মুলা না খেয়ে যেসব পুষ্টিগুণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন
মুলা একটি শীতকালীন সবজি। পছন্দ এবং অপছন্দ দুই ধরনের তালিকাতেই মুলাকে দেখা যায়। অর্থাৎ অনেকে মুলা খেতে পছন্দ করেন, আবার অনেকেই এটি খেতে চান না। তবে মুলা একটি পুষ্টিগুণে ভরপুর সবজি, যা সুস্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার প্রতিরোধ ও নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আজকে জানব মূলার পুষ্টিগুণ। জানিয়েছেন মিরপুর ইসলামী ব্যাংক হসপিটাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারের সিনিয়র পুষ্টিবিদ শরীফা আক্তার শাম্মী।
মূশরীফা আক্তার শাম্মী বলেন, মুলা পুষ্টিগুণে ভরপুর একটি সবজি, যা শরীরের প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবার সরবরাহ করে। এটি হজম শক্তি বাড়ায়, হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর। নিয়মিত মূলা খেলে শরীরের সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত হয়। তাই দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় মূলা রাখা উচিত।
মুলার পুষ্টি উপাদান
মুলায় রয়েছে প্রচুর প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং খাদ্য আঁশ।
প্রতি ১০০ গ্রাম মূলায় রয়েছে-
ক্যালরি: ১৬ ক্যালোরি
পানি: ৯৫%
কার্বোহাইড্রেট: ৩.৪ গ্রাম
প্রোটিন: ০.৭ গ্রাম
ফাইবার: ১.৬ গ্রাম
চর্বি: ০.১ গ্রাম
কোলেস্টেরল: ০ মিলিগ্রাম
ভিটামিন বি৬: ০.১ মিলিগ্রাম
ভিটামিন সি: ১৪.৮ মিলিগ্রাম
ম্যাগনেশিয়াম: ১০ মিলিগ্রাম
সোডিয়াম: ৩৯ মিলিগ্রাম
পটাশিয়াম: ২৩৩ মিলিগ্রাম
আয়রন: ০.৩ মিলিগ্রাম
এ ছাড়াও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
মুলার পুষ্টি উপাদানের উপকারিতা
ভিটামিন
মুলা ভিটামিন সি এবং বি গ্রুপের ভিটামিনের ভালো উৎস। মুলা প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি এর একটি বড় অংশ সরবরাহ করে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শীতে সর্দি, কাশির সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
মূলায় রয়েছে ফোলেট (ভিটামিন বি৯) যা রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের সঠিক বিকাশে সহায়ক। ভিটামিন বি৬ স্নায়ুতন্ত্রের সঠিক কার্যকারিতা নিশ্চিত করে। হরমোনের ভারসাম্য রক্ষায় সাহায্য করে।
খনিজ উপাদান
মুলায় উপস্থিত বিভিন্ন খনিজ উপাদান আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য। পটাসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ক্যালসিয়াম হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়ক। ম্যাগনেসিয়াম মাংসপেশি এবং স্নায়ুর কার্যকারিতা উন্নত করে। মুলার ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম হাড়ের ঘনত্ব বাড়ায়। অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে সহায়ক। হাড় ভঙুর হওয়া রোধ করে। আয়রন রক্তশূন্যতা প্রতিরোধে সহায়ক। শরীরের অক্সিজেন পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফসফরাস কোষের কার্যকারিতা সঠিক রাখতে সহায়ক। শক্তি উৎপাদন এবং বিপাক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভূমিকা
মূলায় উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যেমন অ্যান্থোসায়ানিন শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে। ক্যারোটিনয়েডজ চোখের দৃষ্টি শক্তি ভালো করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। মূলায় থাকা সালফার যৌগ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে। বিশেষ করে স্তন, পাকস্থলী এবং কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়। কোষের বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ধীর করে। ধমনির ক্ষতি রোধ করে এবং হৃদয়ের কার্যকারিতা উন্নত করে।
খাদ্য আঁশের উপকারিতা
মূলার ফাইবার হজমশক্তি বাড়ায়। ফাইবার অন্ত্রের গতিশীলতা উন্নত করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। খাদ্য আঁশ রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। খাদ্য আঁশ দীর্ঘ সময় ক্ষুধা লাগতে দেয় না, যা অতিরিক্ত খাওয়া রোধ করে। এ ছাড়াও মুলায় ক্যালোরি খুব কম এবং এটি অতিরিক্ত চর্বি জমা রোধ করে বিধায় ওজন কমাতে সাহায্য করে।
ডিটক্সিফাইং এজেন্ট
মূলা প্রাকৃতিক ডিটক্সিফাইং উপাদান হিসেবে কাজ করে। এটি লিভার এবং কিডনি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। লিভারের বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে। রক্তকে পরিষ্কার করে এবং বিলিরুবিন নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে জন্ডিসও প্রতিরোধ হয়। মূত্রবর্ধক হিসেবে কাজ করে। মূত্রের পরিমাণ বৃদ্ধি করে, যা মূত্রনালীর সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক।
হৃদরোগ প্রতিরোধ
মূলায় থাকা পটাসিয়াম, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইবার হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে। ধমনির স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
ত্বক ও চুলের যত্নে উপকারী
মূলায় থাকা ভিটামিন সি, জিঙ্ক এবং ফসফরাস ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী। ত্বকের ব্রন ও র্যাশ দূর করতে সাহায্য করে। চুলের বৃদ্ধি উন্নত করে এবং খুশকি প্রতিরোধ করে। ত্বক উজ্জ্বল রাখতে এবং বার্ধক্যের লক্ষণ দূর করতে সহায়ক মূলা।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী
মূলা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। মূলার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। ফলে এটি রক্তে শর্করা বাড়ায় না এবং ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করে।
ক্যানসার প্রতিরোধে ভূমিকা
মূলায় থাকা সালফার যৌগ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রোধ করে। বিশেষ করে স্তন, পাকস্থলী এবং কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা দূর করে
মূলার রস কফ এবং গলার সংক্রমণ দূর করতে সাহায্য করে। হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিসের মতো রোগের উপসর্গ হ্রাস করে এবং শ্বাসনালীর প্রদাহ কমায়। পানির চাহিদা পূরণ করে মূলা।মূলার ৯৫% অংশ পানি, যা শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে। শরীর ঠান্ডা রাখতে সহায়ক।
সতর্কতা
যারা নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন বা অতিরিক্ত মূলা খান, তাদের জন্য কিছু সতর্কতা রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
থাইরয়েড সমস্যার ওপর প্রভাব
মুলায় থাকা গ্লুকোসিনোলেট থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। অতিরিক্ত মূলা থাইরয়েড হরমোনের নিঃসরণ কমিয়ে দিতে পারে। হাইপোথাইরয়েডিজম বা থাইরয়েড গ্রন্থির কর্মক্ষমতা কম থাকলে মুলা এড়ানো উচিত।
হজমে সমস্যা সৃষ্টি
যাদের হজমশক্তি দুর্বল, তাদের জন্য মুলা খাওয়া সমস্যা তৈরি করতে পারে। অতিরিক্ত মুলা খেলে পেট ফাঁপা, গ্যাস বা বদহজম হতে পারে। এটি অন্ত্রে অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে।
রক্তচাপ হ্রাসের ঝুঁকি
মুলায় থাকা পটাসিয়াম রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে, যা সাধারণত ভালো। তবে যাদের রক্তচাপ খুব কম (হাইপোটেনশন), তাদের জন্য মুলা বিপজ্জনক হতে পারে। অতিরিক্ত মুলা খেলে মাথা ঘোরা বা দুর্বলতা অনুভব হতে পারে।
এলার্জি প্রতিক্রিয়া
কিছু মানুষের জন্য মূলা খাওয়া অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে। ত্বকের র্যাশ, চুলকানি বা লালচে ভাব দেখা দিতে পারে। কারো কারো ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট বা গলা ফোলার মতো গুরুতর প্রতিক্রিয়াও হতে পারে।
Comments