হিম্বা গ্রাম: কালাহারির বুকে এক টুকরো মরূদ্যান

কালাহারি

বহু বছর ধরে বিশ্বভ্রমণের প্রক্রিয়ায়, অনেকদিন ধরেই আমাদের ঘোরাঘুরির বাকেট লিস্টে ছিল নামিবিয়ার নাম। তাই যখন প্রথমবার সেখানে গেলাম, স্বপ্নের মতোই মনে হলো। নামিবিয়া থেকে নিজেরাই গাড়ি চালিয়ে একে একে পেরিয়ে গেলাম বতসোয়ানা, নামিবিয়ার বহু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। অকাভাঙ্গো বদ্বীপ, কালাহারি মরুভূমি- বাদ যায়নি কিছুই।

তবে এই পুরো যাত্রার সবচেয়ে অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল উত্তর নামিবিয়ার একটি হিম্বা গ্রামে। সেখানে গিয়ে মনে হয়েছিল, ঘড়ির কাঁটা থমকে গেছে। এতোশা ন্যাশনাল পার্ক থেকে আমরা এই গ্রামটিতে গাড়ি চালিয়ে যাই, যাতে এক ঘণ্টার মতো লেগে যায়। প্রচণ্ড গরম ছিল, তাই যাত্রার প্রতিটি মুহূর্তই মনে হচ্ছিল প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই। এ অঞ্চলের অধিবাসীরা কীভাবে যে দিনযাপন করেন, তা নিয়ে মনে বহু প্রশ্ন জাগছিল। এত এত শূন্যতার মধ্যে, এত কম পেয়েও তারা কীভাবে বাঁচেন, কে জানে।

মরুদ্যান

১১৭টি দেশ ঘোরার পর বিশ্বের প্রাচুর্য আর দারিদ্র্য, দুটোই খুব ভালোমতো চোখে গেঁথে গেছে। নিজেরাও সে অভিজ্ঞতা পেয়েছি। কিন্তু হিম্বা গ্রামটি ছিল সবচাইতে আলাদা। বস্তুগত প্রাচুর্যই যে আদতে মানুষের জীবনের সুখের উৎস নয়, তা খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছিল এ গ্রামে কাটানো সময়টুকু।

আধা-যাযাবর ধরনের হিম্বা লোকজন তাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে খুব ভালোভাবে যুক্ত। তারা এমন একটি জগতে বাস করেন, যেখানে গতিময় মানবসমাজের কোনো যোগাযোগ নেই। ছিমছাম, সহজ-সরল গ্রাম। মাটির কুঁড়েঘর, ঘাসের ছাদ আর একেবারে মাটির সঙ্গে গেঁথে থাকা জীবনবোধ। এখানে নেই কোনো বিলাসবহুলতা কিংবা আধুনিক ভোগ্যপণ্যের আরাম। কাঠফাটা গরম, শুকনো মাটি আর জীবজন্তু ঘিরে এখানকার জীবন চলে যায়। এখানে মানুষের ভূমিকা মনিবের নয়, এদেরই সঙ্গে পৃথিবী মাকে ভাগ করে নেওয়া সন্তানের। এখানে সবাই মিলে সৌন্দর্যের নির্যাসটুকু ভাগাভাগি করে নেয়।

গ্রামে ঢোকার পর থেকেই আমাদের কপাল থেকে ঘাম ঝরছিল। কিন্তু গ্রামবাসীকে দেখে মনে হচ্ছিল, গরমে তাদের কিছুই আসছে-যাচ্ছে না। নারীরা ঐতিহ্যবাহী লাল ওকরা পোশাক পরে আছেন, ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছেন। তাদের গতি শ্লথ। দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে কোথাও কোনো তাড়াহুড়া নেই। তাদের অস্তিত্বের সঙ্গেই মেখে আছে এক দীর্ঘ প্রশান্তির ছায়া।

আফ্রিকা

একজন দোভাষীকে নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে বসলাম। তাদের মুখে কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই, গলার স্বর শান্ত। ওদের দৈনন্দিন জীবনের গল্প খুব আগ্রহ নিয়ে শুনলাম। কালাহারির এই মধ্যপ্রান্তে কোথাও কোনো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই। কিন্তু এ গ্রামের বাসিন্দাদের যার যা দরকার, তার সবই রয়েছে। একে অপরের সঙ্গ, নিজেদের ভিটেবাড়ি আর শতাব্দীপুরোনো ঐতিহ্যের উপহারের সঙ্গেই তাদের বেঁচে থাকা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা এভাবেই আছেন। আর এই বেঁচে থাকার মধ্য দিয়ে তারা সুখী হওয়ার এমন একটি গোপন মন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছেন, যা আমরা হয়তো অনেকেই ভুলে বসে আছি। আর তা হচ্ছে, প্রাচুর্য সুখের উৎস নয়।

মরুভূমির মরুস্থলে ভীষণ দাবদাহে জীবন যেখানে অসম্ভব মনে হয়, সেখানে প্রকৃতির সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে বাঁচার শিল্পটা রপ্ত করেছেন হিম্বারা। পরিপূর্ণ হওয়ার জন্য তাদের কোনো অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন হয় না। নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক, সম্প্রদায় আর পরিপার্শ্বের সঙ্গে তাদের যোগাযোগই তাদের প্রাণটাকে জিইয়ে রাখে।

আফ্রিকা

আমরা সুখ বলতে কী বুঝি? অর্থ-বিত্ত, যশ-খ্যাতি। কিন্তু মরুভূমির বুকে জেগে থাকা এই ছোট্ট গ্রামটিতে অন্য চিত্রই দেখলাম। এমন এক সম্পদ, যা ডলার কিংবা স্বর্ণের মাপকাঠিতে মাপা যায় না। তাকে বুঝতে হয় ভালোবাসা, ঐতিহ্য আর নিজের করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে।

এই গ্রামে গিয়েছিলাম একটি দারুণ আরামদায়ক, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে। তাতে খাবার, পানি, বিশ্রামের জায়গা-সবই ছিল। আমরা যখন ইচ্ছে আমাদের আধুনিক জীবনে ফিরে যাওয়ার চাবিকাঠি নিয়েই সেখানে গিয়েছিলাম। গ্রামটিতে ঘুরেফিরে মনে হলো, এসব কিছু না থেকেও তাদের আনন্দে কোনো ভাটা পড়ছে না। বোধহয় তারাই সত্যিকারের সম্পদশালী।

গ্রামটি থেকে ফিরে আসার সময় নিজের মধ্যে বারবার অনুভব করছিলাম যে, হিম্বাদের এই গ্রামটি আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে- কম পাওয়াতেই আনন্দ। সুখের খোঁজ পাওয়া যায় সহজ-সরল জীবন আর বর্তমানের উপভোগ্যতায়।

হিম্বা গ্রামের অভিজ্ঞতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমরা কতটা সৌভাগ্যবান। এই কারণে নয় যে আমাদের কাছে বস্তুগত সুখ আছে, বরং এজন্য যে আমরা যেমন ইচ্ছে জীবনটাকে বাঁচার সুযোগ এখনো হারাইনি। পৃথিবীতে বহু লোকের কাছে এইটুকুও নেই। তবু তারা ছোটখাটো বিষয়ে আনন্দ খুঁজে নিতে পারেন। অনেক সময় আমরা এত বেশি আরামে থাকি যে, তার জন্য কৃতজ্ঞ হতেই ভুলে যাই।

এই যাত্রা থেকে প্রাপ্ত উপলব্ধি হলো এই যে, সুখ আমাদের কাছে থাকা বস্তুতে নেই বরং আমাদের জীবনের মূল্যবান মূল্যবোধে রয়েছে। এবং কখনো কখনো আটপৌরে জীবনেই সুখের সুর বাজে। নামিবিয়ার সেই কঠোর-কঠিন উত্তপ্ত মরুভূমিতে আমাদের অবশেষে মনে পড়ে যায়, জীবন মানে পুঞ্জীভূত দ্রব্য কিংবা সামগ্রী নয়, জীবন মানে ভালোবাসার আদান-প্রদান ও জীবনের জয়গান।

ভ্রমণের পথে এরপর যতটা এগিয়েছি, নিজের সঙ্গে বয়ে নিয়ে গেছি নতুন বোধ। অনুভব করেছি সত্যিকারের প্রাচুর্য আর জীবনের প্রতি এক রাশ কৃতজ্ঞতা।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

 

Comments

The Daily Star  | English
us tariff impacts bangladesh synthetic shoe exports

US tariff threatens booming synthetic shoe exports

The country’s growing non-leather footwear industry now faces a major setback as a steep new tariff from the United States threatens its growth

14h ago