আপনার সম্পর্ক ‘ট্রমা বন্ডিং’ নয় তো?

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুব আজাদের কাছ থেকে জানব ট্রমা বন্ডিং কী, কেন হয় আর এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায়।
ট্রমা বন্ডিং
ছবি: সংগৃহীত

অপি ও শ্রাবণ প্রেমের সম্পর্কে আছে প্রায় দুই বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে অধ্যয়নরত শ্রাবণ অপিকে প্রেম নিবেদন করেন হাজারো মোমবাতি জ্বালিয়ে। অপিও শ্রাবণকে না বলতে পারেননি। সময়ে গড়িয়ে যেতে থাকে।

কিন্তু একদিন ফোন না ধরায় শ্রাবণ অপিকে সবার সামনেই তার ফোন ছুড়ে মারেন। পরে অবশ্য ক্ষমাও চেয়ে নেন। কিন্তু এখানেই শেষ হয় না, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে, আর অপি তাকে ক্ষমা করে দেন। অপির আত্মসম্মানে লাগলেও সেই সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে কোনোমতেই যেন বের হতে পারেন না।

অপরদিকে চার বছরের সায়নের বাবা-মা চাকরি করেন। ছোট সায়নকে রেখে যান দূর সম্পর্কে এক আত্মীয় শারমিনের কাছে। তিনি সায়নকে আদর করলেও মাঝেমাঝে তার বাবা-মার অনুপস্থিতিতে বাজে আচরণ করেন, এমনকি গায়েও হাত তোলেন। আবার কিছুক্ষণ পরেই আদর করে বুকে তুলে নেন। ছোট সায়নও আদরের আশায় সব ভুলে শারমিনের কোলে আশ্রয় নেয়। কারণ বাবা-মার অনুপস্থিতিতে তিনিই তার একমাত্র ভরসা। 

উপরের নামগুলো ছদ্মনাম হলেও ঘটনাগুলো সত্য। আমরা আমাদের আশপাশে এ ধরনের ঘটনা অহরহই দেখতে পাই। আবার অনেক সময় আমরাই এই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হই। কাছের মানুষ থেকে প্রতিনিয়ত অবহেলা, গ্যাস লাইটিং, মানসিক নির্যাতন, এমনকি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়া সত্ত্বেও তা মেনে নিয়ে পুনরায় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাকে বলা হয় ট্রমা বন্ডিং।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুব আজাদের কাছ থেকে জানব ট্রমা বন্ডিং কী, কেন হয় আর এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায়।

 

ট্রমা বন্ডিং কী

ডা. মাহবুব আজাদ বলেন, ট্রমা বন্ডিং এমন এক ধরনের মানসিক বন্ধন যেখানে বেশিভাগ ক্ষেত্রে মানুষ যাকে আপন মনে করছে তার কাছ থেকেই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। মূলত একপাক্ষিক বিশ্বাস, ভালোবাসা, নির্ভরশীলতা, অসম সম্পর্ক থেকেই এই ধরনের বন্ধনের সৃষ্টি। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এটিকে বলা হয় স্টকহোম সিনড্রোম।

এই ধরনের বন্ডিংয়ে একজন কর্তৃত্ববাদী আচরণ করেন, সঙ্গীকে অপমান করেন। তারপর আবার ভালো ব্যবহার, উপহার, অনুশোচনা প্রকাশের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সম্পর্কে থাকা অপর ব্যক্তিটিও সেটি মেনে নেন। একটা সময় ভাবতে শুরু করেন এটি হয়তো বা সঙ্গীর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তিনি চাইলেও সে সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারেন না। তারা নিজেরাই নিজেদের বোঝান যে, তাদের সঙ্গী সংগত কারণে তাদের উপর বিরক্ত ছিলেন।

তারা অপব্যবহার এবং ইতিবাচক শক্তি বৃদ্ধির চক্রে আটকে যান, আবার সেই ব্যক্তির কাছে ফিরে আসেন। যদিও তারা জানেন যে, তাদের সঙ্গে ভুল আচরণ করা হচ্ছে।

কাদের সঙ্গে হয়

সাধারণত ভালোবাসার সম্পর্কে, দাম্পত্যে ট্রমা বন্ডিং দেখা যায়। তাছাড়া শিশু ও কেয়ার গিভার, বন্ধু, অফিসের সহকর্মী, এমনকি পরিবারেও ট্রমা বন্ডিং দেখা যায়। মানুষ সহজে পারস্পরিক বন্ধন ভাঙতে চায় না। যারা খুব দ্রুত অন্যের ওপর মানসিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন তাদেরকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই ট্রমা বন্ডিংয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। নারী-পুরুষ, এমনকি শিশুরাও এই ধরনের সম্পর্ক মধ্যে দিয়ে যেতে পারে।

মাহবুব আজাদ বলেন, নারীদের মধ্যে ট্রমা বন্ডিংয়ে থাকার প্রবণতা বেশি। তবে সম্পর্কের মধ্যে যারাই দুর্বল মানসিকতার বা শারীরিকভাবেও দুর্বল, তারাই ট্রমা বন্ডিং মেনে নেন।

ট্রমা বন্ডিং কেন হয়

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুব আজাদ বলেন, সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষ একটা পর্যায়ে অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সম্পর্কের শুরুতে সুন্দর একটি সময় কাটানো হয় বলে সঙ্গীর ছেড়ে যাওয়ার ভয় তার মধ্যে কাজ করতে শুরু করে। সঙ্গীকে হারিয়ে একাকী হয়ে পড়ার ভয় পান তিনি। তাই তিনি অবচেতন মনে নিজেকে বোঝান, দোষটি আসলে তারই।

তাই সব ধরনের অন্যায় আচরণ তিনি মেনে নিতে শুরু করেন। অপরদিকে নিপীড়নকারীও বুঝে যান, মানসিকভাবে তার সঙ্গী তার কাছে কতটুকু অসহায়।

উপরে বর্ণনা করা দুটি ঘটনা মনে আছে? ঘটনা দুটি ভিন্ন হলেও এক সূত্রে গাঁথা। অপির মনের শ্রাবণকে হারানোর ভয় কাজ করে। অপরদিকে শিশু সায়নের কাছেও বাবা-মা কর্মক্ষেত্রে চলে যাওয়ার পর একমাত্র শারমিনই ভরসা। এই ভেবে সবকিছু মেনে নেয় সে।

ট্রমা বন্ডিংয়ের লক্ষণ

ডা. মাহবুব আজাদ বলেন, ট্রমা বন্ডিংয়ের মূল লক্ষণ হলো নিপীড়নকারী নিজের করা অন্যায়কে যথাযথ বলে দাবি করেন। অপরদিকে থাকা সঙ্গীও এই অন্যায় আচরণ মেনে নেন। এই ঘটনা চক্রাকারে চলতে থাকে। সেই ব্যক্তি অনেক সময় বুঝতেও পারেন না যে তিনি একটি অসুস্থ সম্পর্কের মধ্যে রয়েছেন।

যারা এই সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার জন্য পরামর্শ দেন, তাদের থেকেও ব্যক্তি দূরে থাকার চেষ্টা করেন। নিপীড়নকারী ব্যক্তি এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করেন যেন নিগৃহীত ব্যক্তিটি মনে করতে শুরু করেন, আসলে দোষটি তারই। বন্ধুবান্ধব এমনকি পরিবার থেকেও থেকে অনেকটা আইসোলেশনেই থাকেন তারা।

কীভাবে ট্রমা বন্ডিং থেকে বের হবেন

দীর্ঘদিন এ ধরনের সম্পর্কের থাকার কারণে আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা কমে যায়। দীর্ঘ সময় ভয়ের মধ্যে থাকার কারণে ডিপ্রেশন, এংজাইটি, নিদ্রাহীনতা, অমনোযোগিতা দেখা যায়। বর্তমান এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের সম্পর্ক সবসময়ই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

ডা. মাহবুব আজাদ বলেন, এ ধরনের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা বেশ কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ। কারণ আত্মসম্মানবোধ ভেঙে গেলে তা সহজে ফেরত পাওয়া সম্ভব না। তবে এ ধরনের সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসার প্রথম শর্ত হলো নিজেকে ভালোবাসা, নিজেকে সম্মান করা, নিজের সঙ্গে সৎ থাকা।

এই ঘটনা যদি ঘটে থাকে তবে প্রাথমিক অবস্থাতেই একে প্রতিরোধ করতে হবে।

তবে দীর্ঘদিন যদি এই সম্পর্কের মধ্যে বসবাস করে থাকেন, তবে এ থেকে বের হওয়ার জন্য আগে নিজেকে বোঝাতে হবে। প্রয়োজনে কাছের মানুষ ও পরিবারের সদস্যদের সাহায্য নিন। এ সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসার পরেও অতীতের স্মৃতি আপনাকে তাড়া করতে পারে। সে ক্ষেত্রে একজন অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। তিনি কাউন্সিলিং ও প্রয়োজনীয় ওষুধ দেবেন।

 

Comments

The Daily Star  | English
food crisis

Thailand trip a step forward in efforts to protect economic interests: PM

Prime Minister Sheikh Hasina declared her recent six-day trip to Thailand as a landmark success, aimed at safeguarding Bangladesh's economic interests and elevating its regional presence

32m ago