ঐতিহ্যে-স্বাদে অতুলনীয় গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি

গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি
ছবি: সাজেদুর আবেদীন শান্ত

ভুট্টা আর মরিচের জন্য বিখ্যাত হলেও ভোজনরসিকদের কাছে রসমঞ্জুরির শহর হিসেবে পরিচিত গাইবান্ধা। স্বাদে অতুলনীয় এই মিষ্টির সুখ্যাতি শহরের প্রতিটি কোণায়। শুধু তাই না, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এ রসমঞ্জুরির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পরিসরে।

ইতিহাসের পথে রসমঞ্জুরির যাত্রা 

জানা যায়, ১৯৪৮ সালের জুন মাসে গাইবান্ধার সার্কুলার রোডে 'রমেশ সুইটস' এর কর্ণধার রমেশ চন্দ্র ঘোষ প্রথম রসমঞ্জুরি তৈরি করেন। ভারতের ওডিশা থেকে আনা কারিগরদের সহায়তায় তিনি এই মিষ্টি তৈরির কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে এর বিশেষ স্বাদে মুগ্ধ হতে শুরু করে গাইবান্ধার মানুষ। রসমঞ্জুরি জনপ্রিয় হতে থাকে, আর এক সময় তা দেশের অন্যান্য অঞ্চল ও প্রবাসেও পরিচিতি লাভ করে।

রমেশ সুইটস
ছবি: সাজেদুর আবেদীন শান্ত

রমেশ সুইটসের স্বত্বাধিকারী বলরাম ঘোষ বলেন, 'দোকানটি ছিল আমার বোন জামাইয়ের। স্বর্গীয় রমেশ চন্দ্র ঘোষ ছিলেন আমার বোনের শ্বশুর। তিনি মারা যাওয়ার পর দোকানটি সামলাতেন তার ছেলেরা। তারপর আমাদের হাতে আসে।'

'প্রায় ২০-২২ বছর ধরে আমাদের কাছে রয়েছে দোকানটি, আমরাই এখন পরিচালনা করছি', যোগ করেন তিনি।

রসমঞ্জুরির খ্যাতি সম্পর্কে তিনি বলেন, 'ওডিশা থেকে আমার বোনের শ্বশুর কারিগর নিয়ে রসমঞ্জুরি বানানো শুরু করেন। বানানো শুরু হওয়ার এক দশক মধ্যেই এর খ্যাতি ছড়িয়ে পরে সারা গাইবান্ধায়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত এর খ্যাতি রয়েছে।'

উপাদান ও প্রস্তুত প্রণালি

শুরুর দিকে রসমঞ্জুরির আকৃতি ছিল লম্বাটে। পরে মানুষের পছন্দের কথা মাথায় রেখে তা ছোট ছোট গোলাকারে তৈরি করা হয়। দেখতে অনেকটা রসমালাইয়ের মতো হলেও প্রস্তুত প্রণালি ও স্বাদের কারণে তা আলাদা।

রসমঞ্জুরির মূলে রয়েছে সঠিক অনুপাতের দুধ, ছানা, ক্ষীর, চিনি, ময়দা এবং এলাচের সংমিশ্রণ। এক কেজি রসমঞ্জুরি তৈরিতে প্রয়োজন হয় আড়াই কেজি দুধ, ২০০ গ্রাম ছানা, ১০০ গ্রাম চিনি, ২৫ গ্রাম ছানা ও সামান্য এলাচ।

গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি
ছবি: সাজেদুর আবেদীন শান্ত

রমেশ সুইটসে দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে রসমঞ্জুরি তৈরি করে আসছেন গোবিন্দ চন্দ্র সরকার।

রসমঞ্জুরি প্রস্তুত প্রণালি সম্পর্কে তিনি জানান, প্রথমে দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে ক্ষীর বানানো হয়। এরপর মেশিন বা হাতে তৈরি ছোট ছোট ছানার বল চিনির সিরায় সেদ্ধ করা হয়। সেদ্ধ করার পর সেই বলগুলো ক্ষীরের মধ্যে রেখে কিছুক্ষণ জ্বাল দেওয়া হয়। এর ফলে রসমঞ্জুরি পায় স্বতন্ত্র এক স্বাদ। 

গোবিন্দ আরও জানান, অতীতে রসমঞ্জুরি সম্পূর্ণ হাতে বানানো হতো। তবে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি এবং অটোমেটিক মেশিন ব্যবহার করে এটি বানানো হয়।

স্বাদে ও মানে অতুলনীয়

গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি শুধু একটি মিষ্টি নয়, এটি শহরের ঐতিহ্যের অংশ। এর স্বাদ এতটাই অনন্য যে না খেলে তা বোঝা সম্ভব নয়।

রমেশ সুইটসের বর্তমান স্বত্বাধিকারী বলরাম ঘোষ বলেন, 'আমরা সবসময় রসমঞ্জুরির গুণগত মান ধরে রাখতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।'

প্রবাসীদের কাছে রসমঞ্জুরি শীতকালীন উপহার হিসেবে অত্যন্ত প্রিয়। আমেরিকা, কানাডা, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে এটি নিয়ে যাওয়া হয়। এটি উৎসব-অনুষ্ঠানেরও একটি অপরিহার্য অংশ।

রমেশ সুইটসের জনপ্রিয় নাশতা হলো পরোটা, আলুর শিঙাড়া অথবা নিমকি দিয়ে রসমঞ্জুরি।

রমেশ সুইটসের কর্মচারী রফিকুল ইসলাম ৩৫ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন।

গাইবান্ধা
ছবি: সাজেদুর আবেদীন শান্ত

তিনি বলেন, 'সকালের নাশতায় রসমঞ্জুরির সঙ্গে পরোটা খুব জনপ্রিয়। এ ছাড়াও আমাদের এখানে স্পেশাল এক ধরনের ডাল পাওয়া যায়, যা পরোটার সঙ্গে ফ্রি। এ ছাড়া সকাল ১১টা থেকে রাত পর্যন্ত নিমকি অথবা আলুর শিঙাড়ার সঙ্গে রসমঞ্জুরি খুব চলে এখানে।'

এখানে প্রায়ই খেতে আসেন স্কুলশিক্ষক আশরাফুল ইসলাম।

তিনি বলেন, 'আমার মনে পড়ে, ছোটবেলায় প্রথম বাবার সঙ্গে এখানে এসেছি। তখন পরোটা দিয়ে এই রসমঞ্জুরি খেতাম। এখনও সুযোগ পেলেই খেতে চলে আসি।'

রসমঞ্জুরির দাম

কর্মচারী রফিকুল ইসলাম জানান, এক কেজি রসমঞ্জুরি বিক্রি হয় ৩৮০ টাকায়। রসমঞ্জুরির পাশাপাশি এখানে ১৬ থেকে ১৭ পদের মিষ্টি পাওয়া যায়। এর মধ্যে মালাই চপ, দুধিয়া সন্দেশও খুব স্পেশাল বলে জানান রফিকুল।

আপনি যদি গাইবান্ধায় কখনো যান, তবে এই অনন্য মিষ্টির স্বাদ উপভোগ করতে ভুলবেন না। এটি আপনার ভ্রমণকে আরও মধুর করে তুলবে।

 

Comments

The Daily Star  | English

The ceasefire that couldn't heal: Reflections from a survivor

I can’t forget the days in Gaza’s hospitals—the sight of dismembered children and the cries from phosphorus burns.

6h ago