সন্তানের মনে আঘাত না দিয়ে ‘না’ বলবেন যেভাবে

জানুন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে।
সন্তানের মনে আঘাত না দিয়ে 'না' বলবেন যেভাবে
ছবি: সংগৃহীত

বাবা-মা ও সন্তানের বন্ধন পৃথিবীর সবচেয়ে অমূল্য বন্ধন। কেউই চায় না কোনো কারণে এই সম্পর্কে কোন ফাটল ধরুক। তবে মাঝেমধ্যে সন্তানদের কোনো কোনো কাজে বাবা-মাকে কিছুটা কঠোর হতে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। বাবা-মা হিসেবে আপনার কথা এবং কাজ সরাসরি সন্তানের ব্যক্তিত্ব ও মানসিক বিকাশের উপর প্রভাব ফেলে। সন্তানদের কৌতূহল ও নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য সন্তানদের 'না' বলার পদ্ধতি জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

'না' বলার ফলাফল

যদিও আমরা সবসময় চিন্তামুক্ত একটি জীবন কাটাতে চাই, তবে মাঝে মাঝে বাচ্চাদের আচরণ এমন পর্যায়ে চলে যায় যখন বাবা-মায়ের কিছুই করার থাকে না। ধারালো জিনিস নিয়ে খেলা থেকে শুরু করে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া পর্যন্ত অনেক সময় বাবা-মা কঠোর বিধিনিষেধের সঙ্গে সন্তানদের পালন করেন। সন্তানদের রক্ষা করার সহজাত প্রবৃত্তি থেকেই এটি করে থাকেন তারা। বাউন্ডারি তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। তবে সব কাজেই 'না' বললে বাবা মায়ের নিষেধের ইতিবাচক দিকটি সন্তানরা বুঝতে পারে না। অতিরিক্ত শাসন এবং সন্তানের সব কাজে 'না' বলা বাবা-মায়ের জন্য হিতে বিপরীত হতে পারে। অতিরিক্ত শাসনের বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের চাইল্ড অ্যাডোলেসেন্ট অ্যান্ড ফ্যামিলি সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও যখন একটি বাচ্চা ক্রমাগত সেই কাজটিই করতে থাকে, যেমন ধরুন বারবার লাইটের সুইচ অফ অন করা, তাহলে বুঝতে হবে বাচ্চাটি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাইছে। এক্ষেত্রে মনোযোগ দিলে বাচ্চাটি সেই কাজটি করতেই থাকবে। এই পরিস্থিতিতে না বলা কোনো কাজেই আসবে না। তাই সাময়িকভাবে তাদের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে ফেলতে হবে।'

'না বলার পরিবর্তে তাদের আগ্রহ অন্য কোনো দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি হলে তাদেরকে অন্য কোনো দিকে মনোযোগী করে তুলতে হবে', যোগ করেন তিনি।

কখন 'না' বলবেন?

'না' বলার ক্ষেত্রে সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থানের সম্পর্ক রয়েছে। এটি বাচ্চার বয়স, লিঙ্গ এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে। আপনি আপনার বাচ্চার সঙ্গে কঠোর হবেন নাকি হালকাভাবে কথা বলবেন তা নির্ভর করবে এই বিষয়গুলোর ওপর। এক্ষেত্রে বলা যায় 'না' বলার কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই।

এ বিষয়ে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বাচ্চাকে শুধু তখনই 'না' বলতে হবে যখন তার আচরণ বা কোনো কাজ তার নিজের ক্ষতির কারণ হতে পারে অথবা আশেপাশের মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন যদি কোনো টিনএজার ধূমপান করে তাহলে আশেপাশের মানুষের উচিত ধূমপানের পরিণতি, ধূমপান কীভাবে তার নিজের স্বাস্থ্য ও তার আশেপাশের মানুষের ক্ষতি করে সে সম্পর্কে আলোচনা করা।'

তবে অতিরিক্ত 'না' বলা যাবে না। বাচ্চাদের কোনো বিষয় নিষেধ করার আগে চিন্তা করতে হবে, নাহলে এক সময় তারা এটি মেনে নেবে না। আগে থেকেই বাচ্চাদের কোনো বিষয়ের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক করে দিতে হবে।

কেবল আদেশ নয়, পথপ্রদর্শক হোন

সন্তানদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া বাবা-মায়ের কাজ নয়। তারা সন্তানদের জীবনের পথপ্রদর্শক। সন্তানদের নিজেকে নিয়ে চিন্তা করার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। নিজেদের পছন্দমতো জামা, বই অথবা গেমস পছন্দ করার সুযোগ থাকলে তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। তবে অধিকাংশ বাবা-মা সন্তানের ওপর নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি একটি শিশুর চিন্তা করার ক্ষমতা এবং মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে।

সন্তানদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বাচ্চাদের চিন্তা করার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গা তৈরি করে দিতে হবে। আদেশ দেওয়ার পরিবর্তে, অভিভাবকদের উচিত কোনো গল্প, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা বাস্তব জীবনের কোনো ঘটনা দিয়ে তাদের কাজের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করা। বাকিটা বাচ্চাদের ওপর নির্ভর করবে তারা কীভাবে তাদের ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী জীবন গঠন করবে।'

বাচ্চার রাগ ও জেদ সামলাবেন যেভাবে

বাচ্চারা যখন তাদের কথায় অনড় থাকে তখন তাদের ক্রমাগত কান্না ও জেদ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো খাবার, দামি খেলনা বা কোথাও ঘুরতে যাওয়ার জন্য বায়না করলে 'না' বলার পর তাদের জেদ আরও বেড়ে গিয়ে অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তাদের জেদ সামলানোর জন্য প্রথমেই যেসব জিনিস সামনে থাকলে তারা বেশি জেদ করে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। তারা যদি চিৎকার করে তখন আপনাকে শান্ত থাকতে হবে।

ডা.  হেলাল বলেন, 'বাচ্চারা কোনো কিছুর জন্য জেদ করলেই যদি আমরা তাদের সেটি দিয়ে দিই তাহলে তারা এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তাদেরকে কিছু সময় এড়িয়ে চললে তারা বুঝতে পারবে যে জেদ ও কান্নাকাটি আসলে কোনো সমাধান না।'

টিনএজারদের ক্ষেত্রে কেন তাদের কাজটি করতে নিষেধ করা হচ্ছে এবং কাজটির পরিণতি কী হতে পারে সে সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। যুক্তিপূর্ণ আলোচনা ছাড়া তারা এ সম্পর্কে বুঝবে না এবং ভুল কাজ সম্পর্কে তাদের আগ্রহ বেড়েই চলবে।

বাচ্চার আশেপাশে সীমারেখা তৈরি করুন

কোন আচরণগুলো গ্রহণযোগ্য তা বোঝানোর জন্য বাচ্চার আশপাশে সীমারেখা তৈরি করা দরকার। একটি শিশু বড় হয়ে ওঠার সময় নানা রকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যায়। কখনো সে কৌতূহল থেকে উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিতে চায়, কখনো কোনোকিছুকে মারতে চায়, হঠাৎ কোনোকিছু মুখে দিয়ে ফেলে আবার কখনো ধারালো কোনো জিনিসে হাত দেয়।

 

অভিভাবকদের উচিত বাচ্চারা কোন কাজ করতে পারবে না সেটি বারবার না বলে তারা যেসব কাজ করতে পারবে সে সম্পর্কে বলা।

ডা. হেলাল বলেন, 'যখন আমরা বাচ্চাদের জন্য সীমারেখা তৈরি করব, তখন তারা কী কী করতে পারবে না সেটি প্রাধান্য পাবে না। তাহলে তারা, বিশেষ করে শিশুরা সেসব কাজেই বেশি কৌতূহলী হয়ে পড়বে। এর পরিবর্তে তারা কী করতে পারবে সেটি বলুন। যেমন আপনি যদি চান আপনার বাচ্চা রান্নাঘরে না ঢুকুক, আপনি তাদের বলুন তারা লিভিং রুম অথবা খেলার মাঠে খেলতে পারে।'

যেসব বাচ্চারা কিছুটা বড় তাদের সঙ্গে সেসব  বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে সম্ভাব্য ক্ষতি আলোচনা করুন।

ভাষা, গলার স্বর এবং অঙ্গভঙ্গি

বাচ্চাদের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমাদের প্রতি মিনিটের গলার স্বরও বাচ্চাদের জীবনে বড় ভূমিকা রাখে। ভ্রু কুঁচকানো বা রুক্ষভাবে কথা বললে তাতে বাচ্চারা ভাবে বাবা-মায়েরা তাদের প্রত্যাখ্যান করছে এবং ভুল বুঝছে। তাই নিজেদের কথা এবং ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হওয়া উচিত।

ডা. হেলাল আহমেদ বলেন, 'বাবা-মায়েরা অনেক সময় বলেন ''দেখা যাক'', ''অন্য কোনো সময়'', ''আমরা এ বিষয়ে পরে কথা বলব'' । এ ধরনের অস্পষ্ট বাক্যগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। অস্পষ্ট বাক্য বাচ্চাদের বিভ্রান্ত করে, বিশ্বাস কমিয়ে দেয় ও তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায় প্রভাব ফেলে। ভাষা হতে হবে যথাযথ এবং গলার স্বর হতে হবে নমনীয়।'

অভিভাবকত্ব একটি দলগত কাজ। সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে বাবা-মাকে সব বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'যদি বাবা-মার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হয় এবং তারা দুজন ভিন্নভাবে বাচ্চাদের লালন-পালন করতে চান তাহলে বাচ্চার মনে একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। তাই হ্যাঁ বা না বলার আগে বাবা-মায়ের নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সন্তানদের লালন-পালন করা জরুরি।'

অনুবাদ করেছেন সৈয়দা সুবাহ আলম

 

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh ranks 84th among 127 countries in Global Hunger Index

The level of hunger in Bangladesh this year has been categorised as "moderate"

26m ago