সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যে দাম্পত্য কলহের প্রভাব কতটা, সমাধান কী

সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যে দাম্পত্য কলহের প্রভাব
ছবি: সংগৃহীত

দাম্পত্য জীবনে যখন দুজন মানুষ একসঙ্গে থাকেন তখন মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝাঁটি হয়েই যায়। এই দাম্পত্য কলহের ঝড়ের ছাপ পড়ে আশপাশের মানুষদের ওপর। তবে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সন্তানদের ওপর।

এর ফলে সন্তানদের কেমন মানসিক ক্ষতি হয় এবং সে বিষয়ে বাবা-মা কী করতে পারেন তাই নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মাহবুব আজাদ।

ধরুন, রাফা বলে ছোট্ট একটি মেয়ে আছে, যার সঙ্গে স্কুলে তেমন কেউ বসতে চায় না। কারণ রাফা সহপাঠীর গায়ে হাত তোলে, ক্লাসে অল্পতেই মেজাজ হারিয়ে ফেলে, আবার অল্পতেই কেঁদে ফেলে। রাফার এই আচরণের পেছনের কারণ কী তা খুঁজতে গিয়ে জানা গেল তার বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহের কথা।

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মাহবুব আজাদ বলেন, শিশুদের কাছে আদর্শ হলো তাদের বাবা-মা। যখন সে তাদেরকে ঝগড়া করতে দেখে তখন তার মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা বোধ হয়, অনেকের মধ্যে আবার হিংস্র, ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধী আচরণ প্রকাশ পায়।

আমরা জানি যে পারিবারিক সহিংসতা শিশুর জন্য ক্ষতিকর। আর সেই ক্ষতি যে শুধু বাবা-মায়ের প্রকাশ্য ঝগড়াঝাঁটি ও সংঘর্ষের কারণেই হয় তা কিন্তু নয়। বাবা-মা যদি একে অপরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন, একজন আরেকজনকে অবহেলা করতে থাকেন, উপেক্ষা করে কথা বলেন তখনও কিন্তু শিশুদের ওপর বড় রকমের প্রভাব পড়ে। শিশুর মানসিক, আবেগ অনুভূতি, আচরণ এবং সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রেও তখন সমস্যা হতে পারে।

সন্তানরা বাবা-মায়ের ঠান্ডা যুদ্ধ  বা সম্পর্কে শীতলতা খুব সহজেই ধরতে পারে। অর্থাৎ মারামারি না করলেও পরিবারে যে বাবা-মার দ্বন্দ্ব রয়েছে তার শিশুরা বুঝতে পারে। একটি শিশু ছয় মাস বয়স থেকেই পারিবারিক অশান্তি অনুভব করতে পারে। তার মানে, একটি শিশু যদি ছয় মাস বয়স থেকেই বুঝতে পারে তার ওপরের ছায়া নড়বড়ে, সে কতটুকু মানসিক শক্তি নিয়ে বেড়ে উঠবে ভেবে দেখুন।

মাহবুব আজাদ আরও বলেন, বাবা-মায়ের কলহের নেতিবাচক প্রভাব হিসেবে সন্তানদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে পারে, বাচ্চাদের মস্তিষ্কের প্রাথমিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা তৈরি হতে পারে, স্কুলে তার আচার-আচরণে সমস্যা হতে পারে। শিশু বিষণ্ণতায় ভুগতে পারে, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা দেখা যেতে পারে। আর ছেলেমেয়ে যদি একটু বড় হয় তবে তাদের মধ্যে নিজের ক্ষতি নিজে করা প্রবণতা দেখা যায়।

ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। পরিবারিক কলহের মধ্য দিয়ে যে ছেলে সন্তান বড় হয়, বড় হওয়ার পর তার মাদকাসক্তি, অবাধ্যতা, মারামারি করার প্রবণতা বেশি রাখা যায়। অপরদিকে কন্যা শিশুরা চাপা স্বভাবের হওয়ার কারণে ভেতরে তারা চাপ অনুভব করে এবং অস্থিরতা দেখা যায়। পরে তাদের মধ্যে সংসারের ভয়, ডিপ্রেশনসহ বিভিন্ন ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

মাহবুব আজাদ জানান, পরিবারের দাম্পত্য কলহের নেতিবাচক প্রভাব শিশুদের চেয়ে টিনএজারদের ওপর বেশি। কারণ তাদের মধ্যে ভালোমন্দের বোধের জন্মটাও ইতোমধ্যে হয়ে যায়। এমনকি বাবা-মা সন্তানদের কাছে কলহ বন্ধের ঘোষণা দিলেও তারা এই মিথ্যা আচরণ সহজেই ধরতে পারে। আতঙ্কিত হয়ে বাবা-মায়ের ঝগড়া থামাতে নিজেরাই উদ্যোগী হয়। একটু বড় হওয়া সন্তান নিজের ক্ষতি নিজে করতে চায়, অনেকে আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে। বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে যেতে পারে, নিজের ইচ্ছাকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যায়।

মাহবুব আজাদ বলেন, অনেক সময় বাবা-মা ঝগড়া করতে করতে সন্তানদের টেনে নিয়ে আসেন পক্ষপাতিত্ব করার জন্য। অনেক সময় ভিকটিম রোল প্লে করেন এবং সঙ্গীর সর্ম্পকে নেতিবাচক কথা সন্তানকে বলেন। এটি শিশুকে মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে ফেলে দেয়। এখানেই কিন্তু সমস্যার শেষ নয়। এর ফলে শিশুরা শুধু তাদের নিজেদের জীবনেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, এর প্রভাব পড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মের ওপরেও। এটা একটা চক্রের মতো। কারণ আজকে যারা শিশু, আগামীতে তারাই কিন্তু শিশুর বাবা-মা। আমরা যদি সুখী জীবন চাই তাহলে কোনো একটা সময় এই চক্রটা ভেঙে দিতে হবে।

সন্তানের ওপর যে পারিবারিক কলহের প্রভাব পড়ছে এই সম্পর্কে কিন্তু সব বাবা-মা অবগত থাকেন। ছোটখাটো ঝগড়ার পর বাবা-মায়ের সমঝোতা সন্তানকে প্রশান্তি দেয়। এই যে বাবা-মা কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্ক করেন এবং সমাধান করে ফেলেন এটা থেকেও শিশুরা ভালো শিক্ষা নিতে পারে। নিজেদের জীবনের এই শিক্ষা কাজে লাগাতে পারে।

মাহবুব আজাদ বলেন, দাম্পত্য কলহের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে না পারার কারণে সন্তান ট্রমার শিকার হতে থাকবে প্রতিনিয়ত। ঝগড়ায় হয়তো একপক্ষ জিতে যাচ্ছেন। এদিকে আপনার সন্তান ভয় পাচ্ছে, অসহায় বোধ করছে। তাই দ্বন্দ্বের জড়ানোর আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন এই জিতে যাওয়ায় আসলে আপনার কতটুকু লাভ হলো? পারিবারিক কলহকে কেন্দ্র করে বাচ্চাকে কখনোই যেকোনো একজনের পক্ষ নিতে বাধ্য করবেন না বা তার কাছে একজন আরেকজনের খারাপ দিক তুলে ধরবেন না। সবসময় সংঘর্ষের পথে না গিয়ে চেষ্টা করুন ধৈর্য ধরে কথা বলার। সন্তানদের সামনে কখনোই তর্কে জড়ানো উচিত নয়। পরিস্থিতি যদি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায় তবে বাচ্চাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন। ঝগড়ার আগে চিন্তা করুন আশপাশের মানুষদের ওপর কী ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। নিজেদের কিছু ভুলের জন্য আপনার সন্তানের সুন্দর শৈশব যেন ট্রমা না হয়ে যায়।

তিনি পরামর্শ দেন, দাম্পত্য কলহের ফলাফল যদি সন্তানের ওপর স্থায়ী প্রতীয়মান হয় তবে বিষয়টি এড়িয়ে না গিয়ে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Govt to expedite hiring of 40,000 for public sector

The government has decided to expedite the recruitment of 6,000 doctors, 30,000 assistant primary teachers, and 3,500 nurses to urgently address the rising number of vacancies in key public sector positions.

7h ago