বই দিবস

লেখকের প্রতি পাঠকের প্রত্যাশা

পাঠকের চাহিদা কখনোই লেখকের চাহিদার ঊর্ধ্বে নয়। শুধু তখন পাঠক কষ্ট পায় যখন পাঠক নিজেকে লেখকের লেখার সাথে যুক্ত করতে না পারে।

অনেকে বলেন এখনকার বই সাধারণ পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করছে না। আসলে সাধারণ পাঠক বলে কোন পাঠক নেই। পাঠক মানেই অসাধারণ। প্রত্যেকেই কোন না কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বই পড়েন। কেউ তথ্যের জন্য, কেউ আনন্দের জন্য, কেউ জ্ঞান অর্জনের জন্য, আবার কেউ কেউ নিজেদের বোধকে শাণিত করবার জন্য। আর বইয়ের কাছে এলেই যে কেউ সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠেন।

পাঠকের আগ্রহের সঙ্গে যদি লেখা মিলে যায় তবে সেই লেখা তাদের কাছে হয়ে ওঠে অতুলনীয় বা হৃদয়স্পর্শী। এমন লেখা যে বইয়ে গ্রন্থিত হয় সেই বই পায় পাঠক প্রিয়তা এবং সেই লেখক বনে যান প্রিয় লেখকে। তবে কেউ যদি পাঠকদের অবজ্ঞা করেন সাধারণ ভাবেন সেটা তার চিন্তার দৈন্য। একমাত্র নির্বোধজন অন্যকে নির্বোধ মনে করে। বোধ সম্পন্ন কেউ কখনো কাউকে ছোট বা খাটো করে ভাবতে পারেন না। ভাবনা শক্তিতে যে যত উন্নত চিন্তাশক্তিতেও সে ততো অগ্রগামী।

এখন প্রশ্ন হলো পাঠক বইয়ে কি খুঁজি? এমন প্রশ্নের জবাব দেয়া মুশকিল। মানুষের মনের চাহিদা শুধু জনে জনেই আলাদা না বয়সের ব্যবধানেও বিস্তর বদলে যায়। সৃষ্টি জগতের মধ্যে মানুষ এক অস্থির চিত্তের অদ্বিতীয় প্রাণী। মানুষ নিজেও নিজেকে বুঝতে ব্যর্থ হয়। সুতারং মানুষের মন পুরোপুরি ছুঁয়ে দেয়া সম্ভব না। সম্ভব নয় মানুষের মন ও তাদের চিন্তা-চেতনা নিয়ে ধ্রুব কিছু বলা। তবে একটা দারুণ বিষয় হলো মানুষের মন স্মৃতিকাতর। স্মৃতি আকড়ে রাখে জীবনভর। বয়সের খোলস বদলাতে বদলাতে যতদূর যে যাক না কেন স্মৃতির গোলা ভেঙ্গে দিতে পারে না। বরং নিত্যদিন স্মৃতি জমাতে থাকে স্মৃতির গোলায়। তৃণভোজী প্রাণী যেমন অবসরে চর্বিত খাদ্যের জাবর কাটে মানুষও তেমন একটু অবকাশে স্মৃতি গ্রন্থনা করে।

যত উত্তম বা ভালো মানের বীজ আপনি রোপণ করেন না কেন, যদি মাটি বীজ রোপণের জন্য উপযুক্ত না হয় তবে সে বীজ থেকে চারা গজাবে না। সুতরাং লেখকের বার্তা পাঠকের হৃদয় পৌঁছাতে হলে পাঠকের মনের বাহনে চড়াতে হবে।

অতীত সুখ-দুঃখে নিজের ভিতর আনন্দের জোয়ারা-ভাটার খেলায় মত্ত হয়। কোন একটা বই যদি পাঠকের স্মৃতিতে ঢিলের মতো আঘাত করতে পারে তবে সেই বইটি পাঠক হৃদয়ে মণিকোঠায় স্থান দেয়। নিজের অজান্তে প্রেমে পড়ে যায় লেখায়। তখন পাঠকহৃদয় ভালোবাসোতে শুরু করে লেখক সত্তাকে। একবার যে ভালোবাসা পায় তাকে আর কে হারায়। ভালোবেসে কেউ কাউকে হারাতে দেয়া না। মনের সিন্ধুকে রেখে গোপন করে দেয় মনসিন্ধুকের তালা খোলার চাবি। তাই পাঠক মন কি চায় সেটা না ভেবে লেখকে পাঠকের স্মৃতির ভেলায় লেখা তুলে দিতে পারে। তখন লেখা স্মৃতির ভেলায় চড়ে চলে যাবে পাঠক হৃদয়ের কুঠুরিতে। মনোমন্দিরে। পাঠক তখন নিজের মত করে আপন স্বাদে তৃপ্ত হয়ে লেখকের লেখা গ্রহণ করবেন।

অনেকটা ঠিক কৃষকের সীডবেড তৈরির মত। যত উত্তম বা ভালো মানের বীজ আপনি রোপণ করেন না কেন, যদি মাটি বীজ রোপণের জন্য উপযুক্ত না হয় তবে সে বীজ থেকে চারা গজাবে না। সুতরাং লেখকের বার্তা পাঠকের হৃদয় পৌঁছাতে হলে পাঠকের মনের বাহনে চড়াতে হবে। জোর করে পাঠককে কোন ম্যাসেজ গ্রহণ করানো সম্ভব নয়। মানুষের শরীরের উপর জোর খাটানো গেলেও মনের উপর জোর খাটানো যায় না। আর সেটা তো কোন লেখকের পক্ষেই সম্ভব না। কেননা লেখকের উদ্দেশ্য সব সময়ই মহৎ। লেখক চান আনন্দের সহিত নির্দিষ্ট কিছু ম্যাসেজের মাধ্যমে পাঠকের বোধ শক্তিকে জাগ্রত করতে। এর বাইরে কোন লেখকের দ্বিতীয় কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।

পাঠকের প্রত্যাশিত মাধ্যম দিয়ে লেখক তার ধ্যান-বিশ্বাস অতি সহজে বিনিময় করতে পারবেন। এমন কি পাঠক মনের প্রতিষ্ঠিত ধ্যান- বিশ্বাস ভেঙে চুরমার করে দিতেও সক্ষম হবেন। কিছু লেখা পড়া শুরু করে আপনি বের হতে পারছে না। উঠি উঠি করেও উঠতে পারছেন না। আপনার ভিতর বলছে- আর একটু, দেখা যাক এরপর কি হচ্ছে অথবা লেখার সাথে নিজের অতীতের সাথে মিলেমিশে একার হয়ে আটকে গেছে। অবচেতনের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে লেখক সত্তার কাছে। 

বাঁধার প্রাচীর ভেঙ্গে মন হওয়ার মতো মিশে যাচ্ছে অনঅনুদিত গন্তব্যে। ইচ্ছার অলিখিত চিঠি মনের কাগজে লিখে পোষ্ট করছেন অজানায়। নিজেকে নিজের ভিতর নতুন করে আবিষ্কার করছেন বর্তমানের ডেরায়। অতীতের সুখ-দুঃখের ইটে নির্মাণ করছেন অপূর্ণ আশার বসতঘর। কোথায় ছিলেন কেমন ছিলে সেই রেষের দ্যোতনায় দুলতে দুলতে না পাওয়া সব স্বাদ কেমন করে বর্তমানের ভিতর প্রথিত করতে হয় সেসব রূপরেখায় হাজির হবেন বাস্তবে। 

এমন কিছু পেলে পাঠক বইপ্রিয় হয়ে ওঠবে। লেখার সাথে নিজেকে বিয়ে দিয়ে পাতবে আমোদসংসার। লেখকের কাছে পাঠক আশা অহেতুক নয় বরং যৌক্তিক। কবি বা লেখক বিশেষণ কেউ নিজের করে নিতে চাইলে তাকে এ দাবি পূরণ করতে বাধ্য থাকতে হবে। যেমন টাকা, বাহকের চাহিতা পূরণে বাধ্য ধাকে। গ্রাহকের কাছে কাঙ্ক্ষিত ও নন্দিত। লেখাও কিন্তু পাঠকের কাছে এমন- একথার গুরুত্ব কবি লেখকদের দিতে হবে। পাঠক এই গুরুত্বটাই চাচ্ছে। নিজের মুখে যে কথা বলতে পারছে না সে কথাই সে পড়তে চাচ্ছে কবিতা,গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি নামে।

মজার বিষয় হচ্ছে, পাঠকের চাহিদা কখনোই লেখকের চাহিদার ঊর্ধ্বে নয়। শুধু তখন পাঠক কষ্ট পায় যখন পাঠক নিজেকে লেখকের লেখার সাথে যুক্ত করতে না পারে। পাঠক চাচ্ছে লেখকরা এমন একটা শব্দসিঁড়ি গড়ে দিক যে সিঁড়ি বেয়ে লেখকরে রচনায় সহজভাবে বিচরণ করতে পারে। উড়তে পারে পাখির মতো। নিজের ভাবনার বিয়ে দিয়ে লেখাকে আত্মীয় করে নিতে পারে।

সত্যি বলতে, পাঠক এরচেয়ে বেশি কিছু চায় না। অদ্ভুত উদ্ভট কিছু কারোই প্রত্যাশার নয়। মানুষের চিন্তাচেতনা যতই জটিল হোক না কেন, মানুষের কাছে মানুষের প্রত্যাশা সবসময়ই সহজ ও স্বাভাবিক। - শুধু লেখকের লেখার সাথে নিজের মনঃসংযোগ স্থাপন করতে পারলেই পাঠক খুশি।

Comments

The Daily Star  | English

All educational institutions reopen after heatwave-induced closures

After several closures due to the heatwave sweeping the country, all primary and secondary schools, colleges, madrasas, and technical institutions across the country resumed classes today

52m ago