ফোর্বস ‘৩০ অনূর্ধ্ব ৩০’ তালিকায় স্থান পাওয়া জুবায়েরের গল্প

তুমুল ঝড় বৃষ্টির এক সকাল। কৃষিপ্রধান বন্যাকবলিত এক এলাকা থেকে ফেরার পথে সৈয়দ জুবায়ের হাসানের সহকর্মী হঠাৎ বলে উঠলেন, 'একটু গুগল চেক করো তো। ফোর্বস ''৩০ অনূর্ধ্ব ৩০'' তালিকা প্রকাশ করেছে।'
তালিকা খুলতেই কিছুক্ষণ পর সোশাল ইমপ্যাক্ট ক্যাটাগরিতে নিজের নাম দেখতে পেলেন সৈয়দ জুবায়ের হাসান। কিন্তু সে মুহূর্তে উচ্ছ্বাসে ভেসে যাওয়ার বদলে, তার চোখে ভেসে উঠছিল সেই সব কৃষকদের মুখ যারা এখনো প্রতিনিয়ত অনিশ্চিত ফলন আর দ্রব্যমূল্যের দুশ্চিন্তায় বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

সৈয়দ জুবায়ের হাসান তার এই স্বীকৃতিকে ব্যক্তিগত প্রাপ্তি হিসেবে দেখেন না। তিনি বলেন, 'কৃষি স্বপ্ন আমাদের জন্য কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়। এটি চলমান একটি আন্দোলন যা শুধু আমার স্বপ্ন নয়, কৃষকদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই সৃষ্টি হয়েছে।'
কৃষক পরিবার থেকে যাত্রা
কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়া জুবায়ের হাসানের ছোটবেলার স্মৃতিতে কম্পিউটারের মতো আধুনিক প্রযুক্তি বা চকচকে ক্লাসরুম নেই, আছে শুধু মাটির গন্ধ, কঠোর পরিশ্রম, আর একরাশ না বলা অসহায়তা।
তিনি বলেন, 'আমার বাবা জানতেন না জমিতে কতটা সার দিতে হবে, কীভাবে মাটি পরীক্ষা করতে হয় বা কখন ফসল বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যাবে। তিনি চার থেকে ছয় মাস কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলাতেন। কিন্তু শেষে ফসল বিক্রি করতে হতো দালালের নির্ধারিত যেকোনো মূল্যে। দরকষাকষির কোনো সুযোগ ছিল না, ছিল কেবল টিকে থাকার সংগ্রাম।'

এই বাস্তবতাই তাকে 'কৃষি স্বপ্ন' গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করে। ২০১৯ সালে যাত্রা শুরু করা এই স্টার্টআপটি ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধান নিয়ে আসে। ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত সবকিছুতেই সহযোগিতা করে কৃষকদের পাশে দাঁড়ায়।
মাঠে মাঠে প্রযুক্তির ছোঁয়া
যেই দেশে ৮০ শতাংশেরও বেশি কৃষক ক্ষুদ্র চাষি, সেখানে ঝাঁ চকচকে প্রযুক্তি তেমন কোনো কাজে আসবে না যদি সেটার বাস্তব ভিত্তি না থাকে। জুবায়ের হাসান সেটা শুরু থেকেই জানতেন।
তিনি বলেন, 'আমরা কৃষকদের হাতে শুধু একটা অ্যাপ তুলে দিয়ে সরে যাইনি। আমরা শুরু করেছি মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করার কিট দিয়ে। এর কারণ হলো, এই প্রাথমিক তথ্যটাই তাদের জানা ছিল না।'
কৃষি স্বপ্ন একেবারে স্থানীয় পর্যায়ে কাজ করে। টেকসই চাষাবাদ, জলবায়ু সহনশীল পদ্ধতি আর আর্থিক সচেতনতা এরকম নানা বিষয়ে আঞ্চলিক এজেন্ট এবং মাঠ পর্যায়ে সহায়তার মাধ্যমে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, 'আমরা কৃষকদের হাতে সহজ ডিজিটাল শেখার উপকরণ, ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ পৌঁছে দিয়েছি। আর চাষাবাদকে শুধু বাঁচার মাধ্যম থেকে আয় করার পথ হিসেবে দেখতে অনুপ্রাণিত করেছি।'
তবে চাষ পদ্ধতি উন্নত করলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না।
তিনি বলেন, 'অনেক কৃষক ভালো ফলন পেলেও বিক্রিতে পিছিয়ে ছিলেন। ভবিষ্যতের বাজার বিশ্লেষণ বা পরিবহন সুবিধা না থাকায় তারা দালালদের কাছে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হতেন।'
কৃষি স্বপ্ন এই ধারণাটি বদলে দেয়ার কাজ করছে। তাদের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কৃষকরা এখন ক্রেতা, সরবরাহকারী ও শহরের দোকানদারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারছেন।
ক্লিন এগ্রিকালচারঃ কেবল কথার কথা নয়
পুরো বিশ্ব যখন খাদ্য নিরাপত্তা ও জলবায়ুবান্ধব কৃষির দিকে নজর দিচ্ছে, তখন 'কৃষি স্বপ্ন' নীরবে কিন্তু দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশকে সেই পথেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
জুবায়ের হাসান বলেন, 'ক্লিন এগ্রিকালচার মানে শুধু কীটনাশকের ব্যবহার কমানো নয়। এটির অর্থ হল উৎপাদন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, জলবায়ুর সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা এবং কৃষকের মর্যাদা নিশ্চিত করা।'
তাদের প্রশিক্ষণ মডিউলগুলোতে নিরাপদ কীটনাশক ব্যবহার, প্যাকেজিং স্বাস্থ্যবিধি এবং জলবায়ু-সংবেদনশীল এলাকার উপযোগী ফসল নির্বাচন বিষয়গুলোই গুরুত্ব পায়। চর ও উপকূলীয় এলাকায় আকস্মিক বন্যা ও লবণাক্ত মাটি কৃষিকে বিপর্যস্ত করে তোলে। কৃষি স্বপ্ন সেইসব এলাকার কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম সরবরাহ করে যাতে তারা উপকৃত হয়।
জুবায়ের হাসান বলেন, 'এইসব অঞ্চলে কৃষিকাজ করা যেন অভিশাপ হয়ে না দাঁড়ায়। বরং কৃষি হোক এসব অঞ্চলের মানুষের টিকে থাকার লড়াইয়ে জয় এবং তাদের সহনশীলতার গর্ব।'
ভিন্ন ধরনের উদ্যোগ
সৈয়দ জুবায়ের হাসান কৃষি স্বপ্নের একজন সিইও হলেও তার কথা বলার ধরনটা প্রচলিত করপোরেট ভাষার মতো নয়। তার কথায় কোনো কঠিন দুর্বোধ্য শব্দ নেই। তিনি কথা বলেন সহজ সরল ভাষায় আর তার কথায় ফুটে ওঠে সহানুভূতি, দায়িত্ববোধ আর পরিবর্তনের স্বপ্ন।
তিনি বলেন, 'সোশ্যাল উদ্যোক্তা হওয়া তখনই সত্যিকার অর্থে কাজ করে, যখন সেটা আসে নিজের ব্যথা বা কষ্টের অভিজ্ঞতা থেকে। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে, তাই এটা সফল হয়েছে।'
তবে তিনি এটাকে রোমান্টিসাইজ করেন না।
তিনি বলেন, 'এটা কোনো গৌরবের যাত্রা না। সমস্যা সমাধানের মানসিকতা দরকার সত্যি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার বাস্তবায়নের ক্ষমতা। প্রথম চেষ্টা বিফল হলে দিক বদলাতে হয়।'
'কৃষি স্বপ্ন' শুরু হয়েছিল প্রযুক্তিনির্ভর একটি উদ্যোগ হিসেবে। আর এখন এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সেবাভিত্তিক ইকোসিস্টেম। হাসান মনে করেন এই পরিবর্তনের পথ সহজ ছিল না। এটিই তাদের সাফল্যের রূপকথা।
আগামীর পথচলা
২৭ হাজার ক্ষুদ্র কৃষককে তাদের নেটওয়ার্কে যুক্ত করে এবং ১৫টি অঞ্চলে কার্যক্রম পরিচালনা করে 'কৃষি স্বপ্ন' এগিয়ে যাচ্ছে। তবে তাদের লক্ষ্য শুধু ব্যাপ্তি বাড়ানো নয়। তারা আগে নিজেদের ভিত মজবুত করতে চায়, তারপর ধাপে ধাপে সম্প্রসারণ। তাদের দীর্ঘমেয়াদি স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে জানা যায়, আগামী তিন বছরের মধ্যে দেশের অর্ধেক কৃষককে পরিবেশবান্ধব ও জলবায়ু সহনশীল কৃষি পদ্ধতিতে যুক্ত করাই তাদের মূল লক্ষ্য। এটি নিঃসন্দেহে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ, তবে প্রজন্মের কষ্টকে প্রজন্মের পরিবর্তনে রূপান্তর করাও তো কম সাহসের নয়!
নিঃশব্দ এক আহ্বান
তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য পরামর্শ চাইতেই জুবায়ের হাসান বলেন, 'কেবল চাকরি থেকে পালানোর জন্য স্টার্টআপ শুরু করো না। শুরু করো তখনই যখন দেখবে কিছু একটা ঠিকঠাক চলছে না, আর সেটা না বদলানো পর্যন্ত তোমার ঘুম আসছে না।'
তিনি তিনটি গুণের কথা বললেন, যা প্রত্যেক উদ্যোক্তার মধ্যে থাকা উচিত। সেগুলো হলো- অনুভব করার ক্ষমতা (সহমর্মিতা), কাজ করার শৃঙ্খলা (কার্যকারিতা), এবং পরিবর্তনের সাহস (পরিবর্তনশীলতা)।
'দৃষ্টিভঙ্গি যদি কাজে পরিণত না হয়, তাহলে সেটা কেবলই দিবাস্বপ্ন', যোগ করেন তিনি।
সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে তিনি বলেন, 'স্বীকৃতি পাওয়া আনন্দের, কিন্তু এর পরদিনই শুরু হয় আসল লড়াই।'
আর সম্ভবত এখানেই লুকিয়ে আছে পরিবর্তনের মানদণ্ড। কে কোন তালিকায় নাম তুললেন সেটা বড় কথা নয়, বরং কারা ঝড়ের মধ্যেও বারবার ফিরে আসেন সেটাই আসল।
অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম
Comments