শিশুকে মারধর করে যেসব ক্ষতি করছেন

শিশুকে মারধর করা
ছবি: সংগৃহীত

শিশুকে শাসন করার নামে মারধর বা শারীরিক নির্যাতন শিশুর মানসিক বিকাশের অন্তরায়। শিশুর গায়ে তোলার ক্ষতিকর দিক এবং শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে করণীয় সম্পর্কে জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

শিশুর গায়ে হাত তোলায় কী সমস্যা হতে পারে

অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, শিশুদের গায়ে কোনোভাবেই হাত তোলা উচিত নয়, সেটা পরিবারের সদস্যরাই তুলুক বা স্কুলের শিক্ষকরাই তুলুক। আইন করে স্কুলে শিশুদের শারীরিক নির্যাতন বা কর্পোরাল পানিশমেন্ট নিষিদ্ধ করা হয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।

বাবা-মায়েদের জন্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, সন্তানের কোনো আচরণকে পরিবর্তন করতে হলে তার গায়ে হাত তোলা যাবে না। বরং তার ইতিবাচক আচরণকে উৎসাহিত করতে হবে এবং নেতিবাচক আচরণের দিকে মনোযোগ কমাতে হবে। শিশুকে মারধর বা গায়ে হাত তোলা হলে ২ ধরনের সমস্যা হয়। যেমন- তাৎক্ষণিক সমস্যা এবং দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা।

তাৎক্ষণিক সমস্যা

শিশুকে মারধর বা গায়ে তোলার কারণে তাৎক্ষণিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে শিশুর ভেতর ভীতি তৈরি হয়ে, আতঙ্ক তৈরি হয় এবং যারা তার গায়ে হাত তো তাদের প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। ফলে শিশুটি আতঙ্কে থাকে এবং এই ভীতির কারণে তার নানা রকম মানসিক উপসর্গ দেখা দিতে পারে। শিশু তীব্র মানসিক চাপে পড়তে পারে, উদ্বিগ্নতা হতে পারে, বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারে, পড়ালেখায় মনোযোগ কমে যেতে পারে। এমনকি সে বিছানায় প্রস্রাব করার মত ঘটনাও ঘটাতে পারে। ৫ বছর বয়সের বেশি শিশু যার বিছানায় প্রস্রাব করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, গায়ে হাত তোলার কারণে আবার বিছানায় প্রস্রাব করা শুরু হতে পারে।

শিশুর মনোযোগের ঘাটতির সঙ্গে তার বিষণ্নতা, নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া, পড়ালেখায় খারাপ হওয়া এই বিষয়গুলো তাৎক্ষণিক একটি সমস্যা। মারধর বা গায়ে হাত তোলার কারণে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়, শিশুর চিন্তার, আবেগ এবং তার আচরণের পরিবর্তন ঘটে। পাশাপাশি যিনি মারধর করছেন তার প্রতি এক ধরনের বিরাগ তৈরি হয়, যা আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক তৈরিতে অন্তরায়।

দীর্ঘমেয়াদী সমস্যা

শিশুর গায়ে হাত তোলার কারণে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যার মধ্যে রয়েছে শিশুর ভেতর ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হওয়া। ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনের অর্থ হচ্ছে শিশুর চিন্তা, আচরণ, ভাবনা, আবেগ সবকিছু একটু এলোমেলো হয়ে যেতে পারে ভবিষ্যতে পরিণত বয়সে। এছাড়া পরিণত বয়সে সে নিজেও একজন নির্যাতক হতে পারে অর্থাৎ অপরকে নির্যাতন করা আর সেটি শিশুদের ক্ষেত্রে হতে পারে, পরিবারের সদস্যদের অথবা রাস্তাঘাটে হতে পারে। অর্থাৎ অন্যের গায়ে হাত তোলা, অন্যকে আঘাত করার প্রবণতা শিশুর মধ্যে বেড়ে যেতে পারে।

শিশুর আচরণের শৃঙ্খলতা দেখা দিতে পারে এবং তার দীর্ঘমেয়াদী বিষণ্ণতাসহ ব্যক্তিত্বের পরির্বতন বা পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার হতে পারে। শৈশবে যে সমস্ত শিশুরা শারীরিক, পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনের মুখোমুখি হয় ভবিষ্যতে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তাদের মধ্যে পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতা, আরেক জনকে আক্রমণ করা যেটি তার উপর এক সময় হয়েছিল শারীরিকভাবে নানাভাবে সেটি প্রকাশিত হতে থাকে প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায়।

ফলে শিশুর মানসিক বিকাশের জন্য এবং ভবিষ্যতে তার সুস্থ ব্যক্তিত্বের গড়নের জন্য অবশ্যই শারীরিক নির্যাতন পরিহার করা উচিত।

শিশুর দুষ্টুমি, বিরক্ত বা কান্নাকাটি থামাতে মারধর না করা

শিশুরা বিরক্ত করলে, দুষ্টুমি করলে, রাগ কিংবা অত্যাধিক কান্নাকাটি থামানোর জন্য বাবা-মায়েরা অনেক সময় শিশুকে মারধর করেন।

এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, 'এটা কোনোভাবেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। শিশুকে মারধর বা শারীরিক নির্যাতন না করে, শাস্তি না দিয়ে তাকে ভালো কাজের জন্য ও কাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য পুরস্কার প্রদানে উৎসাহিত করা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য শিশুর থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া অথবা তার প্রাপ্ত পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করার শাস্তি গ্রহণযোগ্য।'

শিশু কোনো অপরাধ বা খারাপ আচরণ করলে তার দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে হবে এবং তার প্রাপ্ত পুরস্কার প্রত্যাহার করতে হবে। কিন্তু তা না করে শিশুকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হলে ভবিষ্যতে সুদূরপ্রসারী ফল হিসেবে অত্যন্ত খারাপ হয়ে দাঁড়ায়, বিজ্ঞান কোনোভাবেই তা সমর্থন করে না। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে শিশুর গায়ে হাত তোলা শিশুর বিকাশ ও ভবিষ্যতে ব্যক্তিত্ব বাধাগ্রস্ত হয়।

শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে কী করবেন

একটি শিশু বারবার কাউকে থু থু দিচ্ছে, অন্যের শরীরে পা দিয়ে লাথি মারছে তাহলে সেক্ষেত্রে কি করব? শিশুকে মারধর করে থামাব নাকি সেই কাজটি করতে উৎসাহিত করব? উদাহরণ টেনে অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন বলেন, কখনোই শিশুকে এই ধরনের কাজে উৎসাহিত করা যাবে না, আবার তাকে মারধর করাও যাবে না।

শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ থেকে সিভিয়ারিটি দেখতে হবে যে এর গভীরতা কতটুকু। গভীরতা যদি খুব বেশি না হয়, তার জন্য বড় কোনো ক্ষতির কারণ না হয় তবে সেই আচরণকে উপেক্ষা করতে হবে। শিশু অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করে নেতিবাচক মনোযোগ পাওয়ার চেষ্টা করবে। যখন শিশু দেখবে অন্যকে থু থু দিয়ে, লাথি মেরে কারো মনোযোগ সে পাচ্ছে না তখন সে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ করা থেকে বিরত থাকবে। অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো আচরণের দিকে মনোযোগ দেওয়া যাবে না, সেটিকে অগ্রাহ্য করতে হবে, দেখেও না দেখার ভান করতে হবে।  

আর যদি দেখা যায় শিশুর অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের তীব্রতা বেশি, খানিকটা ক্ষতি করছে নিজের জন্য, অপরের জন্য সেক্ষেত্রে শিশুর দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিতে হবে। এছাড়া তার প্রাপ্ত পুরস্কার থাকলে, যেমন-টেলিভিশন দেখা, কার্টুন দেখা, সাইকেল নিয়ে বাইরে যাওয়া এগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। পুরস্কার প্রত্যাহার করা সেটিও শাস্তি আর অন্যায় বা অনাকাঙ্খিত আচরণের জন্য সেটি করা হয়েছে তা বুঝাতে হবে।

শিশুর নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রেখে তার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে হবে, যাতে সে বোঝে অন্যায় করলে কেউ তার পাশে কেউ থাকে না।

 

Comments

The Daily Star  | English

UN eyes major overhaul amid funding crisis, internal memo shows

It terms "suggestions" that would consolidate dozens of UN agencies into four primary departments: peace and security, humanitarian affairs, sustainable development, and human rights.

1h ago