বই

আত্মজীবনীতে ইতিহাসের নতুন ইঙ্গিত

অনন্য এক আত্মজীবনী। প্রাঞ্জল, সাদাসিধে, ঝরঝরে, মনে রাখার মতো, টানটান উত্তেজনার এক জীবন কাহিনী। যে কাহিনীর মোড়ে মোড়ে রোমাঞ্চ, যুদ্ধদিনে মৃত্যুর হাতছানি, ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণের নির্জলা বর্ণনা আর ব্যতিক্রমী বিশ্লেষণ। লেখক সাবেক সেনা কর্মকর্তা, একজন রাজনীতিবিদ। কিন্তু লেখক হিসেবে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন ষোলআনা। 

`সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর' বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামরিক ইতিহাসের এক বিশেষ সংযোজন। জীবন্ত, যৌক্তিক ও প্রাণবন্ত দলিল। হাফিজ উদ্দিন আদমদ বীর বিক্রম তাঁর জীবন কাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর উপর আলোকপাত করেছেন। একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ক্যু ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ। যা এই ঘটনার অনেক অন্ধকার অংশের উপর নতুন করে আলো ফেলেছে। ইতিহাসে বহু বিতর্কিত, বহুল চর্চিত ও অলিখিত এই অধ্যায়ের অজানা তথ্য জানতে বইটি হাতে নেওয়া যেতে পারে। 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা, নভেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভেঙ্গে পড়া চেইন অব কমান্ড পুনরুদ্ধারের চেষ্টার ঘটনা প্রবাহ নিয়ে এই বই। এরসাথে আছে লেখকের খেলোয়াড় থেকে সামরিক অফিসার হওয়ার প্রাণবন্ত কাহিনী। লেখক বইটির প্রথম অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন জীবনের প্রথম প্রহর, দ্বিতীয় অধ্যায় বাঙালির মহাজাগরণ আর তৃতীয় ও শেষ অধ্যায়ের নাম রক্তাক্ত পঁচাত্তর। 

দক্ষিণের সমৃদ্ধ জনপদ, বাংলার ভেনিস নামে পরিচিত বরিশাল থেকে খেলা পাগল এক তরুণ কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলেন তার বর্ণনা পাওয়া যায় প্রথম অধ্যায়ে। জাতীয় খেলোয়াড়দের আখড়া হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ ও খেলাপাগল বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. নিউম্যানকে নিয়ে লেখকের বর্ণনা আলাদা দৃষ্টি কাড়ে। এরপর পাকিস্তান জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলার রোমাঞ্চকর অধ্যায় । তারপর আর্মি এডুকেশান কোরের মাধ্যমে সেনাজীবনে প্রবেশ। এই ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনায় লেখক তুলে ধরেছেন ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফা ও বাঙালির জাগরণের নানা খ- চিত্র। সরল, সবালীল বর্ণনা যা একজন পাঠককে মুগ্ধ করবে। 

এরপরের অংশে রণাঙ্গনের রোমাঞ্চকর ঘটনাপ্রবাহ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা, চট্টগ্রামে যে নারকীয় তাণ্ডব চালায় সে খবর লেখকের কর্মস্থল যশোর সেনানিবাসে পৌঁছায় বেশ দেরিতে। ৩০ মার্চ ১৯৭১ ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার ঘোষণা দেয় পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ। পাকিস্তানিদের এই আদেশ অমান্য করে অস্ত্র তুলে নেয় বাংলার জওয়ানরা। অস্ত্রাগার ভেঙ্গে হাতিয়ার নিয়ে পাঞ্জাবি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির উপর গুলি বর্ষণ শুরু হয়। তারাও প্রস্তুত ছিল। কারণ এরইমধ্যেই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চারটি ইউনিট বিদ্রোহ করেছে। সে খবর তাদের অজানা ছিল না। এখানে এক খণ্ড যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতেই লেখক মেজর হাফিজ বিদ্রোহ করে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। খণ্ড যুদ্ধ শেষে কৌশলগত কারণে তাঁদের পিছু হটতে হয়। এ যুদ্ধে শহীদ হন লে. আনোয়ার। তবে এই মৃত্যু তাঁদের দমাতে পারেনি। ২০০ সৈনিক আর ৯ জন জেসিও মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে নতুন করে শপথ নেন। 

এরপর লেখক পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন মুজিবনগর সরকার গঠন ও কয়েকটি খ-যুদ্ধের চিত্র। যার মধ্যে অন্যতম কাগজপুকুরের যুদ্ধ। যে যুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছিলেন হাবিলদার মুজিবুর রহমান। যাকে পরে মরণোত্তর বীর উত্তম খেতাব দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধদিনের ঘটনা প্রবাহে লেখক অনেক বীর যোদ্ধার বীরত্বের বর্ণনা দিয়েছেন। তুলে ধরেছেন যুদ্ধের নানা ঘটনাপ্রবাহ। এতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতার ঘটনা যেমন আছে তেমন আছে যুদ্ধ কৌশল নিয়ে কিছু যৌক্তিক সমালোচনাও। এরপর পাঠকের সামনে লেখক তুলে ধরেছেন সিলেট অঞ্চলে পরিচালিত সম্মুখ যুদ্ধের অজানা গল্প। ততোদিনে যুদ্ধ অনেক পরিণত। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বেড়েছে। পাওয়া যাচ্ছিল ভারতীয়দের পর্যাপ্ত সহযোগিতা। যুদ্ধ দিনের এই ঘটনাপ্রবাহে ক্যাপ্টেন মাহবুব ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের শহীদ হওয়ার ঘটনা পাঠকদের হৃদয়ে দাগ কাটবে। 

যুদ্ধ জয়, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা ঘটনার পর বইটিতে পাওয়া যায় রাজনৈতিক জটিল আবর্তের চিত্র। লেখক তখন স্বাধীন বাংলাদেশের গর্বিত সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট ৪৬-তম বিগ্রেডে কর্মরত। যার কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল। কমান্ডার শাফায়াত জামিলের কমান্ডকে পাশ কাটিয়ে মেজর রশিদ ও ফারুক গং ১৫ আগস্ট ভোরে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করার পর ২য় ফিল্ডের সিও মেজর রশিদ লেখক ও কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে হত্যার কথা জানায়। এরপর ঘটতে থাকে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা। আকস্মিক ঘটনায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কে কেমন আচরণ করছেন তা সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী ১৫ আগস্টের পর অনেকেই উচ্ছ্বসিত হলেও অসন্তুষ্ট ছিলেন ৪৬-ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল। যেহেতু শাফায়াত জামিলের কমান্ড অমান্য করে খুনীরা অভিযান চালায় সে কারণে তিনি প্রচ- ক্ষুব্ধ ছিলেন। পরের দিকে খুনীরা সেনাকমান্ডে না ফিরে বঙ্গভবনে অবস্থান করলে শাফায়াতের ক্ষোভ আরও পুঞ্জীভূত হয়। যার প্রেক্ষাপটে আসে ৩ নভেম্বর। 

খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানে লেখক ছিলেন একজন সক্রিয় সদস্য। বিদ্রোহীদের সেনা কমান্ডে ফেরানোর এই চেষ্টার মূল নায়ক ছিলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল। তিনি সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে খুনীচক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু জিয়া ছিলেন দোদুল্যমান। কারণ জিয়াকে খুনীচক্রই সেনাপ্রধান নিয়োগ করেছে। তাই তিনি খুনীদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হলেও ব্যবস্থা নিতে আরও সময় চাচ্ছিলেন। বিদ্রোহী অফিসারদের ঔদ্ধত্য সব সীমা অতিক্রম করলে একপর্যায়ে সিজিএস খালেদ মোশাররফ শাফায়াত জামিলকে এ্যাকশান নেওয়ার অনুরোধ করেন। এই প্রচেষ্টাতে ৭২-তম ব্রিগেড কামান্ডার নাজমুল হুদা ও রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান সহযোগিতা করতে সম্মত হন। এই অভিযানে তাঁরা বিমান বাহিনীকেও যুক্ত করেন। ফারুকের ট্যাঙ্ক বাহিনীকে কাবু করতে তাঁরা যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার উড়াতে সম্মত হয়েছিলেন। 

পরিকল্পনা অনুযায়ী অভিযান পরিচালিত হয়। যাতে কার্যকর ভূমিকা রাখেন বিমানবাহিনীর কয়েকজন অফিসার। প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়। দিনভর নানা আলোচনার পর খুনীচক্রকে ব্যাংককে পাঠানো সিদ্ধান্ত আসে। রাত ১১ টার দিকে তাদের বহনকারী বিমানটি ঢাকা ছেড়ে যায়। এদিকে ২ নভেম্বর মধ্যরাতে (সময়ের হিসেবে ৩ নভেম্বর) ১৫ আগস্টের বিদ্রোহীরা রিসাদলদার মোসলেমের নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র সেনাদল কেন্দ্রিয় কারাগারে পাঠায়। প্রথমে জেলখানায় ঢুকতে বাধা পেলেও পরে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে তাদের জেলখানার ভেতরে ঢুকতে  দেওয়া হয়। ভেতরে ঢুকে ফারুকের নেতৃত্বাধীন ল্যান্সারের সৈনিকরা নির্মমভাবে হত্যা করে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে। লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী, খন্দকার মোশতাকের নির্দেশেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হয়েছিল, টেলিফোনে তিনিই নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৩ নভেম্বর সারাদিন যে বিষয়ে কোনো কিছুই জানতে পারেননি খালেদ ও অন্যান্যরা। এদিকে ক্ষমতার দুই কেন্দ্র সেনানিবাস ও বঙ্গভবনের মধ্যে তখন চলতে থাকে ম্যারাথন আলোচনা। 

অন্যদিকে ৫ নভেম্বর পত্রিকায় প্রকাশিত এক ছবি খালেদ মোশাররফকে চূড়ান্ত বিপদে ফেলে দেয়। অন্যদিকে সক্রিয় হয়ে ওঠে কর্নেল (অব.) অবু তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। ৫ নভেম্বর এই সংস্থাটি সেনানিবাসের বিভিন্ন অংশে ১২-দফা দাবি সংবলিত প্রচারপত্র বিলি করে। এদিকে নানা ঘটনাপ্রবাহে খালেদ মোশাররফ এরইমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছেন রুশ-ভারতের দালাল হিসেবে। ঘটনাবহুল ৬ নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম শপথ নেন। এদিকে বিভিন্ন প্রচারপত্রে বিভ্রান্ত সৈনিকরা। ঐ দিনই পাল্টা বিদ্রোহের খবর পান মেজর হাফিজ। যা তিনি তাঁর কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে জানান। ঐ রাতেই পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘঠিত হয়। মেজর হাফিজ বলছেন, 

"দূর থেকে মিলিত কণ্ঠে স্লোগান ভেসে এল, 'সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই'। পাশ্ববর্তী সাপ্লাই কোর এবং নৌ বাহিনীর একটি সংস্থা থেকে মাইকে স্লোগানের শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম? স্বাধীন দেশের সামরিক বাহিনীতে সিপাহী বিদ্রোহ, অফিসারের রক্ত চায় তারা! " (পৃষ্ঠা;২২১) 

পাল্টা বিদ্রোহের রাতে মেজর হাফিজ অবস্থান করছিলেনর তাঁর ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের দফতরে। অন্যদিকে বঙ্গভবনে ছিলেন খালেদ মোশাররফ, হায়দার ও হুদা। পাল্টা বিদ্রোহের খবর পেয়ে তাঁরা বঙ্গভবন থেকে বেরিয়ে পড়েন। পরে এক আত্মীয়ের বাসায় পোশাক পাল্টে খালেদ-হুদা-হায়দার আশ্রয় নেন ১০ বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এটি ছিল খালেদ মোশাররফের বিশ্বস্ত সেনা ইউনিট।  

৭ নভেম্বর সকালে এই ১০ বেঙ্গলেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম মহানায়ক খালেদ মোশাররফ ও অন্য দুই বীর যোদ্ধা হুদা ও হায়দারকে হত্যা করা হয়। তাঁদেরকে কারা হত্যা করলো ইতিহাসে তা আজও পরিষ্কার নয়। তবে এই গ্রন্থের লেখক মেজর হাফিজ দাবি করেছেন, ক্যাপ্টেন জলিল একদল উত্তেজিত সেনাকে নেতৃত্ব দিয়ে এই তিন বীর যোদ্ধাকে হত্যা করেন। বইটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে অসমর্থিত সূত্রে জানা যায়, সেনানিবাস থেকে একজন অফিসার ফোন করে সেনাদের উত্তেজিত করেছিলেন। লেখক মীর শওকতের দিকে ইঙ্গিত করেছেন।  মেজর হাফিজ উদ্দীন আহমদ বীর বিক্রম খালেদ-হুদা-হায়দার নিয়ে যে তথ্য তুলে ধরেছেন তা অনেক নতুন, ইঙ্গিতবহ। যা পাঠককে চিন্তার খোরাক জোগাবে।

Comments

The Daily Star  | English

Govt forms new Election Commission

The new EC will be led by former secretary AMM Nasir Uddin

11m ago