কাঁথার মতো পুরু ও ভিন্ন স্বাদ, খেয়ে দেখুন পুরান ঢাকার খেতাপুরি

ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে

ডালপুরি বা আলুপুরির নাম তো সবাই শুনেছেন, কিন্তু খেতাপুরি? কারো কাছে পরিচিত, আবার কারো কাছে অপরিচিত মনে হতে পারে এই নাম। তবে পুরান ঢাকার মানুষের কাছে খেতাপুরি শুধু পরিচিত নয়, প্রিয় নাম।

লালবাগ, নাজিরাবাজার, বংশালসহ পুরান ঢাকার কয়েকটি জায়গায় দেখা মেলে এই পুরির। অন্যান্য পুরির সঙ্গে এর পার্থক্য খামিরে। অন্য পুরিগুলোয় আটার খামির ব্যবহার করা হলেও খেতাপুরিতে ব্যবহার করা হয় ময়দার খামির। ময়দার খামির পুরু করে ডাল ভরে খেতাপুরি বানানো হয়। ডালের পুর অনেক মোটা ও নরম হওয়ায় তা অনেকটা কাঁথার মতো লাগে। আর সেখান থেকেই এই খাবারের নাম হয়েছে খেতাপুরি।

লালবাগ কেল্লার দুই নম্বর গেটের সামনে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে খেতাপুরি বিক্রি করছেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম। দুপুর ১২টায় পুরি বিক্রি শুরু করেন, চলতে থাকে রাত ৮টা পর্যন্ত।

খেতাপুরির নামকরণের পেছনে মোটা পুর ও কাঁথার সঙ্গে সাদৃশ্য থাকার বলেন আবুল কাশেম। তিনি তার দোকান নিয়ে বসেন লালবাগের গোরে শহীদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে।

আবুল কাশেম বলেন, 'আগে এই পুরি চাইলের আটা দিয়া বানাত। তখন পুরি হইত সাদা। সেইটা ভাজত খোলা অবস্থায় স্যাঁক দিয়া। দেখতে খেতার মতো হইতো বইলাই নাম খেতাপুরি।'

মো.ইব্রাহিম জানান, ডালপুরি রেখে দিলে শক্ত হয়ে যায়, তবে খেতাপুরি থাকে নরম। তার মতে, বুটের ডাল বা খেসারির ডালের সঙ্গে পুদিনা পাতা, ধনেপাতা, কাঁচামরিচ কুচি, রসুন বাটা, আদা বাটা, পেঁয়াজ বাটা ও বিভিন্ন মশলা দিয়ে তৈরি করা হয় ভেতরের পুর।

ছবি: প্রথম আলোর সৌজন্যে

এই পুর যত ভালো হয়, খেতাপুরিও ততো মজা হয়।

ইব্রাহিম জানান, বাড়ি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তারা ডাল বানিয়ে আনেন। ময়দার সঙ্গে তেল ও পানি দিয়ে খামির বানিয়ে এরপর এই ডাল ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে ডালপুরিতে যতটুকু ডাল ব্যবহৃত হয়, এখানে ব্যবহৃত হয় তার চেয়ে বেশি।

ইব্রাহিমের দোকানের কারিগর ছোটভাই আব্দুল জব্বার বলেন, 'খেতাপুরি ভাজতে হয় কম তেলে, ধীরে ধীরে। তাহলে নরম থাকে। আমরা এইজন্য কেরোসিনের চুলা ব্যবহার করি।এটা গ্যাসের চুলায় ভাজা যায় না।'

তিনি আরও জানান, খামিরে ৫ কেজি ময়দা নিয়ে তাতে ৩ পোয়া (৭৫০ গ্রাম) তেল ও দরকারমতো লবণ দিলেই তৈরি হয়ে যাবে পুর। পুরকে তারা বলেন খাস্তা। জানা গেল, এই খাস্তার কারণেই খেতাপুরি নরম হয়ে যায়। ভেতরে ডালের পরিমাণ বেশি থাকাই এর নরম থাকার কারণ। ভাজা হয় ডুবো তেলে।

এই পুরি খেতে দূর-দূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন। স্থানীয় মানুষেরা দোকানে খাচ্ছেন, আবার পার্সেল করে সঙ্গে নিয়েও যাচ্ছেন এই পুরি।

ছবি: সংগৃহীত

এর এত জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে স্থানীয়রা জানালেন, খেতাপুরিতে মশলা আলাদাভাবে তৈরি করে দেওয়া হয়। ডালপুরির চেয়ে এখানে ডালও বেশি থাকে, তাও কয়েক প্রকারের। এজন্য স্বাদে একটা আলাদা ব্যাপার থাকে। সাধারণ ডালপুরির পুরে এতকিছু থাকে না। এটার পুরটাতেই স্বাদের আসল রহস্য।

স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী জানান, এই পুরি তারা ১ টাকা কিংবা ২ টাকায় খেয়েছেন। এখন দাম বেড়ে ৫ টাকা বা ১০ টাকা হয়েছে।

এ নিয়ে মো.ইব্রাহিমের সরল স্বীকারোক্তি,  'ময়দা, ডাল, পেঁয়াজ-রসুন, সবকিছুরই তো দাম বাড়ছে, মামা। তাইলে পুরি আর পিছায় থাকবে ক্যান?'

তবে দাম বাড়লেও পুরির চাহিদা যে একদমই কমেনি, তার প্রমাণ কেল্লার সামনে দাঁড়িয়েই খেতাপুরি খেতে থাকা মানুষদের সমাগম।

এই পুরির শুরুটা ঠিক কবে থেকে তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। স্থানীয় ব্যবসায়ী জাকির আহমেদ জানান, এই পুরি ছোটবেলা থেকেই খেয়ে আসছেন তিনি।

তিনি বলেন, 'দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে লালবাগ কেল্লার গেটের বিপরীত দিকে একটা দোকান ছিল। যতদূর জানি, ওইখান থেকেই শুরু। তারপর এদিকে আরও কয়েকটা দোকান হয়েছে। তারা সেই দোকানের সাগরেদদের কাছে এই পুরি বানানো শিখছে। কেল্লার দুই নম্বর গেটের সামনের দোকানের তারা সাগরেদদের সাগরেদ।'

গোরে শহীদ স্কুলের সামনে খেতাপুরি নিয়ে বসা আবুল কাশেম বলেন, 'এই পুরি প্রথম বিক্রি শুরু হয় আট আনা থেকে। আমি আমার আব্বার কাছে শিখেছি। এখন পুরি ৫ টাকা। বিকেল ৪টার পর থেকে রাত ৮টা -সাড়ে ৮টা পর্যন্ত বসি। আশপাশে ৪/৫ জন কারিগর আছে যারা খেতাপুরি বানাতে পারে।'

স্থানীয়দের ভেতর জনপ্রিয় আরেকটি খাবার ডালরুটি। তবে সেটিকে অনেকেই খেতাপুরির সঙ্গে ভুল করে মিলিয়ে ফেলেন। পার্থক্য হলো, ডালরুটি তাওয়ায় সেঁকা হয়। পুরের দিক থেকে খেতাপুরির মতোই, তবে মশলার পরিমাণ কম। অপরদিকে রকমারি মশলাসহ খেতাপুরি বানানো হয় তেলে ভেজে।

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই খাবারটির স্বাদ নিতে হেমন্তের এক বিকেলে চলে আসতে পারেন লালবাগে।

 

Comments

The Daily Star  | English

Panic grips NBR officials

The relief that followed the end of a disruptive strike by tax officials at the National Board of Revenue has quickly given way to anxiety and regret, as the government started a clampdown on those involved.

12h ago