ইসলামপুর: এখনও জমজমাট পুরান ঢাকার কয়েকশ বছরের ঐতিহ্য

ইসলামপুর বাজার
ছবি: আনিসুর রহমান

৪০০ বছরের পুরোনো ঢাকাতে এখনও আগের আমেজ নিয়ে টিকে আছে যে কয়টি মাত্র জায়গা, এর মধ্যে ইসলামপুর অন্যতম। সেই নওয়াবদের আমল থেকে চলে আসা এই বাজারটি এখনও দারুণ জনপ্রিয়। কান পেতে শুনলে এখনও এই ভিড়ভাট্টা, কোলাহল আর ট্রাফিক জ্যামের কর্কশতার মধ্যে শোনা যায় অদ্ভুত এক সুর, যা বর্তমানের এই স্থানটাকে জুড়ে দেয় সেই বিগত দিনের ইতিহাসের সঙ্গে।

কয়েক দশক আগে যখন প্রথম এখানে যাই, তখনই বুঝতে পেরেছিলাম এ স্থানের বিশেষত্ব। পুরান ঢাকার সরু অলিগলি ধরে ইসলামপুর এগিয়ে গেলে এখনও খুঁজে পাওয়া যায় সেই মুগ্ধতা, যা এখনও ৩০০ বছর আগের মতোই ব্যস্ততায় বাঁচে।

সময়ের সঙ্গে ইসলামপুর মূল বাজারে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। আরব্য ধাঁচের বাজার থেকে এখন এটি হয়ে উঠেছে বিশাল এক ব্যবসায়িক কেন্দ্রবিন্দু। গাদা গাদা চাইনিজ, লোকাল প্রিন্ট, চিকনকারি, সিল্ক কাপড় থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির যেকোনো কাজে প্রয়োজনীয় অন্যান্য কাপড়- কী নেই এখানে?

ইসলামপুর বাজার
ছবি: আনিসুর রহমান

তবে এখানকার এই কোলাহলের আমেজটা কিন্তু একেবারেই দুর্বলহৃদয়দের জন্য নয়। গলির মধ্যেই যখন পুরোনো লোহার বড় বড় ঠেলাগাড়ি ভর্তি করে কাপড়ের বান্ডিল টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, আর গলিতে দাঁড়ানোর ঠাঁইটুকুও পাওয়া যায় না- তখন সাহস তো লাগেই! 

ইসলামপুরের ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢাকার অন্যান্য স্থান থেকে আরও বেশি সংকুচিত। যেখানে-সেখানে রয়েছে খোলা নর্দমা, গর্ত। তবে অদ্ভুত ঘটনা হলো, এত বিরক্তিকর বিষয় থাকা সত্ত্বেও ইসলামপুরের জাদু ফুরিয়ে যায় না। দোকানদার, ব্যবসায়ীদেরকে সবসময় দেখা যায় বিভিন্ন কাজে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াতে।

শহরের নকশায় ইসলামপুরের মতো বাজার আর হয় না। মলমল সুতি কাপড় থেকে শুরু করে মার্কিন, সবই এখানে মিলবে দরদামের মূল্যে। এখানকার সবচেয়ে ব্যস্ত মৌসুম শুরু হয় শবে বরাতের ১০ দিন আগে থেকে। রমজানের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে থাকে এই ব্যস্ততা। তাই এখনই সময় এই বাজারটিতে ঢুঁ মেরে আসার।

আমি যেন এখনও সেই পুরোনা আমলের নওয়াবদের মতো প্রাচীন এক জগতে বাস করি। এই গুপ্তধনের গলিতে হেঁটে বেড়াই, খুঁজে দেখি এই ঈদে কী নতুন কাপড় যোগ হলো। আমার নজর কাড়ে মূলত সেলাইবিহীন আনকোরা গজ কাপড়, তৈরি পোশাক আর ঘরবাড়ির কাজে লাগা বিভিন্ন ধরনের কাপড়।

ইসলামপুর বাজার
ছবি: আনিসুর রহমান

ছোটবেলায় এই বাজারটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আমার মা-খালারা। তারাও তখন এখানে ঈদের কেনাকাটায় আসতেন। সাশ্রয়ী মূল্যে ভালো কাপড় কেনার জন্য এটি ছিল তাদের প্রথম পছন্দ। এই বাজার যদিও সবসময়ই পাইকারি কেনাকাটার জন্য ছিল, কিন্তু আমাদের মতো নিয়মিত খুচরা ক্রেতার সংখ্যাও কম নয়।

আমার পছন্দের জরিদার খয়েরি রঙের লেডি হ্যামিল্টন সালোয়ার-কামিজ, বেবি পিংক জর্জেট ম্যাক্সি, ফুলেল প্রিন্টের কাবলি পোশাক আর আমার বাবার জন্য চিকনকারি পাঞ্জাবি–সবই কেনা হতো ইসলামপুরের বাজার থেকে। ভিড়ে গাদাগাদি করা এই গলিগুলোতে অফুরান কাপড়ের ভাণ্ডার মেলা থাকত, নারী-পুরুষ সবার জন্যই। পরে যখন আমি নিজেই বাড়ির দেখাশোনা শুরু করলাম, তখন এখান থেকেই পর্দা, সোফায় ব্যবহারের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে কাপড় কিনতাম।

এই গল্পগুলো মোটামুটি ৩০ বছর আগের। কিন্তু এখনও ইসলামপুর তার সেই পরিচিত ভূমিকা রেখে চলেছে। এখনও ঈদের সময় এলে ঢাকার পুরোনো বাসিন্দারা ইসলামপুরেই ছুটে আসেন দলবল নিয়ে।

বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত ইসলামপুর সেই মোঘল আমলের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখন এতে আছে ৬ হাজার ৫০০টিরও বেশি শোরুম এবং প্রায় ৯৫টি বাজার। যদি রাস্তার ধারের ছোটখাট ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলোকে গোনা হয় তবে এ সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। ইসলামপুরের এই বিশাল কর্মযজ্ঞে কাজ করেন ৬০ থেকে ৭০ হাজার লোক।

১৯৯৮ সাল থেকে ইসলামপুরে ব্যবসা করছেন ইশরাত আহমেদ। তিনি বাচ্চাদের কাপড়ের একটি দোকানের মালিক।

তিনি বলেন, 'ক্রেতারা বিভিন্ন ধরনের পাইকারি বিক্রেতার কাছ থেকে বাহারি রকমের কাপড় বেশ কম দামেই কিনতে পারেন। সিল্ক, রেয়ন, পলিয়েস্টার, জর্জেট কী নেই এখানে? ঢাকার এই পুরোনো বাজারটি মূলত পুরো বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্পের পাইকারি বাজারের একটি বড় অংশ। এখানে তৈরি পোশাক, সুতা ও কাপড় ইত্যাদি সবই পাওয়া যায় পাইকারি মূল্যে।'

ডিজাইনারদের পছন্দের প্রিন্টেড টিস্যু কাপড় থেকে শুরু করে ঐতিহ্যবাহী বেক্সি ভয়েল, সব ধরনের রং ও টেক্সচারের কাপড় পাওয়া যায় এখানে। ভারত, পাকিস্তান, চীন, থাইল্যান্ড এবং জাপান থেকে আসা কাপড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে আমাদের নিজস্ব বস্ত্রশিল্পও। যাকাত দেওয়ার জন্য অনেক ঢাকাইয়া ইসলামপুর থেকে প্রতি ঈদে কোটি টাকার কাপড়ও কিনে থাকেন।

একইসঙ্গে আমদানি করা ও স্থানীয় বাজারের বস্ত্রশিল্পের মেলবন্ধন ঘটে এখানে। গজ কাপড়, তৈরি পোশাক, শাড়ি, লুঙ্গি, বাচ্চাদের পোশাক, সেইসঙ্গে পোশাক সাজানোর বিভিন্ন অনুষঙ্গ যেমন লেইস, বোতাম, পাথর ইত্যাদি সবই মেলে এই ইসলামপুরে। এমনিতেও এখানকার বেচাবিক্রি বেশ ভালো হয়। তবে রমজান মাস এলে স্থানীয়ভাবে তৈরি পোশাকের চাহিদা বহুগুণে বেড়ে যায়।

ইসলামপুরের ব্যবসায়ীদের পণ্যের বড় জোগানদাতা নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, টাঙ্গাইল এবং কেরানীগঞ্জের কারখানাগুলো।

বলা হয়, ১৭০০ সাল থেকেই ঢাকা শহরের বস্ত্রশিল্পের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে ইসলামপুর। সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন ইসলাম খান চিশতিকে প্রথমবার বাংলার ভাইসরয় নির্বাচিত করেন এবং তিনি বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে তার জাহাজ ভেড়ান, তখনই এ স্থান তার নামের সঙ্গে জুড়ে যায়। বছরের পর বছর ধরে মসলিন, মৃৎশিল্প, চামড়াশিল্প, লবণ এবং বস্ত্র কারখানা ইসলামপুরে বড় হয়ে উঠেছে এবং সেইসঙ্গে সমৃদ্ধ হয়েছে ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

আপনি চাইলে এখন অনলাইনেও দেখে নিতে পারেন এই বাজারের পাইকারি পণ্যগুলো। এর জন্য রয়েছে islampurmarket.com। কিন্তু সশরীরে এ বাজারে না গেলে অনেক অভিজ্ঞতাই বাকি রয়ে যাবে।

ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া পথের খোঁজে, নিজেকে পুরোনো বাজারের শব্দ-দৃশ্যের মাঝে ডুবিয়ে দিতে ইসলামপুর হতে পারে আপনার এই ঈদের কেনাকাটার প্রিয় সঙ্গী।

অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী

 

Comments

The Daily Star  | English
US dollar price rises

Explanations sought from 13 banks for higher USD rate

BB issued letters on Dec 19 and the deadline for explanation ends today

31m ago