‘ধূম্রজাল’ সৃষ্টি করতেই সিইসি ‘রাজনৈতিক সমঝোতা’র কথা বলছেন

অধিকাংশ দলের মতামত উপেক্ষা করে ১৫০ আসনে ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এখন 'রাজনৈতিক সমঝোতা' হলে সব আসনে ব্যালট ব্যবহারে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) ঘোষণাকে 'ধূম্রজাল' সৃষ্টির উদ্দেশ্য হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

তাদের মতে, ব্যালটে ভোট নিয়ে তো বিতর্ক নেই। বিতর্ক আছে ইভিএমে ভোট নিয়ে। সমঝোতার প্রসঙ্গ ইভিএমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ব্যালটের ক্ষেত্রে নয়। সুতরাং সিইসির এই বক্তব্য দুরভিসন্ধিমূলক।

তাদের মতে, নির্বাচন কমিশনের প্রধান দায়িত্ব একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। এর জন্য প্রয়োজনীয় যেকোনো সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারে।

গতকাল বুধবার সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ইভিএম নিয়ে কোনোভাবেই রাজনৈতিক সংকট প্রকট হবে না। সংকট ইভিএম নিয়ে নয়, সেটা আরও মোটা দাগের সংকট। রাজনৈতিক সমঝোতা মাধ্যমে ফয়সালা হলে সব ভোট ব্যালটে হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, সিইসি এই বক্তব্য দিয়েছেন ধূম্রজাল তৈরি করতে। ইভিএম থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাতে তিনি একটি ইস্যু তৈরি করছেন।

নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ২৮টি দল কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বসেছে। এর মধ্যে ১০টি দল সরাসরি ইভিএমের বিপক্ষে মত দিয়েছে এবং পক্ষে মত দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের শরীক ৩টি দল। ২টি দলের ইভিএম নিয়ে কোনো মতামত নেই এবং ১২টি দল শর্তসাপেক্ষে ইভিএম ব্যবহার করা যায় বলে মত দিয়েছে। এই শর্তের মধ্যে রয়েছে ইভিএমে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বলে দিয়েছে, তারা ইভিএম চায় না। তারপরও নির্বাচন কমিশন এমন একটি যন্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যেটা আসলে একটি জালিয়াতির যন্ত্র।'

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ আলী ইমাম মজুমদার বলেন, 'সমঝোতা হলে তারপর যদি ব্যালটের সিদ্ধান্তে যেতে হয়, তাহলে দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হওয়ার পরও নির্বাচন কমিশন ইভিএমে কেন যাবে? সিইসির বক্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্যতা নেই। এতে মানুষ আরও বিভ্রান্ত হবে, নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের যেটুকু আস্থা আছে, সেটুকুও নষ্ট হবে।'

২০১০ সালের ১৭ জুলাই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন। এরপর রংপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনেও এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার হয়।

২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ৬টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন। এ ছাড়াও, উপজেলা ও পৌর নির্বাচন এবং কয়েকটি সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচন ও সিটি নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়। সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে সবগুলো কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হয় ইভিএমে।

তবে, ইভিএমের নানাবিধ সীমাবদ্ধতা, ভোটার ভেরিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) না থাকাসহ নানা কারণে এর বিরোধিতা করছে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্ট নাগরিকরা। প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীও বলেছিলেন, ইভিএম একটা নিম্নমানের যন্ত্র।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার বুঝতে পারছেন যে ইভিএম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ইন্ট্রোডিউস করা হচ্ছে। কোনো ধরনের সেফগার্ড না রেখেই ইভিএমের কথা বলা হচ্ছে। এটা করা হচ্ছে হয়তো কোনো একটা বিশেষ দলের চাপে।'

'ভোটের জন্য এমন একটি পদ্ধতি বেছে নিতে হবে যার সঙ্গে মানুষ পরিচিত, যার প্রতি আস্থা আছে এবং যার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ নয়। ইভিএমের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ', যোগ করেন তিনি।

জনগণের দাবি সুষ্ঠু নির্বাচন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যেই এ দেশে ২টি নির্বাচন মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। তৃতীয় একটা নির্বাচনও যদি শুধুমাত্র প্রযুক্তির কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্ন আর থাকবে না।'

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১১টি নির্বাচনের প্রসঙ্গ তুলে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া ৪টি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়েছে। ২টি হয়েছে একতরফা এবং ৫টি দলীয় সরকারের অধীনে। এই ৭টি নির্বাচনের সবগুলোই বিতর্কিত।'

নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ (বিএনপি) বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। এই দাবিতে বিএনপি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বয়কটও করেছিল। তবে, তারা ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়।

২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে ২০১১ সালে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর উপায় নেই বলে বারবারই বলে আসছেন দলটির নেতারা।

রাজনীতির ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত জোর করে ধরে রাখা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে করেন আলী ইমাম মজুমদার। '১/১১ এর ঘটনার সময় বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। বিএনপি যদি তখন নির্বাচন করত, তাহলে হয়তো হারত। কিন্তু, গত কয়েক বছরে দল হিসেবে তাদের যে ক্ষতি হয়ে গেছে, এই পরিমাণ ক্ষতি তাদের হতো না। তারা যে পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তারই পরিণাম হিসেবে এলো ১/১১', বলেন তিনি।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আইনকে অস্ত্রে পরিণত করা হয়েছে এবং বিরোধী দলের ওপর যে দমন-পীড়ন চলছে, তাতে তারা নির্বাচনই করতে পারবে না বলে মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, 'তারা তো অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে যে বিধান করা হয়েছে, সেখানে তো একটা বিষয় পরিষ্কার যে এভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় না।'

সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার কোনো বিকল্প নেই এবং এর জন্য নির্বাচন কমিশনকে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

তবে, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কোনো 'মাথাব্যথা নেই' উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'একটি বিশেষ শ্রেণির স্বার্থই কেবল দেখা হচ্ছে। সাধারণ জনগণের স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। বিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চাইলে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এই দমন-পীড়ন বন্ধে তারা নির্দেশ দিতে পারে, কেননা এটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক না, বরং প্রতিবন্ধক।'

'নাগরিক অধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ' উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'কে নির্বাচনে অংশ নিলো আর কে নিলো না, তারচেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন। আর সেটা নিশ্চিত করাই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এর জন্য যা যা করা দরকার, তাদের তা করতে হবে।'

'সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য জনগণ প্রস্তুত নয় এমন কোনো প্রযুক্তি, সেটার প্রতি নির্বাচন কমিশনের যত আস্থাই থাকুক, ব্যবহার করা যাবে না। যে প্রযুক্তির ওপর জনগণের আস্থা আসবে না, যে প্রযুক্তির জন্য জনগণ প্রস্তুত নয়, এমন কোনো প্রযুক্তি দিয়ে আগামী নির্বাচন করার কোনো সুযোগ নেই', যোগ করেন এই আইনজীবী।

সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, ইভিএম বা ব্যালট নয়, সবচেয়ে বড় বিষয় রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা। সমস্যা সমাধানে রাজনীতিবিদদের একে অপরকে ছাড় দিয়ে কথা বলতে হবে।

Comments