সন্তানের আগমন কি দাম্পত্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারে, করণীয় কী

সন্তানের আগমন কি দাম্পত্যে দূরত্ব তৈরি করতে পারে
ছবি: সংগৃহীত

ভালোবাসা, বন্ধুত্ব এবং একই লক্ষ্য অর্জনের অভিপ্রায় নিয়ে মানুষ বৈবাহিক জীবন শুরু করে। তবে মাঝে মাঝে কিছু বিষয় সুন্দর দাম্পত্যে ছন্দপতন ঘটায়, তৈরি হয় দূরত্ব। সন্তানের আগমন দম্পতির জন্য আনন্দের ও আবেগের বিষয় হলেও, অনেক দম্পতির জীবনে নানা সমস্যা নিয়ে হাজির হতে পারে জীবনের এই পরিবর্তনটি।

সন্তানের জন্মের পর তার যত্ন নেওয়া এবং তার ভালো-মন্দটাই বাবা-মায়ের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে ওঠে। তার দিকে বাড়তি মনোযোগ দিতে গিয়ে অনেক দম্পতিই নিজেদের সম্পর্কের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেদের অজান্তেই অবহেলা করতে শুরু করেন। ফলে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং অনেকসময় হয়ও।

সন্তানের জন্ম দাম্পত্য সম্পর্কে কতটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে, সে ব্যাপারে কথা বলেছেন চট্টগ্রামভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র 'সিরিনিটির কনসালট্যান্ট মনোবিদ শাহরিনা ফেরদৌস

শাহরিনা ফেরদৌস বলেন, 'সন্তানের জন্ম বৈবাহিক জীবনে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। তখন যেকোনো দম্পতির কাছে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের চেয়ে বাবা-মা পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে ওঠে। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, যেখানে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে বাবা-মায়ের ওপর দায়িত্বের চাপ শুধু বেড়েই চলেছে, দম্পতিরা নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব অসহ্যকর অবস্থায় পৌঁছার আগ পর্যন্ত বুঝতেই পারে না যে তারা দিন দিন পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।'

ফেরদৌস বলেন, 'দাম্পত্যে দূরত্ব কোনো একক ঘটনার ফল নয়। বরং অন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের চাপে হাজার হাজার সম্ভাব্য একসঙ্গে কাটানোর মতো মুহূর্ত হারিয়ে যাওয়ার হতাশা থেকে এমন পরিস্থিতির তৈরি হয়।

যেমন স্বামী হয়তো মনে করছেন পরিবারকে সমর্থন ও খরচ দেওয়ার কাজে তাকে বেশি ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। তাই তিনি পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। তিনি হয়তো মনে করছেন, বর্ধিত পরিবারে এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক। 

অন্যদিকে, স্ত্রী মনে করেন স্বামী তার প্রতি আগের মতো যত্নশীল নন। আগে তাদের নিজেদের মধ্যে হয়তো ভালোবাসাময় অভিব্যক্তি বিনিময় হতো কিংবা বিশেষ মুহূর্ত থাকতো। কিন্তু বাবা-মায়ের দায়িত্ব এসবকে ছাপিয়ে যাওয়ার ফলে দম্পতিরা অনেক সময় একান্তে সময় কাটাতে পারেন না। এই অসন্তুষ্টি তাদের সম্পর্কে খারাপ প্রভাব ফেলে এবং পারস্পরিক দূরত্ব আরও বাড়াতে ভূমিকা রাখে।'

অভিমানের গভীরতা বোঝা

দম্পতিদের অবশ্যই বুঝতে হবে, আর্থিক স্থিতিশীলতাই সুস্থ মানসিক সম্পর্কের জন্য যথেষ্ট নয়। এমনকি স্থিতিশীল আয়ের পরিবারেও বাবা-মায়ের দায়িত্ব এবং ব্যক্তিগত প্রত্যাশার চাপে মানসিক চাহিদাগুলো অপূর্ণ থাকতে পারে।

অন্যান্য মনোবিজ্ঞানীর মতো ফেরদৌসও জোর দিয়ে বলেন যে, পারস্পরিক বোঝাপড়াই এই কঠিন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠার মূল চাবিকাঠি। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই স্বামীর প্রধান দায়িত্ব পরিবারের খরচ জোগানো, তবে দাম্পত্যে মানসিক চাহিদাকে গুরুত্ব দেওয়া এবং পরস্পরের যত্ন নেওয়াও উভয়ের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ। স্বামী হয়তো মনে করতে পারেন যে তিনি পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করে যাচ্ছেন, তবে তাকেও স্ত্রীর মানসিক চাহিদাকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং স্ত্রীর যত্ন নিতে হবে।

অন্যদিকে, স্ত্রীকেও বুঝতে হবে যে পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন নিশ্চিতে স্বামীকে কতটা চাপ নিতে হচ্ছেন এবং এই বাড়তি চাপ হয়তো তার ভালোবাসার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে পারে। কখনও কখনও আপস না করে কেবল সমন্বয় করেও পরিবর্তনগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। এটা হয়তো সবসময় সহজ নাও হতে পারে। তবে পরিবর্তনগুলোকে সমন্বয় করে নিতে পারলে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়া যাবে।

বিশেষজ্ঞ মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া

প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে ফারাক যখন অনেক বেড়ে যায়, তখন ভালোবাসাময় সম্পর্ক পুনঃরুদ্ধার করাটা প্রায় অসম্ভব মনে হয়। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বিশেষজ্ঞ থেরাপিস্টরা দম্পতিদের সম্পর্কের জটিলতা দূর করে তাদেরকে আগের স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করতে পারেন।

বিশেষজ্ঞরা কীভাবে দম্পতিদেরকে স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরতে সহায়তা করেন জানতে চাইলে ফেরদৌস বলেন, 'নিত্যদিনকার ব্যস্ততায় ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া দাম্পত্য সম্পর্কে আবারও প্রাণ ফিরিয়ে আনতে মনোবিজ্ঞানীরা অনেক সময় স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা অ্যাসাইনমেন্ট দেন। এসব কাজ সম্পন্ন করতে হলে পরস্পরের প্রতি গভীর বোঝাপড়া প্রয়োজন।'

তিনি বলেন, 'সঙ্গে সঙ্গে হয়তো এর ফলাফল বোঝা যাবে না। যেহেতু চাহিদাগুলো বস্তুকেন্দ্রিক না, বরং মানসিক, তাই সম্পর্ককে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনাটা কঠিন। তবে মাঝে মাঝে দম্পতিরা তাদের পুরোনো বোঝাপড়াটা নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পারেন এবং এটি তাদের জন্য আরও বেশি সুফল বয়ে আনতে পারে।'

মনোবিজ্ঞানীরা যে অ্যাসাইনমেন্ট দেন, সেটি সম্পন্ন করতে হলে উভয়কেই পরস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে হয়।

থেরাপি প্রক্রিয়াটি কখনোই একমুখী নয়। যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কের অন্যতম ভিত্তি এবং সঙ্গীর চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা এবং উদ্বেগ প্রকাশের মাধ্যম। স্বাভাবিক সম্পর্কের জন্য একে অন্যের সঙ্গে যেকোনো বিষয়ে খোলমেলা কথা বলা উচিত। খোলামেলা কথা বলার মাধ্যমে একে অপরের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আরও গভীর বোঝাপড়া এবং মানসিক চাহিদা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানার সুযোগ থাকে।

দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে খোলামেলা আলোচনা করে যুক্তিসঙ্গত প্রত্যাশা গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দম্পতিরা তাদের আবেগীয় চাহিদা সম্পর্কে স্পষ্টভাষায় কথা বলে একসঙ্গে একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে পারে। এটি বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে বাধা দূর করে অযৌক্তিক প্রত্যাশার পারদকে নিম্নমুখী রাখতে ভূমিকা রাখে, যা একটি শক্তিশালী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত।

সময়ের সঙ্গে সম্পর্কের কিছু পরিবর্তন অনিবার্য। দম্পতিদেরকে এই পরিবর্তন সাদরে গ্রহণের এবং পরিবর্তিত বৈবাহিক সম্পর্কের সৌন্দর্য খোঁজার পরামর্শ দেওয়া হয়। সন্তানের জন্ম হয়তো সম্পর্কের গতিশীলতা পরিবর্তন করতে পারে, তবে এটি সম্পর্কের নতুন দ্বারও উন্মোচন করে দেয়।

সন্তানের জন্ম বৈবাহিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করে এবং সৃষ্ট জটিলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য পারস্পরিক বোঝাপড়া, যোগাযোগ এবং এমনকি বিশেষজ্ঞদের সহায়তারও প্রয়োজন হয়। সঠিক উপায় অবলম্বন করলে দম্পতিরা তাদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে সম্পর্ককে আবারও সুন্দর ও প্রাণোচ্ছ্বল করে তুলতে পারেন।

অনুবাদ করেছেন আহমেদ হিমেল

 

Comments

The Daily Star  | English

Large-scale Chinese investment can be game changer for Bangladesh: Yunus

The daylong conference is jointly organised by Bangladesh Economic Zones Authority and Bangladesh Investment Development Authority

42m ago