৩ ট্রাভেল ভ্লগারের মুখে বাংলাদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
বিদেশি ট্রাভেল ভ্লগাররা প্রায়ই বাংলাদেশ ঘুরতে আসেন এবং এদেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য, খাবার, সংস্কৃতি ও জনপদের ওপর তাদের তৈরি ভিডিও দেশে-বিদেশে অসংখ্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাদের ভিডিও নিয়ে দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও প্রায়ই ব্যাপক আলোচনা হয়।
পর্যটন দিবসে উপলক্ষে দ্য ডেইলি স্টার এমন ৩ জন ট্রাভেল ব্লগারের কাছে বাংলাদেশ ভ্রমণের বিষয়ক অভিজ্ঞতা জেনেছে। এই জনপ্রিয় ভ্লগাররা হলেন মার্ক উইন্স, ডাগ বার্নার্ড এবং ব্রেন্ট টিম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে তাদের বিশালসংখ্যক সাবস্ক্রাইবার ও ফলোয়ার আছেন।
বাংলাদেশ ভ্রমণের স্মৃতি
বাংলাদেশের ওপর এই ৩ ভ্লগারের ভিডিওগুলো দেখলে বেশ অবাক হবেন। তারা শহরাঞ্চল থেকে গ্রামীণ লোকালয় পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ঘুরে দেখেছেন। প্রায় পুরো বাংলাদেশের চিত্রই উঠে এসেছে তাদের ভিডিওতে।
ডাগ বার্নার্ড তার বাংলাদেশ সফরের সময় অন্যান্য অভিজ্ঞতার পাশাপাশি দুটি বিয়েতে অংশ নিয়েছেন, স্টিমারে করে বরিশাল গেছেন, ভালোবাসা দিবস উদযাপন করেছেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসন্ত উৎসবে সামিল হয়েছেন। বান্দরবান ভ্রমণের অভিজ্ঞতাও তার পছন্দের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
ডাগ বার্নার্ড বলেন, 'মানুষ যখন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভাবে, তখন জনবহুল ও ব্যস্ত জায়গাগুলোর কথাই প্রথম মাথায় আসে। অনেক বিদেশি এ দেশের শান্ত ও নির্মল চরিত্রের কথা জানেনই না।'
ব্রেন্ট টিম তার সফরের সময় হলিউড ব্লকবাস্টার সিনেমা বার্বির প্রিমিয়ারে গিয়েছিলেন। পোশাক কারখানা পরিদর্শন, স্থানীয় বাজারে ঘোরাঘুরি এবং লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানেও গিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশে তিনি ঈদও উদযাপন করেছেন, যা তার কাছে এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। সিলেটে ক্রিকেট ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতাও তার কাছে ছিল অন্যরকম।
ব্রেন্ট টিম বলেন, 'আমি এর আগে কখনো ক্রিকেট ম্যাচ দেখিনি। এই খেলাকে ঘিরে মানুষের উত্তেজনা তুঙ্গে। যে অভিজ্ঞতা হলো এবং মানুষের মধ্যে যে প্রাণশক্তি দেখেছি, তার তুলনা হয় না।'
মার্ক উইন্স মূলত একজন ফুড ব্লগার। বিশ্বজুড়ে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির খাবার সবার কাছে তুলে ধরেন তিনি। বাংলাদেশে আসার পর তার জিভ বিশ্রামের জন্য তেমন সময়ই পায়নি! হরেক রকম খাবারের মধ্যে স্ট্রিট ফুড, ভর্তা, কাচ্চি বিরিয়ানি, মেজবানির মাংসের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যদি একটি খাবারকে বেছে নিতে হয়, তাহলে কোনটি বাছাই করবেন? মার্ক জবাব দিয়েছিলেন সরিষার তেলে রান্না করা ইলিশ মাছ (তিনি সম্ভবত সর্ষে ইলিশের কথা বুঝিয়েছেন)।
কোনো চ্যালেঞ্জ?
মার্ক হাসতে হাসতে বললেন, 'ট্রাফিক জ্যামের কথা সবসময়ই বলা যায়।'
হাসতে হাসতে একই উত্তর দিলেন ডাগ ব্রেন্টও।
ডাগ অবশ্য বলেছেন, পরিবর্তন আসতে আরও সময় লাগবে।
এ ছাড়া, তিনি সাজেক ও সুন্দরবনে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই জায়গাগুলোতে ভ্রমণের জন্য যানবাহনের ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য পেতে তাকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। চ্যালেঞ্জ হিসেবে পর্যটন অবকাঠামোর অভাবের কথা উল্লেখ করেছেন ডাগ।
পর্যটন মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান
ডাগ বলেন, 'আমার মনে হয় পর্যটনে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা আছে। আপাতত দেশটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হতে পারে যারা বাস্তব, অকৃত্রিম ও প্রাকৃতিক পরিবেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা চান। আমার কাছে এ ধরনের ভ্রমণকেই সেরা মনে হয়।'
'ইকোট্যুরিজম প্রচারে প্রচুর সম্ভাবনা আছে বাংলাদেশের। সেখানে যাওয়ার আগে আমি বান্দরবান, সুন্দরবন ও এসব জায়গা সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানতাম না। মানচিত্রের দিকে তাকালে মনে হয় এটি মোটামুটি ছোট একটি দেশ। অথচ বিভিন্ন এলাকার বৈচিত্র্য দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি', যোগ করেন তিনি।
মার্ক মূলত থাইল্যান্ডে থাকেন। আগেও ব্যাংককের কয়েকটি বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল তার। তবে এদেশে এসে তার অভিজ্ঞতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি বলেন, 'খাবারের কোনো তুলনা হয় না। কিন্তু আমি মনে করি, অন্যান্য খাবারের তুলনায় বাংলাদেশি খাবার বিশ্বজুড়ে অতটা ভালোভাবে উপস্থাপিত হয় না। সুতরাং বাংলাদেশে না থাকলে বাংলাদেশি খাবার সম্পর্কে জানাটা কঠিন।'
রন্ধনশৈলীর মানচিত্রে আমাদের খাবারকে 'খুব উচ্চ' আসনে রাখেন মার্ক।
তিনি বলছিলেন, 'বাংলাদেশের রান্না পৃথিবীর অন্যতম সেরার তালিকায় থাকা উচিত। এটি অনন্য। অনেক খাবারে সরিষার তেলের ব্যবহার খুবই দারুণ আর ভর্তাও খেতে খুবই সুস্বাদু।'
ডাগ ব্রেন্টের মতে চা বাগান, ধানখেত, সুন্দর সুন্দর জায়গা এবং মানুষের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রাকৃত সৌন্দর্য নিহিত। বাংলাদেশ সম্পর্কে মানুষ ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে প্রথমেই ঢাকা ও এই শহরের ট্রাফিক জ্যামের ছবি দেখে ভাবে, এটাই বুঝি এ দেশের চিত্র। কিন্তু তার কাছে সেটি মোটেও বাংলাদেশের আসল চিত্র নয়।
বিদেশি ভ্লগার ও স্থানীয় জনগণ
বিদেশি ভ্লগারদের নিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় মানুষদের বাড়তি আগ্রহের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। আপনারা হয়তো সামাজিক মাধ্যমে এমন কিছু ভিডিও দেখছেনও। প্রায়ই দেখা যায় বিদেশি ভ্লগাররা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ও আশেপাশে মানুষ ভিড় করেন, তাদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে চান এবং সেলফি তোলেন।
এসব ভিডিও দেখে কারো মনে হতে পারে স্থানীয়রা বিদেশিদের প্রতি এবং তাদের ক্যামেরার প্রতি অতি উৎসাহী।
কিন্তু এই ৩ জন ভ্লগারই ব্যাপারটিকে বেশ ইতিবাচকভাবেই নিয়েছেন।
'স্থানীয়দের উদারতা দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি। তারা আমাকে অসাধারণ ভালবাসা এবং সহানুভূতির সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছিলেন। অনেকেই আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছেন,' ডাগ ব্রেন্ট বলেন।
কিন্তু একটা পর্যায়ে কি এটা কিছুটা বিরক্ত লাগেনি?
ভ্লগারদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তারা হয়তো একটা পর্যায়ে কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলেন, তবে সবমিলিয়ে বিষয়টিকে তারা ইতিবাচকভাবেই নিয়েছেন।
ডাগ বলেন, 'যেসব জায়গার মানুষ একে অপরের সঙ্গে কথাবার্তা বলে, আমি সেসব জায়গায় যেতে পছন্দ করি। আমার মতে ভ্রমণ করা মানে শুধু দৃশ্য দেখা নয়। আমি মানুষের সঙ্গে দেখা করার জন্যও ভ্রমণ করি। আমি সংস্কৃতির গভীরে ঢোকার চেষ্টা করি। বাংলাদেশ সেদিক থেকে একটি আদর্শ স্থান।'
দুর্দান্ত খাবার, অসাধারণ জনগণ, বৈচিত্র্যময় স্থানের কারণে এই ৩ জনের কাছেই বাংলাদেশ ভ্রমণ ছিল বেশ আশ্চর্যজনক অভিজ্ঞতা।
মার্ক উইন্সের মন্তব্য দিয়েই শেষ করি।
স্থানীয় এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে তিনি একটি গ্রামে গিয়েছিলেন। তাকে যে পরিমাণ সুস্বাদু খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল, তা দেখে তিনি বিস্মিত হয়েছেন।
তিনি বলেন, 'এটা ঠিক যে আমি সেখানে ভিডিওধারণ করতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু ক্যামেরা না থাকলেও গ্রামবাসী আমাকে একইরকমভাবে আপ্যায়ন করতেন। তারা ক্যামেরার জন্য এমনটা করেননি, অতিথিপরায়ণ মানসিকতা থেকেই করেছেন।'
মার্ক উইন্স, ডাগ বার্নার্ড ও ব্রেন্ট টিমকে তাদের মূল্যবান মতামত ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করার জন্য বিশেষ ধন্যবাদ। ইউটিউবে তাদের ভিডিওতে দেখুন বিশ্বজুড়ে তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
অনুবাদ করেছেন আহমেদ হিমেল
Comments