শ্রদ্ধা

সৈয়দ আবুল মকসুদের দরদী মনের খোঁজে

সৈয়দ আবুল মকসুদের নানাবিধ বিষয়ে আগ্রহের কমতি ছিল না। জীবদ্দশায় তিনি সেটা প্রমাণ করে গেছেন অক্ষরে অক্ষরে। সময় নষ্ট করার ধাত ছিল না। উল্টো অংকের মতো করে কাজে লাগিয়েছেন প্রতিটা মুহূর্ত। তিনি সাংবাদিক ছিলেন। ছিলেন কবি, কলাম লেখক, গবেষক, টকশোর দুঁদে বক্তা, সামাজিক আন্দোলনের একেবারে সামনের সারির অ্যাক্টিভিস্ট, গান্ধীবাদী দেশহিতৈষক।

দরদী একটা মন ছিল সৈয়দ আবুল মকসুদের। এই দরদ ছিল মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি, রাষ্ট্রের প্রতি। দরদী মন দিয়ে তিনি সবকিছুকে বুঝতে চেয়েছেন, ভালওবেসেছেন। একারণে তিনি রাস্তা এবড়ো খেবড়ো হলে সংস্কারের জন্য যেমন রাস্তায় নেমেছেন, তেমনি শিশুদের খেলার মাঠ দখল হলে তার মন ব্যথাতুল হয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়কারী যে কোন কাজের বিরুদ্ধে একাত্ম হয়েছেন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে।

রাজধানী ঢাকা ও তার আশে পাশে কিংবা ঢাকা থেকে দূরে কোথাও সংগঠিত সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি সশরীরে থেকেছেন। সেটা সম্ভব হলে না হলে লেখার মধ্যে দিয়ে সেই আন্দোলনে গতিসঞ্চার করেছেন। এসবই সম্ভব হয়েছে তার দরদী মনের কারণেই। এই দরদের প্রকাশ ঘটিয়েছেন যেমন লেখালেখিতে তেমনই যাপিত জীবনেও। পোশাকেও ছিলেন বাহুল্যবর্জিত, জীবনের শেষ কয়েক দশকতো গান্ধীবাদী পোশাক পরেই কাটিয়ে দিয়ে গেলেন। খাওয়া দাওয়াতেও ছিলেন ভীষণ রকমের সাবধানী, সতর্ক ও অন্যের ব্যাপার চিন্তাগ্রস্ত। তিনি বাঁচার জন্য খেতেন, খাওয়ার জন্য নয়। এক একটা ঘটনায় তিনি কেবল ব্যথিত হতেন তাই নয়, তা দেখে-শিক্ষা নিয়ে করণীয় কী সেটাও নির্ধারণ করতেন এবং নিজের জীবনে সেটা প্রয়োগ করতেন।

অন্যের জন্য দরদ থেকেই তিনি নিজের যাপিত জীবনের প্রতিদিনের চব্বিশ ঘণ্টাকে ভাগ করে নিয়েছিলেন ঘড়ির কাঁটা ধরে। আলাপচারিতায় জানিয়েছিলেন সেই রোজনামচা। চব্বিশ ঘণ্টাকে ভাগ করে নিয়েছিলেন তিনভাগে। আট ঘণ্টা করতেন পড়া, লেখা ও গবেষণার কাজ। আট ঘণ্টায় ছিল সামাজিক আন্দোলন ও রাষ্ট্র সংস্কারে কাজ সমূহ, এর মধ্যেই ছিল কোথাও যাওয়া, টকশোতে হাজিরা দেওয়াসহ প্রতিদিনের বিবিধ কাজসমূহ। বাকী আট ঘণ্টা ছিল নিজের ও পরিবারের জন্য, যার মধ্যে ছিল খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রাম। ঘোড়সওয়ার যেমন শাসন দিয়ে ঘোড়াকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়ে যান, প্রয়োজনে চাবুকের প্রহার করেন। তিনিও তেমনি অভিপ্রায় অনুযায়ী রোজনামচা বাস্তবায়নে ছিলেন কঠোর ধ্যানমগ্ন।

নানামুখী উদ্যোগ, আগ্রহ ও দরদী মন দিয়ে কী চেয়েছিলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। জীবদ্দশায় এই প্রশ্ন করা হয়নি আমাদের। আকস্মিক ও অকাল মৃত্যুর কারণে সেই সুযোগ বঞ্চিত হয়েছি আমরা। গড় মৃত্যুর বয়স পেরোলেও তিনি সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম ছিলেন বলে, প্রতীতি ছিল তিনি আমাদের মাঝে আরও দীর্ঘসময় থাকবেন। কিন্তু হলো না তেমনটা। করোনার মতো ভয়ঙ্কর এক মহামারী সময়ের ধাক্কা ও চোখ রাঙানি কাটিয়ে ওঠার পর ২০২১ এ বিদায় নিলেন তিনি। জন্মেছিলেন ১৯৪৬ সালের ২৩ অক্টোবর। ইহজাগতিকতা পাড়ি দিলেন ভাষা শহীদের মাস ফেব্রুয়ারির আরেক ২৩ তারিখে।

নাতিদীর্ঘ রেখার এক জীবন তিনি কাজের আলোয় ভরিয়ে দিয়ে গেছেন। তার সেই কাজ বাংলা ভাষাভাষি এবং বাংলাদেশের মানুষের জন্য আগুনের পরশমণি তুল্য। এই আগুনে রয়েছে দেশকে, জাতিকে জাগানোর তাপ, চাপ ও বীজমন্ত্র। যদি প্রশ্ন করা যায়, তিনি জীবনভর এতো এতো কাজ দিয়ে আসলে কী চেয়েছেন? কী ছিল তার মনস্কামনা ও এক জীবনের সাধনা। আমরা মনে করি, এর উত্তর রয়েছে তাঁর কাজের গভীরে, গবেষণালব্ধ অনুসন্ধানে। তিনি চেয়েছিলেন এই দেশ ও জাতির ইতিহাস নির্মিত হোক। যে সব কৃতী মানুষদের জীবন ও কর্মে রয়েছে বাঙালি জাতি ও বাঙালি মুসলমানের গর্ব ও গৌরবের আধার তিনি সেসব অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন। শুধু অনুসন্ধান নয়, তিনি সেসবের যৌক্তিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও হাজির করেছেন।

সৈয়দ আবুল মকসুদের ব্যতিক্রমীতা ও স্বতান্ত্রিক কাজের পরিচয় গবেষণাকর্মেই নিহিত রয়েছে বলে মনে করি। উনার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে লেখা ছয়টি বই, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা আটটি বই, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহকে নিয়ে লেখা তিনটি বই, নবাব সলিমুল্লাহকে নিয়ে লেখা দুটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে লেখা ‍দুটি বই; এভাবে সংখ্যা বাড়ানো যাবে। এসব গবেষণায় সৈয়দ আবুল মকসুদের এমন সব বিষয়ের প্রতি ঝোঁক ছিল যা, কেবল স্বল্প আলোয় কিংবা আড়ালে পড়ে ছিল এমন নয়। তিনি অনুসন্ধান, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়েছেন দেশকে, দেশের  মানুষকে। এটা সম্ভব হয়েছে উনার দরদী মনের কারণে। 

যে মন অন্বেষণ করতে চেয়েছে এমন কিছু যা জাতিকে দিশা দেখাবে। জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করবে। জাতি খুঁজে পাবে তার মহোত্তম হওয়ার পাথেয়সমূহ। সৈয়দ আবুল মকসুদের এই অন্বেষণের গুরুত্ব বোঝা যায় গবেষণা লব্ধ বিষয়ের ব্যক্তি ও বিষয় নির্বাচনের মধ্যে। এক্ষেত্রে স্বল্প পরিসরের এ লেখায় আমরা উনার একটা বিষয়কে অবলোকন করে পর্যালোচনা করতে পারি দরদী মনের আধার ও  আধেয়।

'নবাব সলিমুল্লাহ ও তার সময়' নিয়ে তিনি একটা বই লিখেছেন। নবাব স্যর খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুর সর্বজনে নবাব সলিমুল্লাহ নামে পরিচিত। নবাব সলিমুল্লাহ সন্দেহাতীতভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্র। কিন্তু তাঁকে নিয়ে আমাদের তেমন কোন আলোচনা তো নেইই, উপরন্তু তাঁকে বানানো হয়েছে খলনায়ক। অথবা এই ধারণা সাধারণে এবং বিদ্বৎসমাজের মধ্যে চাউর রয়েছে যে, তাঁকে নিয়ে আলোচনা না করায় উত্তম।

সৈয়দ আবুল মকসুদের গবেষণা থেকে আমরা নিশ্চিত করে জানতে পারছি যে, তিনি বাঙালি মুসলিম রাজনীতির জনক। ব্রিটিশ ভারতে তিনি আত্মবিস্মৃত ও অবহেলিত এ জাতিকে সর্বভারতীয় রাজনীতির মূলধারার সঙ্গে যুক্ত করেন। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের শিক্ষা বিস্তারে একজন নবাব সলিমুল্লাহর ভূমিকা আক্ষরিক অর্থেই তুলনারহিত। তিনি উপমহাদেশের দ্বিতীয় রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা। এক্ষণে আমাদের স্মরণে নেয়া দরকার উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্রিটিশদের প্রযত্নে ও ছত্রছায়ায়। কিন্তু মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে। নবাব সলিমুল্লাহকে নিয়ে তর্ক করার কিছু জায়গায়ও রয়েছে। সৈয়দ আবুল মকসুদ সেগুলোকে উপেক্ষা করেন নাই। বরং সেই তর্ককে হাজির করেই নবাব সলিমুল্লাহর অবদানের মাহাত্ম্য অন্বেষণ করেছেনে। এই মাহাত্ম্য আমাদের জন্য সবিশেষ গৌরবের ধন। জাতি হিসেবে বাঙালি মুসলমানের দাঁড়াবার শক্তি।

সৈয়দ আবুল মকসুদ যথার্থই বলেছেন : 'যত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী ও বাঙালি মুসলমান বিদ্বৎসমাজ স্যার সলিমুল্লাহর রাজনৈতিক চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য বা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করতে না পারবেন, তত দিন নোঙরহীন লক্ষ্যভ্রষ্ট নৌকার জাতি ঘুরপাক খাবে- কোনো স্থির লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রনেতাদের ভুলে গেলে চলবে না যে একই ভাষাভাষী হলেও 'বাংলাদেশ' কখনো পশ্চিমবঙ্গের মতো হবে না। বাংলাদেশের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের বিষয়টি শাসকশ্রেণির বিবেচনায় রাখতে হবে।'

বাংলাদেশের এই বৈশিষ্ট্যের কথা আরও আগে স্মরণ করিয়েছেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী। তিনি ১৯৬৬ সালে 'পূর্ববঙ্গের সমস্যা' প্রবন্ধে সেদিনের পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের স্বতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাসের সত্যতো এটাই সেই স্বতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই ১৯৭১ এ পূর্ববঙ্গ 'বাংলাদেশ' নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে।

আজকের বাংলাদেশের সর্বৈব উন্নয়ন ও জ্ঞানে বিজ্ঞানে অগ্রগমন চেয়েছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ। তার জীবন, সময় ও অবদানকে বুঝতে হবে আমাদের বৃহত্তর স্বার্থেই। সীমাবদ্ধতাকেও মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করতে হবে। নবাব সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন নিজের ভাগ্যেন্নয়নের জন্য নয়। দেশ ও জাতির ভাগ্যেন্নয়নের জন্য। অবহেলা ও বঞ্চনা পুষিয়ে নেয়ার জন্য, ন্যায্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। সেই আলোচনাও আমাদেরকে করতে ইতিহাসের দীর্ঘরেখা ধরে। ইতিহাসকে যত স্বল্প আলো ও সংকীর্ণ রেখায়  দেখা হয় তত তাতে ভুল বোঝাবুঝি ও ভুল ব্যাখ্যার ঝুঁকি থাকে। এ কারণে এটাও বুঝতে হবে যারা ১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করল, ১৯৪৭ এ তারাই কেনবা বঙ্গভাগকে উসকিয়ে দিল। এসবের প্রেক্ষাপটে সৈয়দ আবুল মকসুদের নবাব সলিমুল্লাহ অবলোকন বিশেষ গুরুত্ববহ ও তাৎপর্য পূর্ণ গবেষণা। যার মধ্যে দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে উনার দরদী মন ও দেশ-জাতি হিতৈষণার স্বরূপ ও সাধনা।  

Comments

The Daily Star  | English
health reform

Priorities for Bangladesh’s health sector

Crucial steps are needed in the health sector for lasting change.

15h ago