সাফাত-শিখার ৬৪ জেলা ভ্রমণ: ‘শঙ্কায় ছিলাম শেষ করতে পারব কি না’
বাংলাদেশের ২ তরুণ প্রাণ সাখাওয়াত হোসেন সাফাত ও জান্নাতুল ইসলাম শিখা গাঁটছড়া বাঁধেন ২০১৭ সালের ২৮ জুলাই। বিয়ের পর নিজেরা ঘোরাঘুরি করার সময় থেকেই তাদের এক দীর্ঘযাত্রা শুরু হয়েছিল। যাত্রাটি ছিল ৬৪ জেলার মানচিত্রে পুরো বাংলাদেশে।
এই অভিযান শেষ নয়, 'সম্পূর্ণ' হয় চলতি বছরের ১৮ আগস্ট। এইমাত্র কদিন আগে। সামাজিক মাধ্যমে গুছিয়ে রাখা অ্যালবাম থেকেই সবাই জানতে পারে তাদের এই মনোমুগ্ধকর যাত্রা সম্পর্কে।
সাফাত আলোকচিত্রী আর শিখা লেখালেখির জগতের মানুষ। এই ২ সৃজনশীল সত্তার ভালোলাগা এসে মিলেছে এক বিন্দুতে। সেটি হচ্ছে ভ্রমণ। সেখান থেকেই তাদের ইচ্ছে ছিল এই যৌথ ভালোলাগাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ভ্রমণের স্মৃতি ধরে রাখা। কয়েকটি জেলা ভ্রমণের পরেই যেন নেশা জমে গেল, সবগুলো জেলাই ঘুরতে হবে। সাফাত আলোকচিত্রী বলেই বিশেষ কিছু ছবি তুলে সময়টাকে ফ্রেমে বন্দী করে রাখার ইচ্ছেও হলো। এসব ভেবেই শুরু।
জীবনের যেকোনো যাত্রাপথে শুধু গন্তব্য নয়, পথও বহুল অর্থবহুল– সে ভ্রমণই হোক বা হোক নিছক পথচলা। মাঝেমাঝে যেন গন্তব্যের চেয়েও বেশি ভালো লাগে পথের সুবাস। ঠিক যেন 'জাব উই মেট' সিনেমার সেই গানটার মতো, 'হাম যো চালনে লাগে, চালনে লাগে হ্যায় ইয়ে রাস্তে– মাঞ্জিল সে বেহতার লাগনে লাগে হ্যায় ইয়ে রাস্তে!'
এই ৬৪ জেলা যাত্রার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কী বলে মনে হয় এমন প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, 'আমরা সত্যিকার অর্থে নিজেদের ভালোলাগা থেকেই শুরু করেছিলাম। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের অভিজ্ঞতা, নানা রকমের মানুষের সঙ্গে মেশা, বিভিন্ন জীবনদর্শন, নানা রকমের ইতিহাস, খাবার- এগুলো নিয়ে জানতে পারার বিষয়টি আমাদের মধ্যে আজীবন একইভাবে রয়ে যাবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে শেয়ার হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ব্যাপারটাকেই আমরা বড় প্রাপ্তি মনে করতাম। কিন্তু শেয়ারের পর এখন চারপাশের মানুষ বলছেন ''আমিও আমার স্বামী/স্ত্রী/সন্তান নিয়ে যেতে চাই'' কিংবা ''আমিও দেশটাকে আপনাদের মতো ঘুরে দেখতে চাই'।' এই যে মানুষের মধ্যে ভ্রমণের সুপ্ত ইচ্ছেটাকে কিছুটা হলেও জাগ্রত করতে পেরেছি, সেটাই এখন বড় প্রাপ্তি মনে হচ্ছে। আমাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কারো যদি ভ্রমণ দর্শন বদলায়, কেউ যদি দেশটাকে নতুন করে জানতে শেখেন, দেখতে শেখেন- তারচেয়ে বড় আর কিছু হতে পারে না।'
ভ্রমণ আমাদেরকে পুরোনো বিষয়ের সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়। যে দেশে জন্ম থেকে বেড়ে উঠা, সে দেশেরও বহু দিক নতুন করে আবিষ্কার করা যায়। এমন ভাবনাই প্রকাশ করলেন এই ভ্রমণপ্রেমী জুটি।
বললেন, 'আমাদের দেশটা খুব বেশি বড় না, কিন্তু বৈচিত্র্যে কোনো অংশেই কম না! স্পাইসি খাবারের কথাই ধরুন। আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলের মুন্ডি, লাক্সুর স্পাইস এক রকম, চুইঝাল কিংবা পুরান ঢাকার খাবারের স্পাইস আবার একদমই অন্য রকম। এমন বৈচিত্র্য আছে মানুষের ভাষা, জীবনধারণের প্রকৃতিতেও। একটু একটু করে যখন বিভিন্ন অঞ্চল ঘোরা শেষ হচ্ছিল, আমরা নিজেরাই আবার আলাপ করতাম এই এলাকায় কোনটা আলাদা পেলাম, কোন জিনিসটা অন্য অঞ্চল থেকে ভিন্ন ছিল এসব নিয়ে।'
বাধাহীন পথ কি সম্ভব?
দেশ ঘুরে বেড়ানোর এই সফরে সামনে কি কোনো চ্যালেঞ্জ এসেছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় মুদ্রার আরেক পিঠ।
তারা বলেন, 'আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল রাতে থাকার জায়গা ম্যানেজ করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বামী-স্ত্রী হওয়ার পরেও, এমনকি ম্যারেজ সার্টিফিকেটের ফটোকপি দেখানোর পরও হোটেলের রুম না পাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক হয়েছে। তবু আমরা ভাগ্যবান সেইসব বন্ধু, স্বজন কিংবা হুট করে পরোক্ষ পরিচয়ে আপন হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কাছে, যাদের কারণে আমরা বারবারই এই সমস্যা উতরে গেছি।'
'এ ছাড়া ২ জনের ছুটির দিন হিসেব করে সময় বের করার ব্যাপারটাও বড় চ্যালেঞ্জ ছিল, যেটা অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে আমাদের মানসিকতা। এমনও হয়েছে সারারাত জার্নি করে পরদিন সকালে অফিসে যাওয়া হয়েছে, আবার কাজ সেরে সে রাতেই নতুন কোনো জেলায় ঘুরতে গেছি। আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জে শুধু আমরা না, গোটা বিশ্ববাসীই ছিলাম। করোনা মহামারির কারণে প্রায় ১ বছর আমাদের ভ্রমণ বন্ধ ছিল। তখন আমরা শঙ্কায় পড়ে গিয়েছিলাম যে আদৌ আমরা শেষ করতে পারব কি না এই ৬৪ জেলার ভ্রমণ', যোগ করেন তারা।
তবে ইচ্ছেপূরণের কাছে এসব চ্যালেঞ্জ কিছুই না বলে মনে করেন সাফাত-শিখা।
`হও আগুয়ান'
৬৪ জেলার পরের ধাপ কী? এবার দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশ নিয়ে কোনো ইচ্ছে বা পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে শোনা যায়, 'ইচ্ছে বলতে ভ্রমণ করাটা সময়, খরচ আর সুস্থতা সাপেক্ষ। আমাদের ইচ্ছে আছে বাংলাদেশের বাইরেও প্রতি বছর একটা করে দেশ ভ্রমণ করার। সেখানকার সংস্কৃতি, মানুষ, জীবনযাপন সম্পর্কে জানার। এখন পর্যন্ত আমরা ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে গিয়েছি। ইচ্ছা আছে সেই ব্যাপারটা অব্যাহত রাখার। আর দেশের মধ্যে ভ্রমণ তো চলবেই।'
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া…
`৬৪ জেলা দেখেছি, তবু এখনো অনেক কিছু বাকিও রয়ে গেছে। যদি তালিকা করতে বলা হয় তো সেই তালিকা অনেক লম্বা। যেমন শীতকালে আমরা চলন বিল দেখিনি, সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড দেখিনি। শেরপুর টু নেত্রকোণা বর্ডার রোড ধরে ঘোরা হয়নি এখনো। বান্দরবানের পুকুরপাড়া যাওয়ার প্রচণ্ড শখ আমাদের, বগুড়ার জামাই মেলা দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
ওদিকে সুন্দরবনের দুবলার চরের রাস মেলা দেখা হয়নি। হাতিয়া দ্বীপে ক্যাম্পিং করার ইচ্ছে রয়েছে বেশ, ক্রিসতংয়ের জঙ্গলের মাদার ট্রি ছুঁয়ে দেখা হয়নি, জামালপুরের ঘোড়া বিক্রির বাজারসহ আরও অনেক অনেক কিছু দেখা হয়নি। ইচ্ছে আছে ভ্রমণের এই অনন্ত পথ ধরেই যতটা সম্ভব সব দেখে নেওয়ার।'
এমন আশাবাদী আর প্রাণবন্ত এই ভ্রমণপাগল জুটির জন্য এই পথ কখনো শেষ না হোক। জীবনের পথে ঘুরে বেড়াক যাযাবর ইচ্ছের দল।
Comments