বিকাশ ক্যাশ আউটে বাড়তি টাকার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা

অভিযুক্ত বিকাশ এজেন্ট আনিকুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

নরসিংদীতে মোবাইলে টাকা লেনদেনের প্রতিষ্ঠান বিকাশের ক্যাশ আউটে অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে অন্তত ৫০ জন গ্রাহকের কাছ থেকে ১০ কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার ছেলের বিরুদ্ধে।

অভিযুক্ত বিকাশ এজেন্ট আনিকুল ইসলাম (২৩) নরসিংদী সদর উপজেলার আলোকবালী ইউনিয়নের সাবেক ইউপি সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আরিফা ইয়াসমিন মুন্নির (৪২) ছেলে।

প্রতারণার অভিযোগ পেয়ে গত ২ ফেব্রুয়ারি জেলা প্রশাসন নরসিংদী সদর থানার পুলিশের ডিএসবি শাখাকে ছায়া তদন্তের নির্দেশ দেয়। তদন্তে প্রতারণার বিষয়টি উঠে আসে। ভুক্তভোগীরা মঙ্গলবার নরসিংদী সদর থানায় আনিকুল ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

আনিকুলের মা আরিফা ইয়াসমিন মুন্নি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য বলে জানা গেছে।

এ কমিটির আরেক সদস্য ও ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি আসাদুজ্জামান রিপন দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, আর্থিক প্রতারণার এ ঘটনায় আগামী শনিবার কমিটির জরুরি সভা ডাকা হয়েছে।

ভুক্তভোগীদের একজন সোহান আলী (২৫) বলেন, 'আনিকুল প্রতি এক লাখ টাকা ক্যাশ আউট করলে অতিরিক্ত তিন হাজার টাকা করে দিত। সে এভাবে গত তিন মাস ধরে আমাদেরকে লাভ দিয়ে আসছে। একই এলাকার ছেলে হওয়ায় তার প্রতি আমাদের আস্থা তৈরি হয়। এলাকার অনেকেই তার ওখানে লাখ টাকার বেশি ক্যাশ আউট করার জন্য পাঠাত। সকালে ক্যাশ আউট করলে বিকেলে লাভসহ আমাদেরকে টাকা দিত। কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে বিভিন্ন অজুহাতে সে টাকা দিচ্ছিল না। সুযোগ বুঝে সবার টাকা হাতিয়ে নিয়ে গত সপ্তাহে সে পালিয়ে যায়।'

তিনি আরও বলেন, 'তার পরিবারকে এসব বিষয় জানানো হলে উল্টো তারা আমাদেরকে বলে আমরা নাকি আনিকুলকে গুম করেছি। তারা উল্টো হুমকি দেয়। তার পরিবার এলাকায় প্রভাবশালী হওয়ায় অভিযোগ করেও কোনো ফল পাইনি।'

আরেক ভুক্তভোগী আল আমিন (৩২) বলেন, 'আমি প্রতিবন্ধি মানুষ হিসেবে আয় রোজগার না করতে পারি না। অতিরিক্ত লাভের আশায় আনিকুলকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিয়েছিলাম। অভিযুক্ত আমার পাশের বাসার ছেলে। তার মায়ের কাছের টাকা চাইলে উল্টো আমাদেরকে হুমকি দেয়। এখন না খেয়ে মারার অবস্থা হয়েছে। মঙ্গলবার আমরা সাত জন ভুক্তভোগী থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। আমাদের টাকার পরিমাণ ২ কোটি ৮০ লাখ।'

একই এলাকার আরেক ভুক্তভোগী খলিল উল্লাহ স্টোরের মালিক খলিল উল্লাহ বলেন, 'আনিকুলের মায়ের আশ্বাসে তার সঙ্গে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। ব্যবসার অংশীদার হিসেবে ১০-১২ দিন আগে ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিকাশে দিই। আনিকুলের এজেন্ট নম্বরে টাকা পাঠানোর ডকুমেন্টও আছে। এখন টাকা, সম্মান দুটোই শেষ। মানসিকভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে চরম খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি।'

প্রায় ৫০ জন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার তালিকা পেয়েছে দ্য ডেইলি স্টার।

আলোকবালী ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন দীপু বলেন, 'অভিযুক্ত আনিকুল বা তার পরিবারের দৃশ্যমান আয় নেই। অথচ গত দুই মাসে তারা অন্তত দুই কোটি টাকায় সদর উপজেলার সংগীতা ও বাসাইল এলাকায় দুটি বাড়ি কিনেছেন। তার মা-বাবার বিরুদ্ধেও অতিরিক্ত লাভের আশা দেখিয়ে বিভিন্ন সময় টাকা হাতিয়ে নেওয়ার একাধিক অভিযোগ ছিল। যেহেতু থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছে, ঘটনাও বড়, তাই আমরা চাই প্রশাসন অপরাধীদের বিচার করুক।'

ছায়া তদন্তকারী কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমি প্রাত ৫০ জন ভুক্তভোগীর নাম পেয়েছি যাদের টাকার পরিমাণ ১০ কোটিরও বেশি। বুধবার সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।'

নরসিংদী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. তানভীর আহমেদ বলেন, '৭ জন ভুক্তভোগীর কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। আরও অনেক ভুক্তভোগী আছে। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, বিকাশে অতিরিক্ত টাকা দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সরল বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে ভুক্তভোগীদের টাকা আনিকুল আত্মসাৎ করেছে। আমরা লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। ভুক্তভোগীদের কেউ হুমকি দিলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

নরসিংদী জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম বলেন, 'টাকা আত্মসাতের বিষয়টি ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ছাড়াও আমরা ছায়া তদন্ত করে খোঁজ নিয়েছি। অতিরিক্ত লাভের আশা দেখিয়ে গ্রামের মানুষদের বোকা বানিয়ে একটি চক্র টাকা পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে, টাকার পরিমাণ এখনও জানা যায়নি। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

তবে নাম প্রকাশ না করার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ঢাকা অফিসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, 'আনিকুলের পাসপোর্টের তথ্য বলছে সে গত ১০ ফেব্রুয়ারি সে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ চলে গেছে।'

প্রতারণার বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত আনিকুল ইসলামের মা আরিফা ইয়াসমিনকে ফোন করা হলে, তিনি রিসিভ করেননি।

টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে আনিকুলের বাবা মাইনউদ্দিন অভিযোগ অস্বীকার করে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমার ছেলে কারো কাছে থেকে কোনো টাকা নেয়নি। গত কয়েকদিন ধরে আমরাও তাকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা শহরে কোনো বাড়ি কিনে থাকলে সরকার তা খুঁজে বের করে বাজেয়াপ্ত করুক। ছেলেকে খুঁজে বের করতে আমরাও নরসিংদী সদর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছি।'

 

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago