২০২৫ সালে এসেও এমবিএ করা কতটা যৌক্তিক?

বহুদিন আগের ফেডএক্সের একটি বিজ্ঞাপনে এমবিএ নিয়ে মজার একটি গল্প ছিল। নতুন একজন কর্মী এমবিএ করেছেন, তাই তিনি শিপিংয়ের কাজ করতে অনীহা দেখান।
যখন তার বস এসে এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন, তখন ওই কর্মীর সোজা উত্তর, 'আপনি বুঝতে পারছেন না! আমার কিন্তু এমবিএ ডিগ্রি আছে।' বসের পাল্টা উত্তর আসে, 'ওহ! আপনি এমবিএ করেছেন? তাহলে তো আপনাকে শুরু থেকে শেখাতে হবে।'
দুই দশকেরও আগের এই বিজ্ঞাপনটির সঙ্গে কিন্তু মিল পাওয়া যাবে ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটেরও।
সাধারণত ম্যানেজমেন্ট বা ব্যবস্থাপনা খাতে এমবিএ ডিগ্রিকে বিশেষ দক্ষতা হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। অনেকের এটিও ধারণা যে এমবিএ করা থাকলেই করপোরেট জগতে তরতর করে এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু এখন সময় অনেকটাই বদলে গেছে। বদলেছে চাকরির বাজারের দৃশ্য। আর সেইসঙ্গে বদল দেখা যায় বিভিন্ন ডিগ্রির গুরুত্বের ক্ষেত্রেও। আজকের বাজারে এমবিএ ডিগ্রিধারীরাও চাকরি পেতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তাই এমবিএর ওপর কিছুটা সন্দেহ জন্ম নেওয়াটাও দোষের কিছু নয়।
২০০০ সালের দিকে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান– যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (আইবিএ) আর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গা থেকেই এমবিএ করা যেত। আর তাই যারা এমবিএ সম্পন্ন করবেন, তারা খুব সহজেই চাকরি পেয়ে যাবেন– এই বিষয়টিও পরিচিত ছিল সবার কাছেই।
তবে গত এক দশক ধরে সারা দেশে এত বেশি বিজনেস ডিগ্রির চল হয়েছে যে পাবলিক বা প্রাইভেট, যেকোনো ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়েই এমবিএ করা যাচ্ছে। আর এতে করে বেড়ে গিয়েছে এমবিএ ডিগ্রীধারী চাকরিপ্রার্থীদের সংখ্যাও। অতঃপর চাকরির দৌড়টা আরো কঠিন হবে, এ আর আশ্চর্যের কী! কিন্তু এসব কিছু জানার পরও কেন অনেকেই দুই বছরের বাড়তি এই ডিগ্রিটির পেছনে আজও ছুটে যাচ্ছেন এবং সেই বাড়তি সময়টুকু নিজেদের কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছেন না?
বাংলাদেশের ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রিগুলো নিয়ে সবচেয়ে বড় সমালোচনা হচ্ছে, এতে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অনেক বিদেশি প্রোগ্রামে কাস্টমাইজ করার মতো ডাবল এমবিএ বা এমএস ডিগ্রিতে জলবায়ু থেকে শুরু করে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সব খাতেই সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের এমবিএর চিত্রটা এমন নয়। এখানকার এমবিএ কোর্সগুলো সবসময় একই গণ্ডিতে ঘুরপাক খায়। ম্যানেজমেন্ট, ফিন্যান্স, মার্কেটিং ইত্যাদি বিষয়ই ঘুরেফিরে আসে। তাই খুব একটা নতুন কিছু শেখার সুযোগ থাকে না।
একটি দেশীয় আইটি কোম্পানির এইচআর এক্সিকিউটিভ সৈয়দা ফাইজা বলেন, 'আমার মনে হয় না এমবিএ করলে কারো দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। একজন বিজনেস শিক্ষার্থী হিসেবে আমার মনে হয়েছে, আমাদের আন্ডারগ্র্যাডেও এসব বিষয়ই পড়ানো হয়, বরং আরেকটু ভালো করে শেখানো হয়।'
চাকরিদাতার দৃষ্টিকোণ থেকে এমবিএ ডিগ্রির চেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে এমবিএ প্রাপ্তির প্রতিষ্ঠানটি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিদ্যমান মর্যাদাকে তারা একটি বাড়তি অর্জন হিসেবে পরিমাপ করে থাকেন।
তবে চাকরির বাজারে প্রাসঙ্গিক থাকতে এই ডিগ্রিটিকে সবসময়ই শক্তিশালী দিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মধ্যম মান থেকে শুরু করে অভিজ্ঞ পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে অনেকেই এমবিএ ডিগ্রিকে আবেদনের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।
তবে সবারই যে এমবিএ করার দরকার রয়েছে, এমনটা মোটেও নয়। এটি বরং ব্যবসায় বিভাগের বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়তি অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত অর্জন হিসেবে বেশি কাজে লাগে। যারা নিজেদের তাত্ত্বিক ব্যবসায়িক জ্ঞান বৃদ্ধি করতে চান কিংবা স্ব-উদ্যোগে ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের জন্য এই ডিগ্রিটি অপেক্ষাকৃত বেশি ফলপ্রসূ। কারণ এটি ছাড়া ব্যবসায়িক জ্ঞান সম্পর্কে শিখতে পারাটা তাদের জন্য মুশকিল। তবে বিজনেসের শিক্ষার্থীদের জন্য এমবিএর গুরুত্বটা এখনও অস্পষ্ট।
স্নাতক সম্পন্ন করার পর কেউ যদি বাড়তি কারিগরি পড়াশোনায় এগোতে চান, তবে তাদের জন্য এমবিএর চাইতে বেশি কার্যকর হবে অন্য ডিগ্রিগুলো। যেমন– ফিন্যান্সের জন্য চার্টার্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট (সিএফএ), প্রক্রিয়াজাত উন্নয়নের জন্য সিক্স স্টিগমা, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের জন্য সার্টিফায়েড সাপ্লাই চেইন অ্যানালিস্ট ইত্যাদি।
বিশেষ করে বাংলাদেশের এমবিএ প্রোগ্রামগুলোর সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দিক হচ্ছে, স্নাতককালীন শূন্যস্থানগুলো পূরণ করতে না পারা। বেশিরভাগ কারিকুলামই সেকেলে। বর্তমানে পাল্টে যাওয়া ব্যবসায়িক চিত্র, যাতে কিনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জয়জয়কার– সেখানে পুরোনো আমলের কারিকুলাম একেবারেই অকেজো।
ঢাকার একটি সুপরিচিত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ গ্রাজুয়েট ওয়াসেকা আলম এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা জানান।
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের এমবিএ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রন্থগত বিদ্যা। মাত্র কয়েকটি কোর্সেই আমাদেরকে দলীয় কাজে বিভিন্ন কারখানায় পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও ব্যবসা সম্পর্কে কর্মীরা আমাদেরকে খুব একটা বিস্তারিত বর্ণনা দিতে চাননি। আমি বিবিএ, এমবিএ দুটোই করেছি। কিন্তু সত্যি বলতে, নতুন কিছুই শিখিনি। স্নাতকের সময়ই এসব কিছু আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। এমনকি আমার ও এবং এ লেভেলের বিজনেস স্টাডিসেও এই বিষয়গুলোর অনেকটাই শেখানো হয়েছে। তবে যারা ব্যবসায়িক ব্যাকগ্রাউন্ডের নন, তারা চাইলে নিজেদের ব্যবসা দাঁড় করানোর জন্য বা করপোরেট জগতে নিজের স্থান করে নিতে চাইলে এমবিএ করতে পারেন। কিন্তু ব্যবসায়িক শিক্ষার্থীদের জন্য এটি তেমন নতুন কোনো অভিজ্ঞতা নিয়ে আসবে না। আমার মনে হয় না, চাকরির জন্যও এটি খুব বেশি দরকারি কিছু।'
ওয়াসেকার কথায় একটি জরুরি বিষয় সামনে এসেছে, আর তা হচ্ছে প্রায়োগিক শিক্ষার অভাব। এমবিএ প্রোগ্রামের শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন বাস্তবিক ব্যবসায়িক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জ্ঞান, যার মাধ্যমে তারা বিভিন্ন জটিল পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু এই প্রোগ্রামে যদি তা করা সম্ভব না হয়, তাহলে বিনিয়োগটা খুব একটা সফল হবে না। কারণ শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞান যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন হাতে-কলমে শিক্ষা।
তবে এমবিএ যে পুরোপুরি বৃথা, তাও নয়। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এটি খুব একটা কাজে না আসলেও ব্যক্তির নেটওয়ার্কিং দক্ষতার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। ব্যবসায়িক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যে বিস্তৃত পরিসরের পেশাজীবীরা আসেন, তাদের সঙ্গে যথাযথ যোগাযোগের মাধ্যমে ক্যারিয়ারের অনেক বন্ধ দরজা খুলে যেতে পারে।
ফাইজা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বললেন, 'আমি ভাগ্যবান যে এমবিএ করার সময়ে আমার কয়েক বছরের এইচআর খাতে কাজ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাই আমি অন্য কোম্পানিতে আরও বেশি ভালো অবস্থান ও বেতন পেয়ে ক্যারিয়ারে এগিয়ে যেতে পারছি।'
এমবিএর মাধ্যমে ক্যারিয়ারের একটি প্রাথমিক উন্নতি ঘটলেও দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যের উৎস হচ্ছে ধারাবাহিক শিখন প্রক্রিয়া, নতুন পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের দক্ষতা এবং গতিশীল ব্যবসায় জগতের প্রাসঙ্গিক থাকার অভ্যাস। আমাদেরক মনে রাখতে হবে, এমবিএ এমন কোনো সোনার কাঠি নয়, যার জাদুতে ক্যারিয়ারের সব মুশকিল আসান হয়ে যাবে। তবে চাকরিক্ষেত্রের প্রথম ধাপগুলোতে পা রাখার জন্য এমবিএ একটি সহায়ক ডিগ্রির ভূমিকা পালন করতে পারে। ব্যাংকিং, ফিন্যান্স, কনসাল্টিং ও প্রযুক্তির বিভিন্ন খাতে এমবিএ সাহায্য করবে।
আর যেহেতু এমবিএর নামডাক এখনো কমে যায়নি, তাই চাকরির বাজারে নতুনদের ক্ষেত্রে এই ডিগ্রিটি সামনে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ হিসেবে কাজ করবে।
এ বিষয়ে ফাইজা বলেন, 'এমবিএর তকমা থাকলে খুব সহজে নেতৃত্বের জায়গায় পৌঁছে যাওয়া যায়।'
কিন্তু এমবিএ কি আদৌ এই ২০২৫ সালে এসেও প্রাসঙ্গিক? আসলে সবটাই নির্ভর করছে আপনার লক্ষ্যের ওপর। আপনি কোন খাতে কাজ করতে চাচ্ছেন, নিজের ক্যারিয়ারে কী ধরনের নতুনত্ব যোগ করতে চাচ্ছেন এবং এসব বিষয়ে এমবিএ আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারে– সেটিই মূল কথা।
অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী
Comments