মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম

আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, বীর বিক্রমের বীরত্বগাঁথা)

আমীন আহম্মেদ চৌধুরী  ছিলেন অষ্টম  ইস্ট বেঙ্গলের আলফা কোম্পানির কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য তাকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তার সনদ নম্বর ৭।  

১৯৭১ সালে আমীন আহম্মেদ চৌধুরী চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ সময় তার পদবী ছিল ক্যাপ্টেন।

২৪ মার্চ সকালে ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদের কাছে একটি ফোন আসে। ফোনে বলা হয়, করাচিতে সিভিল অ্যাভিয়েশনের অধীনে বিমান চালনার প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য তাকে ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে হাজির হতে হবে। ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদারকে নেওয়ার জন্য যে হেলিকপ্টারে পাঠানো হয়েছে, ওই হেলিকপ্টারে করেই যেন ক্যাপ্টেন আমীন ঢাকা যান।

পূর্ব পাকিস্তানে সবচেয়ে সিনিয়র বাঙালি অফিসার ব্রিগেডিয়ার এম.আর মজুমদারকে ঢাকায় আনার জন্য চট্টগ্রামে হেলিকপ্টার পাঠানো হয়েছিল।  উদ্দেশ্য ছিল, তিনি জয়দেবপুরে অবস্থানকারী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের বাঙালি সেনাদের উদ্দেশে উপদেশমূলক বক্তব্য দেবেন,  ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের কমান্ডের ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে যোগ দিবেন।

কিন্তু পরিস্থিতি সুবিধাজনক মনে না হওয়ায় ক্যাপ্টেন আমীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম.আর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম এবং মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এ সময় তিনি যোগাযোগের জন্য তার মামার বাসার টেলিফোন নম্বর এবং যোগাযোগের ঠিকানাও দেন।

২৪ মার্চ সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকায় পৌঁছান ক্যাপ্টেন আমীন ও ব্রিগেডিয়ার মজুমদার।

বিমানবন্দর থেকে সোজা গুলশানে মামার বাসায় চলে যান ক্যাপ্টেন আমীন। পরদিন  ২৫ মার্চ সকালে এয়ারফোর্স মেডিকেল বোর্ডে গেলে তাকে বিশ্রাম নিয়ে ২৭ মার্চ সকালে রিপোর্ট দিতে বলা হয়। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে খারাপ দিকে চলে গেলে এদিন সকাল ১০টার দিকে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের নির্দেশক্রমে ডাকসুতে গিয়ে একটি প্রতিবাদী লিফলেট ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান ক্যাপ্টেন আমীন।  লিফলেটটিতে সামরিক প্রশাসনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু প্রতিবাদী কথা ছিল। 

এদিন দুপুর ২টার দিকে চট্টগ্রামের ইবিআরসিতে কর্নেল এম.আর চৌধুরীকে ফোন করে ব্রিগেডিয়ার চৌধুরীর আদেশে লাল ফিতা উড়িয়ে দেওয়ার কথা বললেন ক্যাপ্টেন আমীন। পরদিন ২৬ মার্চ কারফিউর মধ্যেই ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে পৌঁছে মার্কিন কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাডকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান তিনি।

২৯ মার্চ সকালে মোটরসাইকেলে করে কুমিল্লা-ফেনী হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছান ক্যাপ্টেন আমীন। ৩১ মার্চ আগরতলার বিএসএফ হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। পরে ৩ এপ্রিল তাকে আগরতলা থেকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কয়েকদিন জিজ্ঞাসাবাদের পর ভুলবশত 'পাকিস্তানি চর' সন্দেহে তাকে  ২ মাস কারাগারে আটকে রাখা হয়।

পরে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলেন ৭ জুলাই মুক্তি পান তিনি। প্রথমে মেজর খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেও, জেড ফোর্সের অধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমানের অনুরোধে ৯ জুলাই জেড ফোর্সের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ছিল শেরপুরের ঝিনাইগাতির ৩ আগস্টের নকশী বিওপির যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আলফা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে অংশ নিয়ে অসামান্য বীরত্ব দেখিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী।

নকশী বিওপিতে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের অধীনে এক প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা ও ২ প্লাটুন রাজাকার। জেড ফোর্স গঠনের পর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলকে দুর্ভেদ্য এই নকশী বিওপি দখলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই অনুযায়ী ৩১ জুলাই থেকে ২ আগস্টের মাঝে  ৩ দফা রেকি শেষে ৩ আগস্ট দিবাগত রাত ৩টা ৪৫ মিনিটে নকশী বিওপি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ওই রাতে নির্ধারিত সময়ে আর্টিলারি ফায়ারের মাধ্যমে শুরু হয় আক্রমণ। যুদ্ধের প্রথমেই পাকিস্তানিদের ছোড়া আর্টিলারির ৩টি শেল মুক্তিবাহিনীর এফইউপিতে এসে পড়লে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হন। তীব্র গোলাগুলির মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা এক্সটেনডেন্ট লাইনের সামনে এগোলে ক্যাপ্টেন আমীন মর্টার গ্রুপকে নালার আড়াল থেকে গোলাবর্ষণ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু স্বল্প প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা নালার আড়াল থেকে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে ফায়ার করতে শুরু করলে ক্যাপ্টেন আমীন চিৎকার করতে করতে তাদের এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি 'চার্জ' বলে আদেশ দিতেই মুক্তিযোদ্ধারা সরাসরি বিওপি আক্রমণের জন্য দৌড়াতে শুরু করেন।  

বিওপির ১০০ গজের মধ্যে পৌঁছতেই একটি আর্টিলারি শেল তাদের ওপর পড়ে। এতে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। তখন মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। বিওপির ৫০ গজের মধ্যে পৌঁছতেই ক্যাপ্টেন আমীনের পায়ে শেলের একটি টুকরো আঘাত হানে। কিন্তু পিছু না হটে গুলি চালাতে গেলে তার পায়ে বাঁশের কঞ্চি ঢুকে যায়। পড়ে যান তিনি। এ সময় এক পাকিস্তানি সেনারা তাকে হত্যার জন্য এগিয়ে আসতে গেলে এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা গুলি করে হত্যা করেন সেই সেনাকে।

এরমধ্যেও অপ্রতিরোধ্য ক্যাপ্টেন আমীন গুলি চালাতে গেলে আচমকা মর্টার শেলের আঘাতে তার পাশের মাটি উড়ে যায়। ডান হাতের কনুইয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি, হাত থেকে পড়ে যায় স্টেনগান। বিওপির বাংকারে যে মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকেছিলেন, প্রায় সবাই ততক্ষণে শহীদ হয়েছেন।

বৃষ্টির মতো গোলাগুলিতে বিওপি তখন মরদেহে পূর্ণ। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন আমীন দেখলেন, পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে আসছে। মুক্তিযোদ্ধারা কেউ নেই। পাকিস্তানি সেনারা তার ৫০ গজের মধ্যে আসতেই তিনি একটি গর্তে আশ্রয় নিলেন। ততক্ষণে সবাই ভেবেছে তিনি শহীদ।

পরে গর্ত থেকে উদ্ধার করে তাকে কাঁধে উঠিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া হয়। তুরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। কিন্তু সেখানে অবস্থার দ্রুত অবনতি হওয়ায় হেলিকপ্টারে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গৌহাটি হাসপাতালে। সেখানে অপারেশন ও নিবিড় চিকিৎসার পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লক্ষ্ণৌর  হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশ স্বাধীন পর্যন্ত সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন আমীন আহম্মদ চৌধুরী, বীর বিক্রম।

আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার আনন্দপুর গ্রামে। বাবার চাকরির সুবাদে তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ময়মনসিংহ শহরে। ১৯৬১ সালে মেট্রিক এবং ১৯৬৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে স্নাতকে ভর্তি হন আমীন আহম্মেদ চৌধুরী।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার কোর্সে যোগ দেন তিনি। মাত্র দেড় বছরের মাথায় ১৯৬৬ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে কমিশন লাভ করেন। পরে তাকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলে পাঠানো হয়। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার অপরাধে  ১৯৭১ সালের ১৬ জুন আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর পরিবারের ৯ জনকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের পর উন্নত চিকিৎসার  জন্য পূর্ব জার্মানিতে পাঠানো হয় আমীন আহম্মদ চৌধুরীকে। কর্মজীবনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসে মিলিটারি অ্যাটাশে, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের পরিচালক, চা বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন তিনি। ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন।

১৯৯৫-২০০২ সাল পর্যন্ত ওমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায়  প্রথম বিদেশি কূটনীতিক হিসেবে ওমানের বাদশাহ তাকে 'এ.এল.এন.ইউ.এম.এ.এন' পদকে ভূষিত করেন। বাংলাদেশে প্রথম সাফ গেমস আয়োজনে তার ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। ২০০০ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন তিনি।  ২০১৩ সালের ১৯ এপ্রিল শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, বীর বিক্রম।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্রিগেড ভিত্তিক ইতিহাস

১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন/ আমীন আহম্মেদ চৌধুরী

 

ahmadistiak1952@gmail.com

 

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

15h ago