দেশের নারী চালকরা যেসব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন

দেশের নারী চালকদের চ্যালেঞ্জ
ছবি: অর্কিড চাকমা

কল্পনা করুন একটি দৃশ্য। যেখানে ঢাকার যানজটের মধ্যে একজন নারী গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন, আর তাকে ঘিরে রয়েছে অসংখ্য মানুষের দৃষ্টি। যার মধ্যে কারো কারো চোখে কৌতূহল, কেউ দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন, কারো কারো দৃষ্টি ওই নারী চালকের ওপরই নিবদ্ধ।

কারো চোখে প্রশংসা, কেউ আবার খানিকটা সন্দেহভরা চোখেই দেখছেন। যানজটের মধ্যে থেমে থাকা ইঞ্জিনের গুঞ্জন, তীর্ব হর্নের শব্দও যেন থেমে যায় কোনো নারীকে স্টিয়ারিং হাতে দেখলে। পাশ দিয়ে যাওয়া অন্য গাড়ির চালক, রিকশাচালক কিংবা পথচারীরাও এমনভাবে তাকান, যেন নারীর গাড়ি চালানোর দৃশ্যটি অন্যরকম, যেন দৃশ্যটি দেখার মতো।

এটা এমন এক কঠিন বাস্তবতা, প্রতিদিন বাংলাদেশে যার মুখোমুখি হন অসংখ্য নারী। সময়ের সঙ্গে দেশের সড়কগুলোয় নারী চালকের সংখ্যা বাড়লেও, স্বাভাবিকভাবেই পুরুষ চালকের সংখ্যার তুলনায় তা কম। এখনও সড়কে চালক হিসেবে পুরুষের আধিপত্যই চোখে পড়ে। যে নারীরা গাড়ি নিয়ে পথে নামেন তাদের সবাই কেবল নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাওয়ার জন্যই যে গাড়ি চালান তা নয়। অনেকের জন্য এটি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গ বদলানোর উপায়, অনেকের জন্য নিরাপদে পথ চলার উপায়ও।

গত সাত বছর ধরে গাড়ি চালাচ্ছেন বুশরা তাবাসসুম, যিনি একটি আইটি ফার্মের সিনিয়র এইচআর এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত।

তিনি বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে নারী চালকরা যোগ্য হন না। আর একথা প্রথম শুনে তিনি রীতিমতো বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

বুশরা বলেন, 'সব মানুষ একমত যে নারীরা চালক হিসেবে খারাপ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই ধারণাকে উপেক্ষা করতে শিখেছি আমি। এমনকি শুরুতে বন্ধুরাও গাড়ি চালানো দেখার আগে আমার দক্ষতা নিয়ে সন্দিহান ছিল।'

রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে অবিরামভাবে অন্যায় অভিযোগের সম্মুখীন হতে হয়েছে বুশরাকে।

সেসব কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'কখনো কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে দোষ যারই হোক না কেন, পুরো দায় আমার ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু সবসময়ই আমি এসবের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। পুরুষ চালক বা রিকশাচালক যেই সামনে থাকুক না কেন আমি যে অন্যায় করিনি তার দায় কখনও নিইনি।'

তবে অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়নি।

২০১৬ সালে ড্রাইভিং লাইসেন্স করেছেন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউএফটি) কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপর তানজি তানিয়া। কিন্তু তিনি এখনও গাড়ি চালানোর মতো আত্মবিশ্বাস অর্জনের জন্য রীতিমতো লড়াই করছেন।

তানজি তানিয়া বলেন, 'পুরুষ চালকদের পাশাপাশি রাস্তায় গাড়ি চালানোর জন্য অনেক বেশি সাহসী ও দৃঢ়চেতা হতে হয়। যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনার জন্য দায়ী করা হতে পারে আমাকে, সেসব ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যও সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয়। আমাদের দেশে ট্রাফিক আইনের তেমন প্রয়োগ নেই এবং প্রত্যেকেই নিজের খেয়াল-খুশি মতো গাড়ি চালান। পুরুষ চালকরা প্রয়োজন পড়লেই চিৎকার করে বা ঝগড়া করে সহজেই যেকোনো ঘটনার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারেন। কারণ আশপাশের লোকজন এতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমার পক্ষে তো আর এমন আচরণ করা সম্ভব নয়।'

নারী চালকরা প্রায়ই দর্শনীয় বিষয়ে পরিণত হন। তাদের প্রতি অযাচিত মনোযোগ দেওয়া হয়, অনেক বাজে মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া হয়, কখনও কখনও তো তাদের ভয়ও দেখানো হয়। ঢাকার ভেতরে কিছু এলাকায় পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো হলেও দেশের অন্যান্য স্থানে নারী চালকদের চ্যালেঞ্জ রীতিমতো ভয়াবহ।

বিকাশ ও ব্রিটিশ আমেরিকার টোব্যাকোর সাবেক কর্মী মাহমুদা পিয়া বলেন, 'কুমিল্লা জেলার মধ্যে গাড়ি চালানোর সময় আমি খেয়াল করেছি যে, অটোরিকশা চালকরা ভীষণ ব্যস্ত রাস্তার মধ্যেও হঠাৎ করে গাড়ি থামিয়ে আমাকে দেখতেন। তাদের দৃষ্টিতে নারী হয়ে আমি গাড়ি চালাচ্ছি এই বিষয়টি ছিল অবিশ্বাস্য। অনেক নারী যাত্রীও অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমাকে দেখতেন। অবশ্য ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকায়ও গাড়ি চালাতে গিয়ে প্রায় একই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার।'

বাংলাদেশে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়টি এমনিতেই উপেক্ষিত। ফলে সব চালককেই এক ধরনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে এসব ঝুঁকির পাশাপাশি যুক্ত হয় নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ। সড়ক দুর্ঘটনার ওপর ভিত্তি করে চালানো এক গবেষণা অনুযায়ী, নারীরা পুরুষদের তুলনায় নিরাপদ চালক। তবে গাড়ি চালানোর সময় আশপাশের মানুষদের ক্রমাগত নজরদারি নারী চালকের মনোযোগ ব্যাহতের অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করে।

প্রায় এক দশক ধরে দেশে-বিদেশে গাড়ি চালাচ্ছেন বিইউএফটির ফ্যাশন ডিজাইনিং বিভাগের অধ্যাপক শর্মিলি সরকার। ছাত্রাবস্থায় বাইসাইকেল চালানোর মাধ্যমে তার প্রচেষ্টা শুরু হয়। এরপর স্কুটার চালান এবং সবশেষে কেনেন গাড়ি।

ঢাকার রাস্তার অনিয়মের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'মানুষ সড়কের নিরাপত্তা নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নয়। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, আমি যখন দ্রুত গাড়ি চালিয়ে কোথাও যাচ্ছি তখন প্রায়ই দেখা যায় হুট করেই পথচারীরা হাত দেখিয়ে রাস্তা পারাপারের জন্য নামেন। তারা আশা করেন যে শেষ মুহূর্তে হাত দেখালেই চলন্ত গাড়ি থেমে যাবে। অথচ এত অল্প সময়ের জন্য গাড়ি থামানো অবিশ্বাস্য রকমভাবে কঠিন। এরপর যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে তার দোষও অনিবার্যভাবেই চালকের ওপর বর্তায়। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই বিষয়গুলো বুঝতে পারেন না।'

এইসব প্রতিকূলতার পাশাপাশি নারী চালকদের সবসময়ই নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়। যেমন অনেক জায়গায় যথাযথ পার্কিং থাকে না যা নারী চালকদের জন্য নিরাপত্তার সংকট তৈরি করে। অনেকেই যেকোনো স্থানে বা জনবিচ্ছিন্ন কোনো স্থানে খারাপ কোনো ঘটনা বা হয়রানির ভয়ে গাড়ি পার্ক করতে চান না। আবার নিরাপত্তাজনিত কারণে অসংখ্য নারী চালক ইচ্ছা থাকলেও উবারের মতো রাইড শেয়ারিং পরিষেবার কাজে নিয়োজিত হতে পারেন না।

বুশরা দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'কিছু জায়গা আছে যেখানে একা যাওয়া নিরাপদ নয়। আবার চারপাশের মানুষ সবসময়ই নারী চালকদের জন্য সমস্যা তৈরির চেষ্টা করেন।'

নিজের একটি কষ্টের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'একদিন আমি প্রবল বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। আমার সামনের একটি গাড়ি হুট করেই ব্রেক কষে। সেই গাড়ি থেকে একজন ব্যক্তি নেমে এসে জোর করে আমার গাড়িতে প্রবেশের চেষ্টা চালান। যেহেতু সেদিন আমি একা ছিলাম, তাই কোনো ঝুঁকি নিইনি। তিনি কিছুক্ষণ চেষ্টা করেন, এরইমধ্যে আমি সুযোগ বুঝে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সেখান থেকে চলে আসি।'

একইভাবে পিয়াও কিছু অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন যেখানে তাকে সাধারণ মানুষের কাছে নাজেহাল হতে হয়েছিল।

এমন একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'একটি পার্কিং স্পেস থেকে বের হওয়ার সময় আমার গাড়ি আরেকটি গাড়িকে ধাক্কা দেয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সেখানে প্রচুর মানুষ জড়ো হয়ে যান, চলে আসেন একদল বাইকারও। যারা সবাই মিলে আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করে দেখার দাবি জানাতে থাকেন।'

'যেহেতু দুটি গাড়িরই ক্ষতি হয়েছিল, দ্রুতই সেখানে পুলিশ চলে আসে। কিন্তু আমি আপস করতে অস্বীকৃতি জানাই। কারণ আমার কোনো দোষ ছিল না। সেইসঙ্গে ক্ষতিপূরণও দাবি করি। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করি, পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছেই অন্য গাড়ির পুরুষ চালকটির ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করতে শুরু করেন। অথচ কিছুক্ষণ আগেই উপস্থিত জনতা কেবল আমার লাইসেন্সটিই দেখার জন্য চাপ দিচ্ছিল। আমি নিজের অবস্থানে অটল ছিলাম এবং স্পষ্ট করে বলেছি যে আমার লাইসেন্স দেখতে চাওয়ার কোনো অধিকার তাদের নেই। আর যদি আমাকে লাইসেন্স দেখাতেই হয় তাহলে অন্য চালকের লাইসেন্সও দেখতে হবে।'

সম্প্রতি মব সহিংসতা ও নারীর ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় নারী চালকদের ভয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিবেদনটির জন্য নারী চালকদের সঙ্গে কথা বলার সময় দেখেছি তারা প্রত্যেকেই দেশের জননিরাপত্তার বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক নারী চালক মনে করছেন, তারা সহিংসতার ঝুঁকির প্রান্তিক পর্যায়ে অবস্থান করছেন। তাছাড়া ছিনতাই এবং ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটছে প্রচুর। এ অবস্থায় একা গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রেও তাদের অস্বস্তি বাড়ছে।

নারীদের এ ধরনের উদ্বেগ ভিত্তিহীন নয়। রাস্তায় এমনিতেই নারীরা নানা ধরনের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে যান। যার মধ্যে রয়েছে আশপাশের মানুষের নেতিবাচক মানসিকতা থেকে শুরু করে নিরাপত্তা হুমকির মতো বিষয়ও। যদিও দেশে নারী চালকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে, কিন্তু এটা সত্যি যে এখনও নারী চালকরা কেবল নারী হওয়ার কারণে অসংখ্য সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। চালক হিসেবে তাদের পথ চলার অভিজ্ঞতা পুরুষদের চেয়ে একদম আলাদা এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ইতিবাচক নয়।

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং সামগ্রিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সুস্পষ্ট পরিবর্তন না হলে নারী চালকদের ওপর এই চাপ কমবে না এবং বাধ্য হয়েই তাদের লড়তে হবে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে।

অনুবাদ করেছেন শেখ সিরাজুম রশীদ

  

Comments