বাংলা একাডেমিতে রাষ্ট্রীয় বা দলীয় নিয়ন্ত্রণ আর হবে না : মোহাম্মদ আজম
প্রাবন্ধিক ও গবেষক মোহাম্মদ আজমের জন্ম ২৩ আগস্ট ১৯৭৫ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন দুই মাস। পিএইচডি করেছেন ভাষার ইতিহাসের বিশেষ দিক নিয়ে। প্রকাশিত বই বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ, বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার, সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। সম্পাদনা করছেন প্রবন্ধের কাগজ তত্ত্বতালাশ। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে বাংলা একাডেমি নিয়ে ব্যস্ততা, নতুন পরিকল্পনা, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সংস্কার, ফেলো- সদস্যদের নির্বাচন, বইমেলাসহ নানান বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।
দ্য ডেইলি স্টার : বাংলা একাডেমির দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস। এ কর্মব্যস্ততা আপনার লেখালেখি গবেষণায় প্রভাব পড়েছে?
মোহাম্মদ আজম : অবশ্যই ব্যাঘাত ঘটেছে। আগে সপ্তাহে কাজ করতাম ১০ ঘণ্টা আর এখানে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা। আগের যে জীবন সে জীবন নাই। বাংলা একাডেমির সাংগঠনিক কাঠামো এমন যে, যেখানে যে কারও জীবন বিপর্যস্ত হতে বাধ্য।
তার মানে গবেষক হিসেবে না, পুরোপুরো আমলার জীবন এখন?
মোহাম্মদ আজম : না, বিষয়টি এমন না। লেখক গবেষক ব্যাপারটা তো আর ভুলে যাইনি। বাংলা একাডেমির কাজ আর আমার গবেষণা- খুব আলাদা নয়। নতুন কাজের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে সময় লাগবে। এর মাঝে কিছু ছোট ছোট লেখা লিখতে পারছি, বড় লেখা হচ্ছে না।
আপনার অনেক শিক্ষকরা এই পদে ছিলেন। যাদের অভিজ্ঞতা ছিল অনেক। সে হিসেবে আপনি নবীন। চাপ অনুভব করেন?
মোহাম্মদ আজম : না। কারণ আগের সেই পরিস্থিতি নাই, পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় বাংলা একাডেমির কাজের যে ক্ষমতা সেটা সে সময় অনেক প্রতিষ্ঠানের ছিল না। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন সারা পৃথিবীতে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত। বেড়েছে কাজের সুবিধা ও সুযোগ। ধরা যাক একটা গবেষণার বই বের হবে। ৩০-৪০ বছর আগে এটা শুধু বাংলা একাডেমির পক্ষে সম্ভব ছিল। আর হয়তো ২-৩টি প্রকাশনীর ছিল। এখন অন্তত ১০০ প্রকাশনী আছে যে, সে কাজ করতে পারবে। ফলে আমাদের যে বিখ্যাত শিক্ষকরা ছিলেন আর এখন একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে আমি এসেছি সেটাকে মিলিয়ে দেখিনি।
কিন্তু যেটা আবিষ্কার করলাম সেটা হলো যে দেশের মানুষের কাছে বাংলা একাডেমি অনন্য মর্যাদার প্রতিষ্ঠান। যেটা বাইরে থেকে কখনো বুঝতে পারিনি। মানে এর সিম্বলিক ভ্যালু অনেক। মানুষ সামাজিকভাবে আমায় বেশি মূল্য দিচ্ছে। মানুষের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে এর সম্মান এবং সামাজিক মূল্যের ব্যাপার রয়েছে। হয়তো একাডেমি অতটা সমাজকে দিতে পারে নাই। তবু মানুষ তার প্রতীকী মূল্যটা দিচ্ছে।
সেই মূল্যে অনেক আয়োজনে আপনার উপস্থিতি অধিক দেখা যায়? অথচ এখন একাডেমির অনেক কাজ। ব্যাঘাত ঘটবে কাজে?
মোহাম্মদ আজম : অধিক বলতে কয়টায়কে বুঝায়, কোনো হিসাব আছে? কয়টা অনুষ্ঠানে গেলে কম, কয়টায় গেলে বেশি- কে বলতে পারবে? আমি মনে করি না প্রাসঙ্গিক অনুষ্ঠানে গেলে বাংলা একাডেমির কাজের কোনো ব্যাঘাত ঘটবে।
অসংখ্যা মানুষের ত্যাগ, ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নিয়েছেন। প্রসঙ্গে একাডেমি সংস্কারে কথা বলছেন অনেকে, আপনি কী ভাবছেন?
মোহাম্মদ আজম : অবশ্যই এটা বিশেষ সময়। সংস্কার ব্যাপারটা আমার কাছে রাষ্ট্রের মতোই সহজ। ছাত্রজনতার যে অভ্যুত্থান এই অভ্যুত্থানের অর্থ বুঝি আত্মদান বা আত্মত্যাগ। ব্যাপারটা একটা ভালো বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত। ভালো বাংলাদেশ কী? ভালো বাংলাদেশের সংজ্ঞা একটাই। অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। ওই উন্নতি হবে, এই করব, সেই করব- এটা আসলে সময় এবং যারা দায়িত্বশীল তাদের উপর নির্ভর করে।
এখন অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিক যদি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই হবে। প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেখতে হবে পরিবর্তনে, চরিত্র অনুসারে কাঠামো ঠিকমত কাজ করছে কিনা। এরকম একটা প্রতিষ্ঠান আমরা চাই। বাংলা একাডেমি কোনো মতাদর্শিকভাবে চালিত, রাষ্ট্রীয় বা দলীয় নিয়ন্ত্রণ একাডেমিতে আর হবে না। এর একমাত্র কারণ জুলাই গণঅভ্যুত্থান। অন্য সময় এলে এমন চিন্তা করতে পারতাম না। স্বপ্নটা দেখছি একাডেমির কাঠামোগত পরিবর্তন। যে কাঠামোতে একাডেমি একাডেমির মতো কাজ করতে পারবে বছরের পর বছর।
প্রতিষ্ঠান চালানোর অভিজ্ঞতা সেই অর্থে নেই। অথচ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক। ফলে একাডেমি নিয়ে স্বপ্নের পথ কতটা চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন?
মোহাম্মদ আজম : প্রতিষ্ঠান যেরকম তার কাঠামোগত বিস্তৃতও সেরকমই থাকে। ব্যক্তিগতভাবে কোনো বিশেষ চ্যালেঞ্জ বোধ করিনি। কারণ এখানে অনেক জনশক্তি এবং একটা ট্র্যাডিশন রয়েছে। একাডেম নিজে কী করতে পারে, একাডেমির কাছে লোকে কী চায়, তার একটা অভিজ্ঞতা আছে। ফলে ব্যাপারটা নতুন না। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা হিসেবে নতুন এবং অকল্পনীয়।
প্রসঙ্গে দুটো কথা বলব। একটা কথা হলো যে অনেকেই জানে না যে বাংলা একাডেমি আইনগত এবং কাঠামোগতভাবে যা যা করতে পারে তার পরিমাণ বিপুল। ফলে বন্ধু-বান্ধব কিংবা যারা আমাকে চেনে বা চেনে না এমন লোকেরা যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে সেগুলো নতুন মনে হয়নি। যা বাংলা একাডেমির রেগুলার কাজ এবং এগুলো করার মতো যথেষ্ট সক্ষমতাও আছে। হয়তো আমাদের জনগোষ্ঠি এর ফলাফল দেখতে পায়নি। কারণ দেশে যখন একটা রাজনৈতিক সরকার দীর্ঘদিন থাকে, তখন তারা এই ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো দিয়ে সরকার এবং দলের অনেক কিছু করিয়ে নিতে চায়। আমার বিবেচনায় গত ১০ বছরে সে অপর্কমের ধারা তুঙ্গে পৌঁছেছিল। বিশেষত করে বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ উদযাপন, বাংলাদেশের ৫০ বছর উপলক্ষে রাষ্ট্রীয়, দলীয় এবং মতাদর্শিক ব্যাপক কাজের চাপ বাংলা একাডেমিকে সহ্য করতে হয়েছে।
তাতে প্রাত্যহিক অনেক কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন যেহেতু এই ব্যাপারগুলো নাই, ফলে আমরা যদি সাধারণ কাজগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে করতে পারি তাহলে বিপুল কাজ হবে। কিন্তু নিশ্চয়ই লোকে আরও চাইবে এবং আমি মনে করি এটার সুযোগও আছে। সরকারেরও সদিচ্ছা আছে এবং আমরাও নতুন ধরনের পরিকল্পনায় কাজ করতে পারব।
আগামী ছয় মাসে বা এক বছরে কী কী কাজ করবেন? মানে কোনো পরিকল্পনা করেছেন?
মোহাম্মদ আজম : হ্যাঁ, করেছি পরিকল্পনা। তার জন্য আমাকে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নাই। দুটি পরিকল্পনা বলি- যেটা আগে কখনো বাংলাতে হয় নাই কিংবা কম হয়েছে। এই বিষয়ে শিগগির পাবলিক বিজ্ঞাপনে যাব। এক, আমরা গবেষণা প্রবন্ধ লেখার জন্য বৃত্তি ঘোষণা করব। এটি ৫০জন পাবেন। যাদের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেব, একজন গাইড, লেখার এডিটর এবং প্রুফ রিডার দেব। এইভাবে সরকারি সহায়তায় বাংলা একাডেমির তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষায় বিচিত্র বিষয়ে প্রবন্ধ রচিত হবে। সেই প্রবন্ধের মালিকানা শুধু আমাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকারপূর্বক লেখদের থাকবে। বিজ্ঞপ্তিতে গবেষণা প্রবন্ধের জন্য আমরা প্রস্তাব চাইব।
একাডেমিতে সৃজনশীলদের যুক্ত করার পদ্ধতি এবং সুযোগ অপেক্ষাকৃত কম। কারণ একাডেমির প্রধানত কাজ গবেষণামূলক। যেমন, প্রথম কাজ ভাষা নিয়ে, দ্বিতীয় সংস্কৃতি, তৃতীয় সাহিত্য নিয়ে কিন্তু সাহিত্য রচনা না, চতুর্থত দেশে এবং বিদেশে সর্ব প্রকার বাংলা ভাষার চর্চা নিয়ে। তবে একাডেমির সঙ্গে সৃষ্টিশীল লেখকদের সম্পর্ক গভীর এবং কাছে নেওয়ার সুযোগও বেশ।
দুই হচ্ছে- একাডেমিতে এমনিতে এক বছরের ৩টি ফেলোশিপ আছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে ১০টা হবে।আগামী সপ্তাহে বিজ্ঞাপনে যাব। তার মানে আমাদের লক্ষ্য বাংলা একাডেমিকে বাংলা ভাষায় গবেষণার কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। প্রাথমিকভাবে কাজ শুরু করে দিয়েছি। আমাদের পরিচালনা পর্ষদও অনুমোদন করেছে।
তিন হচ্ছে- বাংলা একাডেমির সমস্ত প্রকাশনা এবং বিক্রয়যোগ্য বই- সবকিছু শতভাগ ডিজিটাইজ করব। এটা আমাদের বই প্রকাশ এবং বিক্রয়জনিত সেবাকে একটা স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে যাবে।
আমরা সমস্ত প্রকাশনা ইউনিকোডে চলে যাব এবং সমস্ত প্রকাশনা পুরোনো থেকে শুরু করে নতুন আমাদের যে আগের প্রকাশনা যেগুলো এভেইলেবল না, এগুলো ই-বুক করার উদ্যোগ নিয়েছি। নামমূল্যে পাবে পাঠক। তারপর করব বাংলা একাডেমির অভিধান এবং বানান অভিধান। এর বাইরে চরিতাভিধান এবং লেখক অভিধান।
আমরা খুবই সিস্টেমেটিক্যালি নতুন করে করব। যদিও কাজ শুরু করি নাই। এগুলো করতে একটু সময় লাগবে। কারণ একাডেমির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বড় দুটো পাবলিক প্রোগ্রাম একটা বার্ষিক সাধারণ সভা, দ্বিতীয়টা- একুশে বইমেলা। দুটো একেবারেই কাছাকাছি এসে গেছে।
এই ছাড়া আরও কিছু কাজ হবে। একাডেমির ইন্টার্নাল ট্রেনিং। তারপর প্রতিটি বিষয়ে অনুবাদ, গবেষণা পদ্ধতি, এডিটিং, প্রুফ রিডিং- এসব বিষয়ে আমরা জাতীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব।
অনেক কাজের পরিকল্পনা। উদ্যাগ বাস্তবায়নে একাডেমিতে কাজের লোক কেমন আছে?
মোহাম্মদ আজম : না, জনবলের সংকটে কাজ করা যাচ্ছে না এই কথা বলার সুযোগ নেই। উল্টো বলতে হবে বাড়তি আছে দুই একটি বিভাগে।
একাডেমির কিছু কর্মকর্তা কর্মচারী গণঅভ্যুত্থানের বিপক্ষে ছিল বলে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে। এই বিষয় কি পদক্ষেপ নেবেন?
মোহাম্মদ আজম : প্রথমত ব্যাপারটাকে প্রধানত আইনি দিক থেকে দেখছি। সেই প্রেক্ষিতে একটা কমিটিও গঠন করেছি। কেবল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিপক্ষে হিসেবে নয় আন্তঃঅফিসের সংকট নিয়েও যাদের ত্রুটি আছে তাদের বিষয়ে রিপোর্ট দেবে।
কয়জনের কমিটি, কবে রিপোর্ট পাবেন?
মোহাম্মদ আজম : এটা সরাসরি বলা যাচ্ছে না। দীর্ঘমেয়াদী কাজ। জুলাই পর্যবেক্ষণ এবং অফিসের অভিযোগগুলো আসবে। শুধু রাজনৈতিক অভিযোগ নয়, পুরো একাডেমির কর্মকাণ্ড সংক্রান্ত বিচিত্র ধরনের অভিযোগ কিংবা অনুযোগ আছে সব আসবে। তারপর ধীরে ধীরে সংস্কার হবে কাঠামো।
বাংলা একাডেমির যে চরিত্র সেই চরিত্রকে ফিরিয়ে আনতে উদ্যাগের ধরন কী আগের মতোই হবে? এজিএম বা বইমেলায় কোন নতুনত্ব থাকবে?
মোহাম্মদ আজম : এগুলো সম্পর্কে এখনো কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে আমরা পৌঁছাইনি। আরেকটু সময় লাগবে। নিশ্চয়ই কোনো কোনো দিক থেকে নতুনত্ব আসবে। কারণ কিছু নতুন মানুষ যুক্ত হবে। কিন্তু ঠিক এটা কোন লেভেলে যাবে সেটা বলার মতো সময় এখনো হয়নি।
একাডেমির বাজেটের কত শতাংশ গবেষণায় ব্যবহার হয়?
মোহাম্মদ আজম : প্রথম কথা হচ্ছে- এই নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি আছে। যেকোন প্রতিষ্ঠানের বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশ যায় বেতন ভাতায়। বেতন ভাতার অংশটা বাদ দিয়ে হিসাব করা দরকার।
দ্বিতীয় হচ্ছে- বাংলা একাডেমির প্রায় কাজই গবেষণামূলক। আমরা যখন একটা বই রিভিউ করাই সেটাও কিন্তু গবেষণার অংশ। কারণ আমরা প্রধানত গবেষণার বই প্রকাশ করি। আর বাংলা একাডেমি তো বিশ্ববিদ্যালয় না, যে পিএইচডি করাবে কিংবা টাকা দিয়ে গবেষণা করাবে। সুতরাং সরাসরি বলা যাবে না যে, গবেষণায় এত পার্সেন্ট।
মন্ত্রাণালয় সূত্রে জেনেছি একাডেমিই গবেষণায় বাজেট কম চায়। গত অর্থবছরে গবেষণায় চেয়েছেন ২০ লাখ, এই বছরে ২৫ লাখ। এর মানে কী?
মোহাম্মদ আজম : এই গবেষণা মানে সরাসরি 'ফেলোশিপ'। মাঠে গবেষণার বিষয়। ধরা যাক আমরা একটা গবেষণা পত্রিকা বের করছি বা অভিধান করছি এটা কিন্তু উল্লেখিত বাজেটে নেই। এইভাবে আমরা কমপক্ষে চার-পাঁচটা গবেষণাধর্মী পত্রিকা করি। এগুলো মূল বাজেট থেকে প্রকাশ হয়। আর ২৫ লাখ টাকায় গবেষণা বৃত্তিটাকে ফোকাস করা হবে।
একাডেমিতে একাডেমিক লোকের আনাগোনা বেশি। সৃজনশীল লেখকরা একাডেমির অংশীজন হতে পারে কতটা?
মোহাম্মদ আজম : একাডেমিতে সৃজনশীলদের যুক্ত করার পদ্ধতি এবং সুযোগ অপেক্ষাকৃত কম। কারণ একাডেমির প্রধানত কাজ গবেষণামূলক। যেমন, প্রথম কাজ ভাষা নিয়ে, দ্বিতীয় সংস্কৃতি, তৃতীয় সাহিত্য নিয়ে কিন্তু সাহিত্য রচনা না, চতুর্থত দেশে এবং বিদেশে সর্ব প্রকার বাংলা ভাষার চর্চা নিয়ে। তবে একাডেমির সঙ্গে সৃষ্টিশীল লেখকদের সম্পর্ক গভীর এবং কাছে নেওয়ার সুযোগও বেশ।অনেক বক্তৃতার আয়োজন হয় এবং সেখানে সৃষ্টিশীলরা যুক্ত থাকেন। ফেব্রুয়ারির আলোচনায় থাকেন এবং বইমেলায় তাদের বই প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হয় রচনাবলি।
ফেলো ও সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে নির্বাহী পরিষদ গঠনে আইন থাকলেও ২৫ বছর একাডেমিতে নির্বাচনই হয়নি। এইখানেও সৃজনশীলদের দূরে রাখা হয়েছে। নির্বাচন হবে কবে?
মোহাম্মদ আজম : আমাদের পরিকল্পনা আছে নির্বাচন দেওয়ার। আগে কেন হয় নাই জানি না। কিন্তু ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারির পর্ব পার হয়ে যাওয়ার পর আমরা এই বিষয়ে উদ্যোগ নেব। এখন খুব জরুরি এজিএম ও বইমেলা নিয়ে আগানো। এই নিয়ে ব্যস্ততা অনেক।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাংস্কৃতিক ভূমিকা বিশাল। অগ্রজ অনেক কবি লেখকদের পাশে না পেলেও তারুণ্যদের একটা অংশকে পেয়েছে ছাত্রজনতা। এই নিয়ে একাডেমির বিশেষ কোনো কাজ হবে কি?
মোহাম্মদ আজম : উত্তরাধিকার পত্রিকার একটা সংখ্যা করার পরিকল্পনা করেছি একটু বড় করে।গবেষণামূলক বই হয়তো হবে না। সে বিষয় সুযোগ অপেক্ষাকৃত সীমিত। নাই সেটা বলব না। বড় কিছু হলে আমরা হয়তো কোনো কোনো প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত হতে পারব।
সাহিত্য কাগজ কালের ধ্বনির উদ্যাগে গণঅভ্যুত্থানে আহত কবি লেখকদের নিয়ে অনুষ্ঠান হয়েছে। তাদের সামাজিক মর্যাদা বা পরিচিতির জন্য বাংলা একাডেমি কোনো আয়োজন হতে পারে?
মোহাম্মদ আজম : নিশ্চয়, একটা পরিকল্পনা নিতে পারি। এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবেও কাজ করার যে সুযোগ আছে। আহত কবি লেখকদের জন্য সামাজিক সম্মতি তৈরি করার একটা প্রোগ্রাম কিংবা তাদের রচনা পাঠের বন্দোবস্ত করতে পারি বাংলা একাডেমিতে।
শেখ মুজিবুর রহমান 'বঙ্গবন্ধু লেখক ট্রাস্ট' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে ট্রাস্টটি বিলুপ্ত হয়। জুলাই স্মরণে 'জুলাই কবি-লেখক ট্রাস্ট' করা যেতে পারে?
মোহাম্মদ আজম : এই বিষয়টা এখনো ভাবি নাই। তবে এখন এ ধরনের কাজ করার জন্য বাংলাদেশে প্রচুর প্রতিষ্ঠান আছে এবং সরকারের প্রচুর উদ্যোগ আছে।
একাডেমিতে একটা লেখক জাদুঘর আছে। কী আছে এতে, কারা আসে?
মোহাম্মদ আজম : এখানে লেখক জাদুঘর একটা নয়, একাধিক লেখকের নামে কক্ষ আছে। এতে ঐতিহাসিক অল্প কিছু উপাদান আছে। লেখকরা বা ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অনেক সময় এখানে এসেছেন। বর্ধমান হাউজের সঙ্গে তারা সম্পর্কিত। সেগুলো সংরক্ষণের জন্য এই উদ্যোগটা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে এই উদ্যোগটা প্রাথমিক এবং সিম্বলিক।
কবি আবদুল কাদির নিয়ে গবেষণা কক্ষ আছে প্রায় ১২ বছর। তার রচনাবলি বা জীবনী বের হয়নি আজ পর্যন্ত।
মোহাম্মদ আজম : তার নামে নামায়ন করা হয়েছে। ব্যাপারটা এমন নয়, সেখানে কোন গবেষণার বন্দোবস্ত আছে। আবদুল কাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিকভাবে তার অবদান রয়েছে। বাংলা একাডেমির সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব গভীর। আমরা তাকে নিয়ে উদ্যাগ নেব, আবার যে কেউ তাকে নিয়ে কাজের প্রস্তাব দিতে পারে।
একাডেমি থেকে ৬৫০০ বই প্রকাশিত। এখন দেড় হাজার বই পাওয়া যায়। অনেক বই একাডেমির লাইব্রেরিতেই পাওয়া যায় না। কেন?
মোহাম্মদ আজম : সব বই প্রকাশে সম্ভাবনা নেই হয়তো। সব বই বিক্রিও সেভাবে হবে না। দুষ্পাপ্য বা যেটা গুরুত্বপূর্ণ দেখে আবার প্রকাশ হবে। তবে সবগুলো বই পিডিএফ হবে, কাজ শুরু হবে দ্রুত। যে কেউ তা কিনতে পারবে নামমূল্যে।
একাডেমির বই সব জায়গায় পাওয়া যায় না? অনলাইনে অর্ডার করাও যায় না। বই বিক্রি নিয়ে প্ল্যান কী?
মোহাম্মদ আজম : পুরো বিক্রয় ব্যবস্থাপকে আমরা ডিজিটাইজ করব। অনলাইনেও সার্ভিস শুরু করব। অনলাইনে অর্ডার দিলে যে কোনো জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে পারবে ক্রেতা। সেটা আগামী ৬ মাসের মধ্যে হবে।
জাতীয় কবির রচনাবলিসহ গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো পেপারব্যাক বা শিক্ষার্থী কপি হতে পারে? তাহলে বই সব জায়গায় পৌঁছানো সহজ হবে।
মোহাম্মদ আজম : বাংলা একাডেমির বই যে কাগজে এবং যেভাবে বাঁধায়- সেটা খুবই মানসম্মত। দেখতে হয় বইয়ের মানের সঙ্গে খরচও যেন বেশি না হয়। তবু বাজারের তুলনায় বইয়ের দাম কম। হ্যাঁ, পেপার ব্যাক করলে কম দামে দিতে পারতাম। কিন্তু প্রিজারভেশন এবং লংজিবিটির ব্যাপারে চিন্তা করতে হয়। তবু ভেবে দেখব।
সরকার কি একাডেমি থেকে লাভ করে? দাম নিয়ে কেন ভাবতে হয়, ভর্তুক দিয়েই ত চলে প্রকল্প।
মোহাম্মদ আজম : না পুরো বিষয়টা ভর্তুকি তা ঠিক নয়। কারণ একাডেমির উপার্জনের ভিত্তিতে বই প্রকাশিত হয়।
ইতিহাস বিবেচনায় পুঁথি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। পুঁথি নিয়ে আপনাদের প্ল্যান কী?
মোহাম্মদ আজম : পুঁথি নিয়ে প্ল্যান খুবই ভালো অবস্থায় আছে। সরকার একটা বড় প্রকল্প পাশ করেছে এবং দ্রুত সেটা পেয়ে যাব। পুঁথি নিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কাজটি হতে যাচ্ছে। সকল পুঁথি ডিজিটাইজেশন হবে এবং পুঁথিনির্ভর গ্রন্থাদি প্রকাশ করা হবে। সম্ভবত দেশে পুঁথি নিয়ে এত বড় কাজ একসঙ্গে এর আগে কখনোই হয়নি।
বাংলা একাডেমির রচনাবলি প্রকল্প নিয়ে অনেক অভিযোগ ও আক্ষেপ। অথচ একাডেমির অন্যতম কাজ রচনাবলি প্রকাশ, কিন্তু প্রায় কাজে দীর্ঘসূত্রতার কারণ কী?
মোহাম্মদ আজম : এই প্রসঙ্গে শহীদুল্লাহর রচনাবলীর কথা বলি। এক খণ্ডের জন্য পাঁচ বার প্রুফ সংশোধনের জন্য পাঠানো হয়েছে, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা এখনো সম্পন্ন হয়নি। অনেক সম্মানিত ব্যক্তিও একটি ভূমিকা লিখতে বছরের পর বছর পার করে দেন। যে কারণে একাডেমির রচনাবলির কাজ আটকে যায়। আশা করছি এর গতি বাড়বে।
বইমেলা নিয়ে অনেক কথা, কেউ বলে বাংলা একাডেমির কাজ না, প্রকাশক সমিতির কাজ মেলা করা। কর্তৃত্ব কার হাতে থাকা উচিত?
মোহাম্মদ আজম : বইমেলা প্রকাশক সমিতি করবে, না বাংলা একাডেমি করবে, সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত। প্রকাশক সমিতি কি কখনোই সরকারের সঙ্গে কার্যকর লবিং করেছে? যতটা জানি মেলা পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাব এখনো সরকারে জমা পড়েনি। আপাতত বাংলা একাডেমিই এই আয়োজন করছে।
সব চেয়ে বড় বিষয়- এই মুহূর্তে কোনো কার্যকর প্রকাশক সমিতিও নেই। আলাপ আলোচনার পরে ধীরে ধীরে পার্টনারশিপ বাড়ানোর মাধ্যমে এক সময় হয়তো প্রকাশনা সমিতি মেলার দায়িত্ব নিতে পারবে। আগামীতে সরকারের অনুমোদনক্রমে এবং উপযুক্ত কাঠামো গড়ে তোলার পরেই সেটা হতে পারে।
বইমেলা প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করতেন। কেন একজন খ্যাতিমান লেখক বা কবি নয়? ২০২৫ মেলা সাহিত্যে নোবেল লরিয়েট দিয়ে বইমেলার উদ্বোধন হতে পারে?
মোহাম্মদ আজম : এটা আমার ইচ্ছায় হবে না। কারণ বইমেলা একাডেমিতে হলেও পরিচালনার দায়িত্ব একটা বড় কমিটির উপর নির্ভরশীল এবং সঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও জড়িত। তবে যদি এ বিষয়ে সামাজিক চাহিদা সৃষ্টি হয়, তবে ভবিষ্যতে পরিবর্তন হতে পারে।
Comments