শিশুর স্থূলতার কারণ ও ঝুঁকি, প্রতিরোধে কী করবেন
শিশুর স্থূলতা বর্তমান সময়ে অনেক বেশি উদ্বেগের। অনেকটা নীরব মহামারির আকার ধারণ করছে এটি। আমরা বড়দের স্থূলতা নিয়ে যতটা চিন্তিত শিশুদের স্থূলতা নিয়ে ততটা চিন্তিত না, বরং নাদুসনুদুস শিশুই অনেকের ভালো লাগে। কিন্তু শিশুর স্থূলতা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
শিশুর স্থূলতা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু গ্যাস্ট্রোএন্টোরোলজি ও নিউট্রিশন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রুবাইয়াত আলম রুবার কাছ থেকে।
শিশুর স্থূলতা কী
ডা. রুবাইয়াত আলম বলেন, স্থূলতা মূলত শরীরে অতিরিক্ত যে চর্বি জমা হয় সেখান থেকেই হয়। শিশুর স্থূলতা আর শিশুর অতিরিক্ত ওজন কিন্তু এক বিষয় নয়, দুইটা আলাদা টার্ম। শিশুর স্থূলতা পরিমাপ করতে হয় কিছু বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে। গ্রোথ চার্ট অনুযায়ী শিশুর বয়স, ওজন এবং উচ্চতা কত সেটি নিয়ে শিশুর বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) বের করা হয়। গ্রোথ চার্ট অনুযায়ী যদি তা ৮৬ পারসেন্টাইলের উপরে যায় সেটাকে অতিরিক্ত ওজন বলা হয়। আর ৯৫ পারসেন্টাইলের উপরে গেলে তা শিশুর স্থূলতা।
শিশুর স্থূলতার কারণ
ডা. রুবাইয়াত আলম বলেন, শিশুর স্থূলতা বা ওবেসিটিকে সিম্পল ও প্যাথলজিক্যাল ওবেসিটি এই ২ ভাগে ভাগ করা হয়।
সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সিম্পল ওবেসিটি। ৯০ শতাংশ শিশুরই সিম্পল ওবেসিটি। এর প্রধান কারণ হিসেবে দায়ী শিশুর খাদ্যাভাস। অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার, কোমল পানীয় পান ও জাঙ্ক ফুডে আসক্তির কারণে স্থূলতা হতে পারে। শারীরিকভাবে সক্রিয় না থাকা, বাইরে বের হলে হাঁটাচলার পরিবর্তে যানবাহনের ব্যবহার, সিঁড়ির পরিবর্তে লিফট ব্যবহার, খেলার মাঠ না থাকা, শিশুর স্ক্রিনিং টাইম বেড়ে যাওয়া যেমন- মোবাইল, টেলিভিশন, কম্পিউটার কিংবা ল্যাপটপের প্রতি আসক্তি। আবার ঘুমের ধরন পাল্টালেও তা শিশুর স্থূলতার কারণ হতে পারে।
আর প্যাথলজিক্যাল ওবেসিটিতে শিশুর স্থূলতার পেছনে কোনো জেনেটিক কারণ থাকতে পারে। জেনেটিক কিছু রোগ আছে যেমন ডাউন সিনড্রোম, টার্নার সিনড্রোম। কিছু হরমোনজনিত রোগ যেমন হাইপোথাইরয়েড, কুশিং সিনড্রোমের মতো হরমোনাল রোগের কারণে স্থূলতা হতে পারে। এমনকি কিছু ওষুধ খাওয়ার কারণে স্থূলতা হতে পারে। যেমন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ, এপিলেপসি বা খিঁচুনির জন্য দেওয়া কিছু ওষুধ।
ঝুঁকি
স্থূলতার কারণে শিশুর শরীরে নানা রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন-
১. ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
২. কোলেস্টেরলের তারতম্য ও কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া।
৩. লিভারে চর্বি জমে ফ্যাটি লিভার হওয়া এবং ফ্যাটি লিভার থেকে লিভার সিরোসিস হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
৪. খাদ্যাভাসে ভারসাম্যহীনতা এবং ফল, শাকসবজি ও পুষ্টিকর খাবার না খাওয়ার কারণে ভিটামিন ডি এর অভাব দেখা দেখা দেয়। এর ফলে হাড়ের বিভিন্ন সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন ভিটামিনের ঘাটতি দেখা দেয়। অনেকের কোষ্ঠকাঠিন্য হয়।
৫. ত্বকে সংক্রমণ হতে পারে। অনেক শিশুর ঘাড়ের পেছনে চামড়া কালো হয়ে যায়। ঘুমের সমস্যা হয়।
৬. মেয়ে শিশুদের পলিসিস্টিক ওভারির সিনড্রোম হতে পারে।
শিশুর স্থূলতার চিকিৎসা
ডা. রুবাইয়াত আলম বলেন, একজন শিশু বিশেষজ্ঞ, একজন পুষ্টিবিদ এবং একজন সাইকোলজিস্টকে নিয়ে সমন্বিতভাবে শিশুর স্থূলতার চিকিৎসা করতে হবে। স্থূলতার কারণে শিশুরা বিভিন্ন সময় বুলিংয়ের শিকার হয়, মানসিকভাকে হতাশ ও অবসাদগ্রস্ত থাকে।
স্থূলতার চিকিৎসায় প্রথমেই ওষুধ দেওয়া হয় না শিশুকে। প্রথমে বিহেভিয়ার মডিফিকেশনের অংশ হিসেবে স্থূলতা যে একটি সমস্যা এবং এর থেকে কী হতে পারে তা শিশু ও অভিভাবকদের বোঝাতে হবে। স্থূলতা নিয়ন্ত্রণে খাবারের পুষ্টিগুণ, জাঙ্ক ফুডের বিকল্প খাবার কী হতে পারে এবং কী খাবার খাবে তা ঠিক করে দেওয়া হয় এবং ডায়েট চার্ট মেনে চলতে হবে। নিয়মিত খেলাধুলা ও ব্যায়ামের অভ্যাস করতে বলা হয় এবং কতটুকু ব্যায়াম করল সেটাও লগ বুকের মতো দেখে রাখতে করতে হবে। অতিরিক্ত ওজনের কারণে বডি শেমিংয়ের ডিপ্রেশন থেকে বের করতে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে শিশুর মধ্যে।
প্রি স্কুল চাইল্ড হলে ৩০ থেকে ৬০ মিনিট আনস্ট্রাকচারড খেলাধুলা এবং স্কুলগামী বাচ্চাদের ৩০ মিনিট স্ট্রাকচারড এবং আরও ৩০ মিনিট সুপারভাইজ খেলাধুলার মধ্যে রাখতে হবে।
এসবের মাধ্যমে যদি শিশুর স্থূলতা না কমে সেক্ষেত্রে কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। খুবই ক্ষতিকর স্থূলতা হলে অনেক সময় সার্জারির প্রয়োজন হয়।
প্রতিরোধ
ডা. রুবাইয়াত আলম বলেন, সাধারণত ২ বছরের নিচের শিশুদের প্যাথলজিক্যাল কারণে স্থূলতা বেশি হয়। আর ২ বছর বয়সের পর থেকে সিম্পল ওবেসিটি বেশি দেখা যায়। শিশুর স্থূলতার জন্য মায়ের অতিরিক্ত ওজন, গর্ভাবস্থায় অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, মায়ের জীবনযাপনের ধরনও দায়ী। সন্তান জন্মের পর বুকের দুধের পরিবর্তে শিশুকে ফর্মুলা দুধ খাওয়ানো, ৬ মাস বয়সের পর সুষম খাদ্যের পরিবর্তে কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার খাওয়ানো এসব থেকে স্থূলতা তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে সচেতনতার অভাবে।
- শিশুর স্থূলতা প্রতিরোধে গর্ভাবস্থায় মায়ের বিএমআই ঠিক রাখতে হবে। ডায়াবেটিস ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, হালকা ব্যায়াম, হাঁটাচলা করতে হবে। সন্তান জন্মের পর শিশুকে প্রথম ৬ মাস বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, বোতলে ফর্মুলা বা অন্য দুধ খাওয়ানো যাবে না। ৬ মাস পর সুষম খাদ্যের পাশাপাশি বুকের দুধ খাওয়াতে হবে শিশুকে।
- পরিবারের সবাই মিলে নির্দিষ্ট স্থানে একই সময়ে খেতে হবে। নির্ধারিত সময়ের খাবার বাদ দেওয়া যাবে না। খাওয়ার সময় টেলিভিশন দেখা পরিহার করতে হবে। খাওয়ার প্লেটের সাইজ ছোট হতে হবে।
- শিশুর শোবার ঘরে টেলিভিশন রাখা যাবে না। ভিডিও গেম, টেলিভিশন দেখা, মোবাইল ব্যবহারে সময় বেঁধে দিতে হবে।
- শিশুদের কোনো ভালো কাজের পুরস্কার হিসেবে খাবার রাখা যাবে না।
- স্কুলে শিশুদের জন্য খেলার জায়গা রাখতে হবে এবং কমপক্ষে ১ ঘণ্টা খেলাধুলার সুযোগ তৈরি করতে হবে। স্কুলের ক্যান্টিনে কোমল পানীয় ও জাঙ্ক ফুডের সহজলভ্যতা কমাতে হবে।
- কমিউনিটিতে শিশুদের জন্য সাইকেল চালানো, খেলার মাঠের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- অতিরিক্ত চর্বি ও চিনিযুক্ত খাবার, জাঙ্ক ফুড, কোমল পানীয় পরিহার করতে হবে। বাড়িতে তৈরি খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে, আঁশযুক্ত খাবার, ফল, শাকসবজি খেতে হবে। বয়স ও ওজন অনুযায়ী প্রতিদিন কতটুকু ক্যালরি প্রয়োজন সেই অনুযায়ী খেতে হবে পুষ্টিবিদের পরামর্শে।
- খাবারের পুষ্টিগুণ সর্ম্পকে শিশুসহ অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
Comments