাপতি ডা. আবদুর রউফ সরদার, জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক মোহাম্মদ আলী খান রিপন, জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য অহিদুল হক আসলাম সানী, মনোহরদী উপজেলা চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম খান বীরু, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী মাজহারুল ইসলাম।  

নরসিংদী-৫ (রায়পুরা)

এ আসনের মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন ১২ জন। তারা হলেন-বর্তমান সংসদ সদস্য রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, তার স্ত্রী কল্পনা রাজিউদ্দিন, ছেলে রাজিব আহমেদ পার্থ, ভাই সালাহ উদ্দিন আহমেদ বাচ্চু, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এ বি এম রিয়াজুল কবির কাউছার, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ, জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি সামসুল হক, জেলা আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক সাইদুর রহমান রাসেল, রায়পুরা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান চৌধুরী, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক উপকমিটির সদস্য রিয়াদ আহমেদ, কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল বাসার ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য তৌফিকুর রহমান।

রায়পুরায় একই পরিবার থেকে চারজনের মনোনয়ন সংগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে এমপি রাজিউদ্দিনের স্ত্রী কল্পনা রাজিউদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মূলত দলের ফান্ড বৃদ্ধি করাই মূল উদ্দেশ্য। তাই সবাই দলের মনোনয়নপত্র কিনেছি।'

রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি তৃণমূলের রাজনীতি করি, ১/১১ এর পর পালিয়ে যাইনি। দলের সবাই আমার ভূমিকা জানে। দল যাকে পছন্দ করে, যার দলে অবদান আছে, তাকে মনোনয়ন দিয়ে দলের হাতকে শক্তিশালী করলে, আমার আপত্তি নেই, সবার মনোনয়ন উত্তেলনের অধিকার আছে।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Managing expectations the challenge for EC

The EC was a rubber stamp to legalise AL's usurpation of power in last three elections

4h ago