বাংলা একাডেমিতে কেমন সংস্কার চাই
টি এস এলিয়ট কবিতায় লাইলাক-ফোটা এপ্রিলকে 'নিষ্ঠুরতম মাস' হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। বিরানভূমিতে ফুলও যে নিষ্ঠুরতার কথা মনে করিয়ে দিতে পারে তা এলিয়টের কবিতা থেকে জানতে পারি। এ ব্যাপারে আমাদেরও আছে ভয়াল বাস্তবতা। স্বাধীনতার আগে সত্তরের নভেম্বর দেখেছিল উপকূল ভাসানো, প্রাণবিনাশী জলোচ্ছ্বাস। একাত্তরের নিষ্ঠুরতম মাস ছিল কালরাত্রির মার্চ। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে প্রতিবছরের ১৫ আগস্ট শোকের সঙ্গে পালন করে আসছিল। ২০২৪ সালে ছাত্রজনতা দ্রোহে-বিপ্লবে জুলাইকে ৩৬ দিনে টেনে নিয়ে গেলেন স্বৈরতন্ত্রের হাত থেকে আরাধ্য মুক্তির অভিপ্রায়ে।
সে দ্রোহে 'ভোটবঞ্চিত তারুণ্য' অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেললেন। ঘোর আষাঢ়-শ্রাবণেও এমন প্লাবন এ দেশ দেখেনি। এ যেন নজরুলের উষার দুয়ারে আঘাত হেনে রাঙা প্রভাত আনার ছন্দময় বিপ্লব। কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন বৈষম্যবিরোধীতায় রূপ নিয়ে স্বৈরাচার পতনের এক দফায় পরিণত হয়। তাতে আত্মাহুতি দেন আবু সাঈদ, মুগ্ধদের মতো শত শত প্রাণ। বিশ্ব দেখে ফ্যাসিবাদের নির্মম পরিণতি।
অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বাংলা একাডেমি না। এটির যে আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে তা মন্ত্রণালয় ও একাডেমির কর্মকর্তা কর্মচারিদের আচরণে বুঝা যায় না। বিশেষ করে ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ্দের সাধনার একাডেমিকে বলা হয় 'বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক'। কিন্তু নিকট অতীতে একাডেমির সার্বিক কর্মকাণ্ডে এই স্লোগানের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাইনি; বরং বিভ্রান্ত হয়েছি।
ঐতিহাসিক এই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের আমূল সংস্কারের সুযোগ এনে দিয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঢেলে সাজানোর বড় সুযোগ এখন। কারণ সাংস্কৃতিক শক্তিই একটি জাতিকে স্বকীয়তায়- মননশীলতায় অগ্রগামী করে তুলতে পারে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ও নজরুল ইনস্টিটিউটের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি; যার প্রথম কাজ এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে 'দলীয় ভূত' তাড়িয়ে গণপ্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা। কারও তাঁবেদারি না করে দেশ ও দশের হয়ে কাজ করা।
খ.
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, গবেষণা ও প্রচারের লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠার পর থেকে কালক্রমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য গবেষকদের ভরসাস্থলে পরিণত হয় বাংলা একাডেমি। কিন্তু সরকারি আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের মতোই তথাকথিত স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের নজির আমরা দেখেছি। দেখেছি নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জেরে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার উদাহরণ। দেখেছি এখান থেকে প্রকাশিত প্রকাশনায় মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন না হতে। বাংলা একাডেমির পুরস্কারে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগও অনেক। সব মিলিয়ে একাডেমির নৈতিক অধঃপতন কমিয়ে দিয়েছে এ পুরস্কারের গুরুত্ব।
দেশের বিভিন্ন সংকটকালীন পরিস্থিতিতে একাডেমি সংশ্লিষ্ট লেখক-গবেষকদের সেই ভূমিকা আমরা দেখতে পাইনি। প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের যে ২১ দফা দাবি দিয়েছিলেন, তার একটি দফা ছিল বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি। সেই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে আজ অবধি তার আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ বাস্তবায়ন যে হয়নি সেটা হলফ করেই বলা যায়।
অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বাংলা একাডেমি না। এটির যে আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে তা মন্ত্রণালয় ও একাডেমির কর্মকর্তা কর্মচারিদের আচরণে বুঝা যায় না। বিশেষ করে ড. মুহম্মদ শহীদুলাহ্দের সাধনার একাডেমিকে বলা হয় 'বাঙালি জাতিসত্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক'। কিন্তু নিকট অতীতে একাডেমির সার্বিক কর্মকাণ্ডে এই স্লোগানের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাইনি; বরং বিভ্রান্ত হয়েছি।
প্রসঙ্গে গ্রন্থাগার বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন পরিচালক ফজলে রাব্বী তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করছেন, 'বাংলা একাডেমি একটা দ্বীপের মতো। এটি জন্ম থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে। সরকারও এর বিরুদ্ধে। এর কারণ বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক দাবির পরিপ্রেক্ষিতে, গণতান্ত্রিক সরকার কর্তৃক। এ দেশে সরকার ও জনতা পরস্পরবিরোধী। গণতন্ত্র ও সরকার সম্পূরক শক্তি নয় বরং বিরোধী। এর প্রাণ হচ্ছে লেখক গবেষক।'
কিন্তু অন্তত গত দুই দশকে দেশের বিভিন্ন সংকটকালীন পরিস্থিতিতে একাডেমি সংশ্লিষ্ট লেখক-গবেষকদের সেই ভূমিকা আমরা দেখতে পাইনি। প্রখ্যাত লেখক-সাংবাদিক-রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের যে ২১ দফা দাবি দিয়েছিলেন, তার একটি দফা ছিল বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি। সেই স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানে আজ অবধি তার আকাঙ্ক্ষার পূর্ণ বাস্তবায়ন যে হয়নি সেটা হলফ করেই বলা যায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অস্থির সময়ে গত ১৬ জুলাই এ বিষয়ে মতামত জানতে ফোন করেছিলাম দেশের গুরুত্বপূর্ণ চারজন কবিকে। তাদের মধ্যে তিনজনের কবিতা বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে বার বার উচ্চারিত হয়।
এই কবিদের দুইজন জানালেন, অনেকদিন ধরে তারা ঘরবন্দী। বাইরের খবর রাখেন না। তাই মতামত দিতে পারবেন না। তৃতীয় জন এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। চতুর্থজন ছিলেন গত শতকের আশির দশকে সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা জাতীয় কবিতা পরিষদের শীর্ষ ব্যক্তিদের একজন। তিনি ফোনই ধরেননি।
১৬ জুলাইয়ের পর দেশ যখন মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হচ্ছে তখনো চুপ ছিলেন বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, কবি-লেখক, সম্পাদক ও সাংবাদিকরা।
তখন বিষয়টি নিয়ে কথা হয় কবি মোহন রায়হানের সঙ্গে। বললেন, 'মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা—দেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা থেকে জাতি আজ অনেক দূরে! রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষাসহ সবক্ষেত্রে সীমাহীন নৈরাজ্য চলছে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে হলে জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ সমাসন্ন।'
সত্যিকারের লেখক হতে হলে মানুষের জন্য দরদী মন থাকতে হয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবেশ তৈরিতে ব্যক্তি পরিসরের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নিরন্তর চর্চা দরকার। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে বাংলা একাডেমি। এর আগে সরকারকে অবশ্যই তার সাংস্কৃতিক নীতি স্পষ্ট করতে হবে
মোহন রায়হানের এই কথায় কিছুটা আশা পেলেও পরবর্তীতে তাকেও মাঠে পাইনি আমরা। তাহলে কি আমরা এটাই ধরে নেব যে—শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিপীড়িত জনগণের পাশে দাঁড়ানোর কর্তব্য ও দায়কে উপেক্ষা করেছেন কবি-লেখক-সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরা। আর এর কারণ কি তাহলে ব্যক্তিস্বার্থের টান, রাজনৈতিক পদ-পদবির মোহ কিংবা পুরষ্কারের লোভ?
গ.
সত্যিকারের লেখক হতে হলে মানুষের জন্য দরদী মন থাকতে হয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবেশ তৈরিতে ব্যক্তি পরিসরের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নিরন্তর চর্চা দরকার। এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে বাংলা একাডেমি। এর আগে সরকারকে অবশ্যই তার সাংস্কৃতিক নীতি স্পষ্ট করতে হবে। বাকস্বাধীনতা ও সারাদেশে সংস্কৃতি চর্চায় আরও উদার নৈতিক আচরণ এবং লাইব্রেরি পাঠাগারের প্রতি দরদী হতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সংস্কারের শুরুতে একটি সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের ভেতর দিয়ে মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্তশাসন ও বাংলা একাডেমি আইন সংস্কারে পুনরুদ্ধারে উদ্যোগী হতে হবে। আমরা দেখিছি ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনের তোয়াক্কা না করে বাংলা একাডেমিসহ বেশকিছু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানকে তাদের নামের সঙ্গে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম যুক্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল, যা কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্যায্য হস্তক্ষেপ।
এই পরিস্থিতিতে বাংলা একাডেমির সংস্কারে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিবেচনার জন্য প্রস্তাবগুলো রাখা হলো—
১. আইনে আছে চার সদস্যের সমন্বয়ে একাডেমি। তারা হলেন—একাডেমির সভাপতি, নির্বাহী পরিষদের সভাপতি, ফেলো ও সদস্য। এক্ষেত্রে কার কী কাজ, কে কার কাজে কতটুকু নাক গলাতে পারবে সেটা স্পষ্ট করতে হবে। নির্বাহী পরিষদের সভাপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনতে হবে। মহাপরিচালক নিয়োগ বিষয়ক নীতি আরও স্পষ্ট করতে হবে। ভোটের মাধ্যমে ফেলো ও সদস্য নির্বাচনের বিধান থাকলেও তা মানা হয় না। এটি নিশ্চিত করতে হবে।
২. একাডেমির মিশন হচ্ছে—বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির গবেষণা, প্রকাশনা ও অনুবাদের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত, জ্ঞানভিত্তিক ঐতিহ্যমণ্ডিত ও সংস্কৃতিমনস্ক জাতি গঠন করা। কিন্তু বাংলা একাডেমি নতুন কোন গবেষণা করেছে গত দেড় দশকে বঙ্গবন্ধু নিয়ে নামে বেনামে বই ছাড়া? একাডেমি থেকে প্রকাশিত ৬ হাজার ৫০০ বইয়ের মধ্যে এখন মাত্র দেড় হাজার বই পাওয়া যায়। অনেক বই একাডেমির লাইব্রেরিতেই পাওয়া যায় না। পত্র-পত্রিকা প্রকাশনায় নেই নতুনত্বের ছাপ, দলীয় বিবেচনায় প্রকাশ। এক্ষেত্রে নতুনদের লেখা প্রকাশ এবং কবি-লেখকদের নিয়ে কমিটি করে দুর্লভ ও প্রয়োজনীয় বইগুলো পুনর্মুদ্রণ করতে হবে।
৩. একাডেমির প্রবিধানমালার ১৪.১৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে—অশ্লীল, রুচিগর্হিত, জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি কটাক্ষমূলক, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়, বইমেলার পক্ষে ক্ষতিকর, এমন কোনো বই বিক্রি করা যাবে না৷ ১৪.১৫ অনুচ্ছেদে বলা আছে—অমর একুশে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থি কোন বিক্রি বা প্রদর্শন করা যাবে না৷
এক্ষেত্রে অশ্লীল, রুচিগর্হিত শব্দগুলোর সার্বজনীন কোনো অর্থ আছে কি? রুচিগর্হিত কি না সেটা বিচার করবে কে? আমার কাছে যেটা রুচিহীন, সেটাই আরেকজনের কাছে রুচিশীল হতে পারে। এগুলো আরও সুনির্দিষ্ট করতে হবে।
৪. বাংলা একাডেমির স্বার্থ ও মর্যাদাক্ষুণ্ণকারী, প্রমাণিত মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হলে তারা সদস্য হতে পারবে না বা পদ হারাবে। এটি বর্তমানে ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুথানের নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই নীতির পরবর্তন জরুরি।
৫. প্রবিধানমালা অনুসারে মৌলিক গবেষণা এবং এর উৎকর্ষ সাধনে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে একাডেমি গবেষণা কেন্দ্র বা ইনস্টিটিউট স্থাপন করতে পারে। এক্ষেত্রে বিভাগীয় শহরগুলোতে একাডেমির কার্যক্রম ছড়িয়ে দিতে হবে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বই সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. বাংলা একাডেমির অনেক আয়োজনে অযাচিত হয়ে কিংবা ক্ষমতাবলে মহাপরিচালকের অতিথি হওয়ার প্রবণতা আছে। আবার খুশি করতে মন্ত্রণালয় থেকেও অনেককে অতিথি করে আনা হয়। অথচ অনেক যোগ্য লেখক-গবেষক ঢাকার বাইরে থাকেন। চাইলে তাদের আনা যায়। আবার অনেক অনুষ্ঠান করা হয় অফিস সময়ে নিজস্ব কর্মীদের নিয়ে। এক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা থেকে বঞ্চিত হয় মানুষ। এগুলো বিবেচনায় আনতে হবে।
৭. একাডেমির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজের জন্য চুক্তিভিত্তিক বিশেষজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, নিয়মও আছে। সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে জুলাই অভ্যুত্থান পর্যন্ত বাঁকবদলের প্রতিটি পর্ব নিয়ে আলাদা গবেষণা হতে পারে।
৮. বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও আরও অন্তত নয়টি পুরস্কার দেয়। এসব পুরস্কারের উদ্দেশ্য, প্রদানের প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা। অনেকে মনে করেন সাহিত্য পুরস্কারের মনোনয়ন অগণতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক। এর পরিবর্তন জরুরি।
৯. বইমেলার জন্য একাডেমির অধীনে স্বতন্ত্র বিভাগ খোলা যেতে পারে। যে বিভাগ বইমেলার আয়োজন ছাড়াও সারাবছর বই নিয়ে সেমিনার, পাঠচক্র করতে পারবে। এতে তরুণ সমাজ একাডেমির নৈকট্য লাভ করবে। তৈরি করা যেতে পারে ডিজিটাল অভিধান। যা খুব জরুরি।
১০. একাডেমির সদস্যদের পাশাপাশি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য ৪০ শতাংশ ছাড়ে বই কেনার ব্যবস্থা রাখা যেতে পারে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আশপাশের জেলাগুলো থেকে অনেক মানুষ ঢাকায় আসে। সে সময় বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলা একাডেমির পুস্তক বিক্রয়কেন্দ্র খোলা রাখার ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
১১. একাডেমির এনামুল হক ভবনে বিদেশি অতিথিদের জন্য একটি গেস্টরুম আছে। কিন্তু ভবনটিতে লিফট না থাকায় তাদের সেখানে রাখা সম্ভব হয় না। এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
১২. বইমেলা রাজনৈতিক সরকারের প্রধানদের নিয়ে উদ্বোধন না করিয়ে খ্যাতনামা দেশি-বিদেশি লেখকদের দিয়ে উদ্বোধন করানো যায়। বাংলা একাডেমির সঙ্গে বিশ্বের খ্যাতনামা লেখক-তাত্ত্বিকদের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। অথচ পাকিস্তান আমলেও ছিল। আগামী বইমেলা উদ্বোধনের জন্য ওরহান পামুক কিংবা হারুকি মুরাকামির মতো লেখকদের আনার ব্যবস্থা করা যায়।
১৩. বাংলা একাডেমি বা সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ে কর্মরত কেউ একাডেমির পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবেন না এমন বিধান করতে হবে। পুরস্কারের বিভাগ কমিয়ে এর মান ও অর্থের পরিমাণ বাড়াতে হবে৷
১৪. জাতীয় কবির রচনাবলী নামমাত্র মূল্যে আগ্রহীদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। একইসঙ্গে নজরুল ইন্সটিটিউটের সহায়তায় পূর্ণাঙ্গ নজরুল রচনার ইংরেজি অনুবাদ করতে পারলে তা ঐতিহাসিক একটি কাজ হবে। দেশে বিদেশে নজরুলের চেতনা ছড়িয়ে পড়বে।
১৫. স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান 'বঙ্গবন্ধু লেখক ট্রাস্ট' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে ট্রাস্টটি বিলুপ্ত হয়। জুলাই স্মরণে 'জুলাই কবি-লেখক ট্রাস্ট' করা যেতে পারে। এই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আন্দোলনে থাকা লেখক-সাহিত্যিকদের স্মৃতি সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
এমন অনেক কথা আসতে পারে। প্রসঙ্গে লিখেছিলেন আনিসুর রহমান, পাভেল রহমান ও শামস আরেফিন। আমি মনে করি, রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহৃত না হয়ে বাংলা একাডেমিকে গণমানুষের প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে সংশ্লিষ্টদের বুদ্ধিবৃত্তিক সততার প্রয়োজন সবার আগে। এর সঙ্গে দরকার অর্থ। প্রায় ৪০০ জনের এ একাডেমির জন্য বছরে মাত্র ৪০ কোটি ২১ লাখ টাকা বাজেট বরাদ্দ হয়। আর একাডেমির নিজস্ব আয় ১০ কোটি টাকার মতো। এমন একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা জন্য এই অর্থ কোনোভাবেই যথেষ্ট হতে পারে না।
শুরুতে একাডেমির পরিসর ছোট ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা বিস্তৃত হয়েছে। বেড়েছে আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিধিও। তাই সার্বিক লক্ষ্য বাস্তবায়নে একাডেমি পরিচালনার জন্য বছরে অন্তত ১০০ কোটি টাকার প্রয়োজন। বৃদ্ধি পাওয়া উচিৎ মূল সংস্কৃতি বাজেটও।
Comments