রান্নার কোন তেলের কী উপকার, কী ক্ষতি

স্বাস্থ্যকর রান্নার তেল
ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান যুগে স্বাস্থ্যসচেতনতার প্রসার ঘটেছে ব্যাপকভাবে। আর এই সচেতনতার গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হলো রান্নার তেল নির্বাচন। প্রতিদিনের খাবারে ব্যবহৃত তেল আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। তাই কোন তেলটি স্বাস্থ্যকর, আর কোনটি এড়িয়ে চলা উচিত—তা জানা জরুরি।

চলুন আজকে এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নিই। জানিয়েছেন সিলেট ডায়াবেটিস অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালের ডায়াবেটিস এডুকেটর ও পুষ্টিবিদ স্বর্ণালী দাশ বিজয়া।

পুষ্টিবিদ স্বর্ণালী দাশ জানান, প্রতিদিন আমরা রান্নায় যে তেল ব্যবহার করি, সেটিই হতে পারে আমাদের সুস্বাস্থ্য রক্ষার মূল চাবিকাঠি অথবা একাধিক রোগের প্রাথমিক উৎস। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্থূলতা ও ডায়াবেটিসের মতো নানাবিধ অসুখের সঙ্গে তেলের ব্যবহারের রয়েছে সরাসরি সম্পর্ক। তাই রান্নার তেল বাছাইয়ে আমাদের সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।

রান্নায় যত ডিগ্রি তাপমাত্রায় তেলের গুণ নষ্ট হওয়া শুরু হয়, সেটিই স্মোকিং পয়েন্ট। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তেলের স্মোক পয়েন্ট থেকে নীলাভ ধোঁয়া বের হতে শুরু করে। এই ধাপে চর্বি ভেঙ্গে অক্সিডাইজ হয়, ফলে ক্ষতিকর ফ্রি র‍্যাডিকেল উৎপাদিত হয়। ফ্রি র‍্যাডিকেল শরীরে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। যেসব তেলের স্মোক পয়েন্ট যত বেশি, সেসব তেল দিয়ে তত বেশি উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করা যায়। নিম্ন মাত্রার স্মোক পয়েন্ট থাকলে সেই তেল দিয়ে খুব সাবধানতার সঙ্গে অল্প তাপে রান্না করতে হবে। তেল স্মোক পয়েন্ট অতিক্রম করলে সেই তেল হয়ে পড়ে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, এমনকি সেটা যদি স্বাস্থ্যকর অলিভ অয়েল হয়, তবুও। তাই সেই তেল ফেলে দিয়ে নতুন তেল দিয়ে রান্না করতে হবে।

চলুন বিভিন্ন তেলের স্বাস্থ্যকর ও অস্বাস্থ্যকর দিক সম্পর্কে জানি।

সরিষার তেল

সরিষার তেলের স্মোকিং পয়েন্ট বেশি তাই ডিপ ফ্রাই করতে এই স্বাস্থ্যকর তেল ব্যবহার করা হয়। সরিষার তেলে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে যা মানব দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। পেটে জীবাণুর সংক্রমণ বন্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে সরিষার তেল। দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করতে এই তেল ভূমিকা রাখে।

সরিষার তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট (সম্পৃক্ত চর্বি) খুব কম থাকে। সরিষার তেলে প্রচুর পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যা খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। সরিষার তেলে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাট থাকে। এই ভালো ফ্যাটগুলো মস্তিষ্কে এবং হার্টে শক্তি যোগান দেয়।

এতে ১১২০ মি.গ্রা. সোডিয়াম এবং ১৫১ মি.গ্রা. পটাশিয়াম থাকে, যা আমাদের শরীরের অ্যাসিড-বেস ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।

সরিষার তেলে মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড ও পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে, যা হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, অন্য অনেক তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকে যা ক্ষতিকর।

গ্লুকোসিনোলেট সরিষার তেলের প্রধান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাস প্রতিরোধে চিকিৎসাগতভাবে কার্যকর।

সরিষার তেলে লিনোলেনিক ও লিনোলিক অ্যাসিডের অনুপাতে ওলেইক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি থাকে, যা অন্যান্য ভোজ্যতেলের তুলনায় স্বাস্থ্যকর।

সরিষার তেলে থাকা উচ্চমাত্রার আলফা-লিনোলেনিক অ্যাসিড উচ্চ কোলেস্টেরল ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

ভালো গুণের পাশাপাশি সরিষার তেলের একটি নেতিবাচক দিকও রয়েছে, তা হলো এতে এরুসিক অ্যাসিড থাকে। এরুসিক অ্যাসিড হৃদপিণ্ডের পেশিতে ট্রাইগ্লিসারাইড জমা সৃষ্টি করতে পারে, যার ফলে হৃদপেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটি দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। এছাড়াও, কিছু মানুষের ত্বকে সরিষার তেল ব্যবহার করলে অ্যালার্জি বা চুলকানি, র‍্যাশ ইত্যাদির মতো প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তবে পরিমিত ও সচেতন ব্যবহারে এই তেলের উপকারিতা এখনও অনেকটাই মূল্যবান, বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশের খাদ্যাভ্যাসে।

জলপাই তেল

রান্নায় জলপাই তেলের চারটি মৌলিক ব্যবহার রয়েছে: সংরক্ষণকারী হিসেবে, রান্নার মাধ্যম হিসেবে, উপাদান হিসেবে এবং একটি ঘন মসলা বা কনডিমেন্ট হিসেবে। মেডিটেরেনিয়ান অঞ্চলের সংস্কৃতিগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একমাত্র রান্নার তেল হিসেবে এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ব্যবহার করে আসছে এবং এই খাদ্যধারাটি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্য উপকারিতা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাস্থ্যর জন্য জলপাই তেল বেশ ভালো। স্বাস্থ্যকর জলপাই তেলে প্রচুর মনোআনস্যাচুরেটেড এবং পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট আছে। তাই হার্টের জন্য এই তেল বেশ ভালো। ওজন কমানোর পর ফিটনেস ধরে রাখতে রান্নায় এই স্বাস্থ্যকর তেল ব্যবহার করা হয়। স্যাচুরেটেড ফ্যাট জলপাইয়ের তেলে খুব কম মাত্রায় থাকে। জলপাই তেলের স্মোকিং পয়েন্ট বেশ উচ্চ মানের।

পুষ্টিবিদ স্বর্ণালী দাশ বিজয়া

সয়াবিন তেল

এটি পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড, বিশেষ করে ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ এর জন্য উপকারী, যা হার্ট ভালো রাখতে সহায়তা করে। এটি ভিটামিন ই-এরও একটি ভালো উৎস, যা একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং এটি প্রদাহ হ্রাসে সহায়তা করতে পারে। সয়াবিন তেল প্রদাহজনিত বায়োমার্কারকে প্রভাবিত করে না এবং এটি অক্সিডেটিভ স্ট্রেসও বাড়ায় না।

তবে গবেষণায় দেখা গেছে, পিইউএফএ(পুফা) সমৃদ্ধ সয়াবিন তেল শরীরের ওজন বৃদ্ধি ও ডায়াবেটিসের জন্য নারকেল তেলের চেয়ে বেশি ক্ষতিকর, যদিও নারকেল তেল মূলত স্যাচুরেটেড ফ্যাট দিয়ে তৈরি। গবেষণায় আরও দেখা যায় যে, ফ্রুক্টোজ সয়াবিন তেলের চেয়ে কম হারে স্থূলতা সৃষ্টি করে এবং সয়াবিন তেল লিভারে উল্লেখযোগ্য চর্বি জমার (ফ্যাটি লিভার) গঠন সৃষ্টি করে।

ক্যানোলা তেল

ইউরোপ ও আমেরিকা সরিষার ফুল ও বীজ সদৃশ্য উদ্ভিদ ক্যানোলার বীজ থেকে ক্যানোলা তেল মহাদেশে সংগ্রহ করা হয়। ক্যানোলা তেলের পুষ্টিগুণ সয়াবিন তেলের চেয়ে বেশি। সয়াবিন তেলের প্রধান বিকল্প হলো ক্যানোলা তেল। স্যাচুরেটেড ফ্যাট এই তেলে খুব কম। পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও মনো স্যাচুরেটেড ফ্যাট এই তেলে বেশি। ওমেগা-৩ ফ্যাট এই তেলে বেশ ভালো মাত্রায় থাকে। হার্টের স্বাস্থ্যের জন্যে এই তেল বেশ ভালো। ক্যানোলা তেলের সাধারণত মাঝারি-উচ্চ ধোঁয়া ওঠার মাত্রা (স্মোক পয়েন্ট) থাকে, যার অর্থ এটি মাঝারি তাপে রান্নার জন্য উপযোগী, যেমন স্টির-ফ্রাই, এবং কিছু কিছু গ্রিলিংয়ের জন্যও এটি ব্যবহারযোগ্য।

রাইস ব্রান তেল

ধানের তুষ থেকে তৈরি হয় রাইস ব্রান তেল। রাইস ব্রান অয়েল সয়াবিন তেলের মতো একটি ভোজ্য তেল কোলেস্ট্রেরলমুক্ত ও প্রাকৃতিক ভিটামিন ও খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। খুব নিম্নমাত্রার স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং খুব উচ্চমাত্রার পলিআনস্যাচুরেটেড ও মনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট পাশাপাশি ওমেগা-৩ ফ্যাট বেশি থাকার জন্য এই তেলকে হার্টের জন্য উৎকৃষ্ট তেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ওরিজনল নামে উপাদান এই তেলে আছে, যা হার্ট ব্লক, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। রাইস ব্রান তেলের স্মোকিং পয়েন্ট খুবই উচ্চ মানের।

পাম ওয়েল

পাম তেলের কিছুটা দুর্নাম রয়েছে। কারণ এতে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের পরিমাণ বেশি, যা দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। স্যাচুরেটেড ফ্যাট রক্তে 'খারাপ' এলডিএল কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বাড়ায়, যা হৃদরোগের ঝুঁকির কারণ। তবে পাম তেলে ভিটামিন ই প্রচুর পরিমাণে থাকে (বিশেষ করে টোকোট্রিয়েনলস), যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রভাব কমাতে সহায়তা করে বলে মনে করা হয়।

এ ছাড়াও একই তেল বারবার গরম করলে তাতে টক্সিন তৈরি হয়। এই তেল ক্যানসারের ঝুঁকি তৈরি করে এবং হজমজনিত সমস্যা বাড়াতে পারে।

 

Comments

The Daily Star  | English
government

Govt to act with people’s backing if blocked from responsibilities: Advisory council

"The Advisory Council believes that a broader unity is essential to maintain national stability"

19m ago