বিদেশে উচ্চশিক্ষায় যেসব মানসিক প্রস্তুতি প্রয়োজন

বিদেশে উচ্চশিক্ষা
ছবি: সংগৃহীত

শীত ঋতুর দেশ ফেলে দুবছর পর আবারও পেলাম নিজ দেশের নানান ঋতুর উৎসব, বইমেলা, পরিচিত ক্যাম্পাস। বিদেশে যত যাই করা হোক না কেন, নিজ দেশের কিছু বিষয়ের তুলনা পাওয়া ভার। এত ব্যস্ততার মাঝেও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা নিজ দেশের উৎসব, বিভিন্ন দিবসগুলো উদযাপন করার সময় কিন্তু ঠিকই খুঁজে নেন।

আসলে দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় আমরা আমাদের দীর্ঘ দিনের নানান পরিকল্পনা নিয়ে পাড়ি জমাই। ওখানে যারা আছেন, তাদের জিজ্ঞেস করলে অনায়াসে বলে দেবেন, ভিনদেশই বেশ ভালো। একদিক থেকে সত্য বটে। নির্ঝঞ্ঝাট, কর্মদক্ষতার কদর যেখানে রয়েছে। তবে আমার এবং আমার বন্ধুদের অভিজ্ঞতা কিন্তু এই অকপট উত্তরের মতো নয়! আমাদের বারংবার মনে হয়েছিল, দুটো জীবনের দুটো ভিন্ন দিক রয়েছে।

নিজ দেশের চেনা পথঘাট, একঘেয়ে লাগতে থাকা প্রতিদিনের খাবার, এমনকি শহরের শোরগোলও তখন বেশ মনে পড়তে থাকে। তাই কিছু বিষয় থাকে যা আসলে আমাদের বলা হয় না, কিন্তু আসলেই মানসিক প্রস্তুতির জন্য জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। কারণ বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকেই এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয় এবং এই সময়টা মানসিক অনেক টানাপোড়েনের সম্মুখীন হতে হয়।

প্রথম যেই বিষয়টি আসে, সেটি হলো একাকিত্ব। আমরা যারা ভিন্ন এক পরিবেশে বেড়ে উঠেছি, তাদের কাছে ইউরোপ-আমেরিকার এই একান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনে একা লাগতে পারে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ কিছু গবেষণায় দেখলাম, ৮০ ভাগেরও বেশি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এই সমস্যাটার সম্মুখীন হন। অনেকেই মনে করেন, এটা শুধু তার ক্ষেত্রেই হচ্ছে কি না! আমার অনেক বন্ধু, শিক্ষার্থী যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে গিয়ে প্রথমেই এই একাকিত্বের বিষয়টা নিয়েই বলেছেন। তাই এই নতুন দেশে চেনা-পরিচিত ছাড়া একাকিত্ববোধ হওয়াটা স্বাভাবিক, এর জন্য মানসিক প্রস্তুতি রাখা দরকার।

একাকিত্ববোধ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। পরিবার ছাড়া, বাংলা ভাষায় দুটো কথা বলার মতো কাউকে না পাওয়া, বৈরী আবহাওয়া কিংবা সারাদিনের ব্যস্ততা। আর যুক্তরাষ্ট্রে থেকে নিজ দেশের যেই বিষয়টি খুব মনে পড়েছে, তা হলো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। এই বিষয়টি পুরো মার্কিন সংস্কৃতির কোথাও নেই। ক্লাস শেষ তো সবাই তাদের ব্যাগ গুছিয়ে বিদায়! উৎসব বিশেষে কিছু গেট-টু-গেদার তো হয়ই, কিন্তু তা ঠিক বাঙালি আমেজের নয়। রাত ৮টার মধ্যেই ডিনার পর্ব সেরে ঘুমুতে যাওয়া। সারাদিন নানা কাজ শেষে মনে হতো, কী যেন নেই! বা কী একটা করলে যেন স্বস্তি মিলত!

সংস্কৃতির ভিন্নতা অনেক বড় একটি বিষয়, যা একবারে ভিনদেশে গেলেই আসলে বোঝা যায়। শুরুতেই মার্কিনিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে কিছুটা সময় নেয়। ভাষার সূক্ষ্ম পার্থক্য, একেক স্টেটের বিভিন্ন উচ্চারণ, যোগাযোগটাকে ঠিক স্বাভাবিক গতিতে এগুতে দেয় না। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের নানান সংস্কৃতির সহপাঠী থাকবে, কিন্তু শুরুতে ঠিক কোথাও যেন খাপ খেতে চাইবে না। তখনই বারবার মনে হবে, আপনি এই ভিনদেশে একাকী। এছাড়া খাবার, নিজ ধর্মীয় উৎসবগুলো দেশের মতো উদযাপন করার সুযোগও পাওয়া যাবে কিঞ্চিৎ।

আরেকটি বিষয় হলো, আপনার অ্যাপার্টমেন্ট মেট। এক দেশ থেকে আরেক দেশে থাকার জায়গা ঠিক করাটাও কম ঝক্কির নয়। তার উপর থাকে লিজ, গ্যারান্টরসহ অনেক বিষয় যেগুলো আমাদের দেশে সচরাচর নেই। একে তো একা থাকার অভিজ্ঞতাটা খারাপ লাগার, তার উপর অনেক সময় অ্যাপার্টমেন্ট মেট যদি হয় ভিন্ন মানসিকতার কিংবা আরেক দেশের, অনেক কিছু নিয়েই তখন ঝামেলা শুরু হতে পারে। আমার শুরুর দিকের অ্যাপার্টমেন্ট মেট ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের। কিচেনে রান্না করার সময়, হালাল খাবার এবং এয়ার কুলার টেম্পেরাচারের মতো ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কিছু ঝামেলার তৈরি হতো। তাই আমার নিজের অভিজ্ঞতা হলো, অ্যাপার্টমেন্ট মেট যদি কিছুটা একই সংস্কৃতির হন তাহলে শুরুর কিছুটা দিন অন্তত ঝামেলা এড়িয়ে থাকা যায়। আবার অনেকে বলেন, নিজ দেশের রুমমেটের চেয়ে ভিন্ন দেশের কেউ বরঞ্চ ভাল। এটা আসলে পুরোটাই নির্ভর করে ব্যক্তির ওপর। তাই অন্তত লিজের ঝামেলা এড়ানোর জন্য ডর্ম কিংবা যেসব বাসায় অল্প সময়ের লিজ পলিসি আছে, সেগুলো তালিকায় রাখা উচিত।

আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, এমন মানসিকতা রাখা, যত যাই হোক, কখনোই কিছু বিষয় ভিনদেশে পাওয়া যাবে না। আমরা যারা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসেবে ছিলাম বা আছি, প্রায় প্রতিটি মুহূর্তেই মনে পড়বে ঘরের কথা, নানান অনিশ্চয়তা, হুট করে স্ট্রিট ফুড, একেক ঋতুর একেক আমেজ যেমন গ্রীষ্মের সময়ে ইচ্ছেমতো নানা ধরনের ফল খাওয়া, শীতের নানান পিঠা, বইমেলার আমেজ, চা হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প। উন্নত দেশে অনেক কিছুই আছে, যা সেখানে গেলেই শুধু পাওয়া যাবে। কিন্তু যেসব আমরা ছেড়ে যাই, সেগুলো আসলে ওভাবে মেলে না।

নাদিয়া রহমান: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকির শিক্ষার্থী।

 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh transition from autocracy to democracy

Transitioning from autocracy to democracy: The four challenges for Bangladesh

The challenges are not exclusively of the interim government's but of the entire political class.

9h ago