ক্লেপটোম্যানিয়া: অভাবে নয়, অভ্যাসের বশে চুরির মানসিক রোগ

ছবি: সংগৃহীত

'১২ বছর বয়স থেকে শুরু করে ২৫ বছর পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০টা পরের জিনিস বারীন ভৌমিক কোনো না কোনো উপায়ে আত্মসাৎ করে নিজের ঘরে নিজের কাছে এনে রেখেছেন। একে চুরি ছাড়া আর কী বলা যায়? চোরের সঙ্গে তফাত শুধু এই যে, চোর চুরি করে অভাবের তাড়নায়। আর তিনি করেছেন অভ্যাসের বশে।'

সত্যজিৎ রায়ের 'বারীন ভৌমিকের ব্যারাম' গল্পটি পড়া আছে কী? বারীনবাবুর যে 'ব্যারাম'টি ছিল, তা তাকে একটা বয়স পর্যন্ত বেশ ভুগিয়ে ছাড়ে। সেইসঙ্গে তার আশেপাশের মানুষজনও কম ভোগান্তিতে পড়েন না। চোর চুরি করে প্রয়োজন থেকে, কিন্তু ক্লেপটোম্যানিয়াকরা করেন নিছক স্বভাবদোষে। আসলে এটি তাদের মানসিক একটি অসুখ, যার নাম ক্লেপটোম্যানিয়া।

মনস্তাত্ত্বিক রোগব্যাধির মধ্যে ক্লেপটোম্যানিয়া আইসিডি তথা ইম্পালস কন্ট্রোল ডিসঅর্ডারের অন্তর্ভুক্ত। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা থেকে এই সমস্যাটির জন্ম। সাধারণত কমবয়সীদের মধ্যে এই ব্যাধির জন্ম হলেও মাঝে মাঝে বেশি বয়সে গিয়েও কেউ কেউ ক্লেপটোম্যানিয়াক হয়ে উঠতে পারেন, এমনকি আগে চুরির ইতিহাস না থাকলেও।

এ রোগে আক্রান্তদের কোনো জিনিস না বলে নিয়ে নিতে ইচ্ছে করে, যা হয়তো পরিচিতজনের কাছে চাইলেই দিয়ে দেবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চুরি করা জিনিসগুলো খুব একটা দামি হয় না এবং যিনি চুরি করেছেন খুব একটা কাজেও লাগে না। এ যেন ডাকটিকিট বা কলম জমানোর মতোই এক সংগ্রাহকের আচরণ! তবে কিছু ক্লেপটোম্যানিয়াক ব্যক্তি এ কাজ করার পর এতটাই লজ্জায় পড়েন যে চুরির পরপরই সেই বস্তু থেকে মুক্তি চান। হয়তো বিক্রি করে দেন বা ফেলে দেন।

চুরির জিনিস রাখবেন কি রাখবেন না, এটি অবশ্য ব্যক্তির স্বতন্ত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে। তবে প্রায় সব ক্লেপটোম্যানিয়াকই চুরির কাজটি একা থাকা অবস্থায় করেন। কারণ তারা তাদের এ আচরণ নিয়ে মোটেও গর্বিত নন এবং কাছের মানুষকেও জানতে দিতে চান না।

 

ক্লেপটোম্যানিয়ার কারণ

ক্লেপটোম্যানিয়ার ঠিকঠাক কারণ এখনও চিহ্নিত হয়নি। তবে মনোবিজ্ঞানের অলিতে-গলিতে এই বিশেষ ব্যাধির সম্ভাব্য কিছু কারণ পাওয়া গেছে–

● সেরোটনিন হরমোন মানুষের মন-মেজাজ এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। দেহে সেরোটনিনের মাত্রা কম হলে অনেক সময় ব্যক্তির মধ্যে এ ধরনের চূড়ান্ত আবেগীয় আচরণের দেখা মেলে।

● আরেক নিউরোট্রান্সমিটার ডোপামিনের অতিরিক্ত চাহিদার ফলেও ব্যক্তি এমন আচরণে জড়িয়ে পড়তে পারেন। চুরি করার সময় তৎক্ষণাৎ যে রোমাঞ্চ বা অভিযানের অনুভূতি হয়, সেটি ডোপামিন নিঃসরণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে ক্লেপটোম্যানিয়ার শুরু হতে পারে এবং একই চাহিদার ফলে ব্যক্তি একই কাজের পুনরাবৃত্তি করেন।

●মস্তিষ্কের ওপিওয়েড সিস্টেমের মাধ্যমে ব্যক্তির আবেগীয় চাহিদাগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। এই অংশে কোনো ধরনের ভারসাম্যহীনতার ফলে এ ধরনের ডিসঅর্ডার জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

● মানুষ অভ্যাসের চক্রে বারবার জড়িয়ে যায় এবং একবার চুরি করার পর ব্যক্তি যে আনন্দ পান, সেটি বারবার পাবার জন্য চুরির অভ্যাস জন্ম নেয়–যার চূড়ান্ত ফলাফল 'ক্লেপটোম্যানিয়া'।

ক্লেপটোম্যানিয়ার লক্ষণ

যেকোনো সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সেটিকে আগে চিহ্নিত করতে হয় এবং সেজন্য কিছু উপসর্গের বিষয়ে সচেতন হতে হয়। ক্লেপটোম্যানিয়ার ক্ষেত্রেও এমনটা করা জরুরি।

● কারো বাসা বা দোকানের এমন কোনো জিনিস যা প্রয়োজন নেই, তা নিয়ে নেওয়ার একটি অদম্য আগ্রহ বোধ করা।

●  চুরি করার কথা ভেবেই নিজের মধ্যে একধরনের অস্থিরতা এবং একইসঙ্গে ভালোলাগা অনুভব করা

●  চুরি করার সময় অন্যরকম এক আনন্দ অনুভূত হওয়া

●  চুরির পর নিজের মধ্যে অপরাধবোধ, অনুশোচনা, লজ্জা, এমনকি নিজের প্রতি ঘৃণা বোধ করা

●  খারাপ লাগার পরও বারবার একইভাবে চুরির প্রতি ধাবিত হওয়ার ইচ্ছা

সমাধান কী?

ক্লেপটোম্যানিয়া খুব সাধারণ কোনো অসুখ নয়। এটি মেনে নেওয়াও ব্যক্তির জন্য বিশেষ একটি চ্যালেঞ্জ। তাই কাছের কেউ যদি ক্লেপটোম্যানিয়াক হন এবং সেটি বোঝা যায়, তবে তাকে অপমানসূচক কথাবার্তা বলে তার অপরাধবোধ আরও বাড়িয়ে না দেওয়াই ভালো। আপাতদৃষ্টিতে অপমানসূচক কথাবার্তা সমাধান মনে হলেও এতে বাজে প্রভাব পড়বে। মনে রাখতে হবে যে ক্লেপটোম্যানিয়া একটি মানসিক ব্যাধি, কোনো চারিত্রিক দূষণ নয়। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে নিজেকে বা অন্যকে দোষারোপের মনোভাব দূরে সরিয়ে রেখে যৌক্তিকভাবে এগোতে হবে।  

ক্লেপটোম্যানিয়াক লোকজনের জীবন অনেকটা লুকোচুরির মধ্যে কাটে। তারা অন্য সমস্যার মতো এটির জন্য কারো কাছে সাহায্য চাইতেও পারেন না। ক্লেপটোম্যানিয়ার সেভাবে কোনো চিকিৎসা নেই ঠিকই, তবে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি দৃঢ়সংকল্প হন তাহলে নিয়মিত সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এই চক্রাকার মনস্তাত্ত্বিক জট ছাড়ানো সম্ভব।

তথ্যসূত্র:

১.https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/kleptomania/symptoms-causes/syc20364732#:~:text=The%20causes%20of%20kleptomania%20are,strengthens%20the%20problem%20over%20time.

২. https://www.webmd.com/mental-health/what-to-know-addicted-stealing

৩.https://www.psychologytoday.com/intl/conditions/kleptomania?fbclid=IwAR14qHkWu2_oMDv_M7ayAG-zg7sz57Fg_vXhsTo7432Y_4JYqROJb3HJO1g

Comments

The Daily Star  | English
Overall situation of foreign direct investment

Net foreign direct investment hits six-year low

The flow of foreign direct investment (FDI) in Bangladesh fell to $104.33 million in the July-September quarter of fiscal year 2024-25, the lowest in at least six years, as foreign investors stayed away from Bangladesh amid deadly political unrest, labour agitation, and a persistent economic crisis.

13h ago