পাকিস্তান পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ বিলুপ্ত, যেভাবে হবে পরবর্তী নির্বাচন

পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি সংবিধানসম্মত প্রক্রিয়া। দেশটির সংবিধানের ৫২ ধারা অনুযায়ী, নিম্নকক্ষের প্রথম অধিবেশন দিনটি থেকে শুরু করে ঠিক ৫ বছর পূর্তির দিন এর মেয়াদ শেষ হয়।
পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন চলছে। ফাইল ছবি: এএনএন
পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশন চলছে। ফাইল ছবি: এএনএন

পাকিস্তান পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ 'ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি' মেয়াদ পূর্তির ৩ দিন আগেই বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে এর প্রভাব ও পরবর্তীতে কী হতে যাচ্ছে, সে বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এশিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক (এএনএন)।

বিলের ওপর প্রভাব

নিম্নকক্ষ বিলুপ্ত হলেও সিনেট বা পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের কার্যক্রমে এর কোনো প্রভাব পড়বে না। যেসব বিল শুধু নিম্নকক্ষে পাস হয়েছে কিন্তু সিনেটের অনুমোদন পায়নি, সেগুলো বাতিল হিসেবে গণ্য হবে।

যে বিলগুলো ২ কক্ষেরই অনুমোদন পেয়েছে, সেগুলো প্রেসিডেন্টের কাছে ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। তিনি ১০ দিনের মধ্যে এগুলোতে সই না করলেও এসব বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনুমোদিত হিসেবে গণ্য হবে।

'বিলুপ্ত' বলতে কী বোঝায়

পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটি একটি সংবিধানসম্মত প্রক্রিয়া। দেশটির সংবিধানের ৫২ ধারা অনুযায়ী, নিম্নকক্ষের প্রথম অধিবেশন দিনটি থেকে শুরু করে ঠিক ৫ বছর পূর্তির দিন এর মেয়াদ শেষ হয়।

চলমান অ্যাসেম্বলি ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট যাত্রা শুরু করেছিল। নিম্নকক্ষের এই বিলুপ্তি কোনো বিশেষ পরিস্থিতির জন্য নয়, বরং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রেখে ৫ বছর পর পর দেশের মানুষকে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।

তবে, প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্টের কাছে সুপারিশ করলে ৫ বছর মেয়াদপূর্তির আগেও নিম্নকক্ষ বিলুপ্ত করা হতে পারে।

পাকিস্তানের সংবিধানের ৫৮ ধারা অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট নিম্নকক্ষ ভেঙে দিতে ব্যর্থ হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

যদিও প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হলে তিনি এ ধরনের সুপারিশ করতে পারবেন না। এ কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার পর তিনি নিম্নকক্ষ বিলুপ্ত করতে পারেননি।

পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত মাত্র ২ বার নিম্নকক্ষের ৫ বছরের মেয়াদ পুরোপুরি পূরণ হয়েছে—২০১৩ ও ২০১৮ সালে।

যেভাবে বিলুপ্ত হলো নিম্নকক্ষ

পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার আগে সমাপনী বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। ছবি: ডন
পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার আগে সমাপনী বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ। ছবি: ডন

বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের সুপারিশে প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি ১০ আগস্ট মধ্যরাতে নিম্নকক্ষ বিলুপ্তির প্রস্তাবে অনুমোদন দেন। যার ফলে জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হয়।

এর আগে পর পর ২ মেয়াদে গণতান্ত্রিক সরকার তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেও এবার ৩ দিন আগেই ভেঙে দেওয়া হলো পার্লামেন্ট।

পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা

নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের (ইসিপি) ওপর বেশ কিছু দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।

সংবিধানের ২২৪ ধারা অনুযায়ী, মেয়াদপূর্তির ৬০ দিনের মধ্যে অথবা মেয়াদের আগে নিম্নকক্ষ বিলুপ্ত করা হলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই পরবর্তী নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে।

নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা থাকার পাশাপাশি ইসিপি চাইলে নির্বাচন স্থগিত বা ফলাফল ঘোষণার ৬০ দিনের মধ্যে তা বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। শুধু বড় আকারে অবৈধ কার্যক্রম বা নির্বাচনী আইনের লঙ্ঘনের ক্ষেত্রেই তা সম্ভব।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা

নিম্নকক্ষ বিলুপ্ত হওয়া থেকে শুরু করে নতুন নির্বাচন আয়োজনের আগ পর্যন্ত সময়কালের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হবে।

তত্ত্বাবধায়ক মন্ত্রীসভার মূল দায়িত্ব হচ্ছে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করা।

এ ছাড়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেকটি দায়িত্ব হলো দৈনন্দিন সরকারি কার্যক্রম অব্যাহত রেখে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিরপেক্ষ হতে হবে এবং সদস্যদের কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারবে না, যাতে সদস্যরা কোনোভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে না পারেন।

পাকিস্তানের নির্বাচনী আইন ২০১৭ এর ১৪ অধ্যায় অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকার অত্যন্ত জরুরি না হলে কোনো গুরুতর নীতিমালা সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেবে না। এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না বা নীতিমালা চালু করবে না, যা ভবিষ্যৎ সরকারের কাজে কোনো ধরনের বাধার সৃষ্টি করতে পারে।  জনস্বার্থ বিরোধী কোনো চুক্তি করবে না বা উদ্যোগ নেবে না। অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে বড় আলোচনায় বসবে না বা বিদ্যমান কোনো চুক্তির শর্ত পরিবর্তন করবে না।

এ ছাড়া, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সরকারি বড় পদে কোনো নতুন নিয়োগ দেবে না বা কাউকে পদোন্নতিও দেবে না। বরং জনস্বার্থে স্বল্প মেয়াদে বা ভারপ্রাপ্ত হিসেবে নিয়োগ দেবে। বিশেষ কোনো কারণ না থাকলে সরকারি কর্মকর্তাদের বদলি করবে না, আর করলেও তা কমিশনের অনুমোদন ছাড়া করা যাবে না। এমন কিছু করবে না, যা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে কোনো ভাবে প্রভাবিত করতে পারে।

সম্পদ ও ঋণের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য সকল সদস্য ক্ষমতাগ্রহণের ৩ দিনের মধ্যে তাদের সম্পদ ও ঋণের বিস্তারিত বিবরণ নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেবেন। সঙ্গে তাদের স্ত্রী, সন্তান ও তাদের ওপর নির্ভরশীলদেরও একই তথ্য জমা দিতে হবে। ইসিপি একটি আনুষ্ঠানিক গেজেটের মাধ্যমে এসব তথ্য প্রকাশ করবে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়োগ কে দেবেন

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মন্ত্রীসভার নিয়োগ দেবেন প্রেসিডেন্ট অথবা গভর্নর (প্রাদেশিক পার্লামেন্টের ক্ষেত্রে)। তবে এই প্রক্রিয়ায় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলের নেতার সঙ্গে সম্মিলিতভাবে পরিচালনা করতে হবে।

৩ পক্ষের ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যরা নির্বাচিত হবেন।

যদি ৩ দিনের মধ্যে এ বিষয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো না যায়, তবে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলের নেতা প্রতি পদের জন্য নিজ নিজ পছন্দের ব্যক্তিদের নাম একটি কমিটির কাছে পেশ করবেন।

এই কমিটিতে ৮ জন সদস্য থাকবেন, যাদের মধ্যে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির স্পিকার ও আরও ৭ জন বিদায়ী পার্লামেন্ট সদস্য থাকবেন। এতে সিনেট বা নিম্নকক্ষ, উভয়ের সদস্য থাকতে পারেন।

কমিটির মাধ্যমেও ঐক্যমত্যে পৌঁছানো না গেলে তালিকাটি নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হবে।

নির্বাচন কমিশনকে সে ক্ষেত্রে ২ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এ প্রক্রিয়া চলাকালীন সময় বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ও মূখ্যমন্ত্রী তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে থাকবেন, যতক্ষণ না তত্ত্বাবধায়ক সরকার চূড়ান্ত হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ

পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার আগে শেষ অধিবেশনে মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ছবি তোলেন। ছবি: ডন
পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ভেঙে দেওয়ার আগে শেষ অধিবেশনে মন্ত্রীসভার সদস্যদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ছবি তোলেন। ছবি: ডন

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৬০ দিন বা ৯০ দিন হতে পারে।

তবে নির্বাচন কমিশনের একাধিক বক্তব্য থেকে জানা গেছে, আগামী বছরের মার্চ বা এপ্রিলের আগে নির্বাচন আয়োজনের সম্ভাবনা খুব একটা নেই।

এছাড়াও, গত মাসে পার্লামেন্টে ২০১৭ সালের নির্বাচনী আইনকে সংস্কারের একটি বিল পাস হয়েছে, যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারও দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

সব মিলিয়ে ধারণা করা হচ্ছে, এবারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ৯০ দিন নয়, বরং আরও বেশিও হতে পারে এবং এটি নিশ্চিত করতে প্রয়োজন অনুযায়ী আইনের সংস্কারও করা হবে।

Comments

The Daily Star  | English

The psychological costs of an uprising

The systemic issues make even the admission of one’s struggles a minefield

9h ago