গাজায় ইসরায়েলের নতুন সামরিক পরিকল্পনা যেন ‘আরেক নাকবা’

গাজাকে ফিলিস্তিনিমুক্ত করার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছে আইডিএফ। ছবি: আইডিএফের ওয়েবসাইট
গাজাকে ফিলিস্তিনিমুক্ত করার নতুন পরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছে আইডিএফ। ছবি: আইডিএফের ওয়েবসাইট

গাজা পুরোপুরি দখলের পরিকল্পনা এঁটেছে ইসরায়েল। এই লক্ষ্য পূরণের সামরিক পরিকল্পনাও দেশটির নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার অনুমোদন পেয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজাবাসীর ওপর নেমে আসতে যাচ্ছে 'আরেক নাকবা (মহাবিপর্যয়)।'

এই প্রেক্ষাপটে হামাস জানিয়েছে, তারা আর যুদ্ধবিরতির আলোচনা চালিয়ে যেতে আগ্রহী নয়।

হামাসের বক্তব্য

ইসরায়েলি হামলার পর ধ্বংসযজ্ঞ পর্যবেক্ষণ করছেন ফিলিস্তিনিরা। ছবি: এএফপি
ইসরায়েলি হামলার পর ধ্বংসযজ্ঞ পর্যবেক্ষণ করছেন ফিলিস্তিনিরা। ছবি: এএফপি

হামাসের শীর্ষ কর্মকর্তা বাসেম নাঈম আলোচনায় অনাগ্রহের বিষয়টি উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন বন্ধে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

এই হামাস কর্মকর্তা এএফপিকে বলেন, 'যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েল গাজার বাসিন্দাদের ক্ষুধার্ত রেখে তাদেরকে ধ্বংসের যুদ্ধ অব্যাহত রাখছে, ততদিন পর্যন্ত আলোচনায় অংশ নেওয়া বা নতুন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব বিবেচনায় নেওয়ার মানে হয় না।'

'বিশ্ববাসীকে নেতানিয়াহুর সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা গাজার মানুষকে ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত রাখা ও হত্যার মতো অপরাধগুলো বন্ধ হয়।'

ইসরায়েলের গাজা দখলের পরিকল্পনা

সামরিক অভিযানের মাত্রা বাড়ানোর পর লাখো রিজার্ভ সেনা তলব করেছে ইসরায়েল। ছবি: এএফপি
সামরিক অভিযানের মাত্রা বাড়ানোর পর লাখো রিজার্ভ সেনা তলব করেছে ইসরায়েল। ছবি: এএফপি

হামাসের রাজনৈতিক শাখার সদস্য ও গাজার সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাঈম এই মন্তব্য করার একদিন আগে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা গাজার অভিযানের মাত্রা বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এজন্য হাজারো রিজার্ভ সেনা মোতায়েনের ঘোষণাও দেয় আইডিএফ।

ইসরায়েলের এই পরিকল্পনায় আছে গাজার বেশিরভাগ মানুষকে তাদের বাসস্থান থেকে সরিয়ে ওই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।

দেশটির নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা সামরিক বাহিনীর সম্প্রসারিত অভিযানের পরিকল্পনায় সায় দেওয়ার পরই আসে এই ঘোষণা।

এক ইসরায়েলি কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করা হলে 'গাজা উপত্যকা ও সমগ্র (ফিলিস্তিনি) ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ' নিশ্চিত হবে।

গত সোমবার ইসরায়েলের অপর এক জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, 'ওই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয় হলো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সব গাজাবাসীকে সরিয়ে নেওয়ার বৃহত্তর উদ্যোগ। তাদেরকে সরিয়ে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হবে।'

সামরিক মুখপাত্র এফি দেফরিন জানিয়েছেন, নতুন সামরিক পরিকল্পনায় 'প্রাণ বাঁচাতে বেশিরভাগ গাজাবাসীকে নিরাপদ অবস্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে।'

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর পর গাজার বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি অন্তত একবার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার জেরে অনেকে একাধিকবার নিজ বাড়ি বা সাময়িক আশ্রয় ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন।

গত ২ মার্চ থেকে গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে ইসরায়েল। এর ফলে ওই অঞ্চলে তৈরি হয়েছে তীব্র মানবিক সংকট।

প্রায় দুই মাসের যুদ্ধবিরতির পর নতুন চুক্তি না হওয়ায় গত ১৮ মার্চ থেকে আবারও পুরোদমে গাজায় হামলা করছে ইসরায়েল।

গত সোমবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নতুন করে হামলা শুরুর পর নিহতের সংখ্যা দুই হাজার ৪৫৯ ছাড়িয়েছে। ইতোমধ্যে গাজার যুদ্ধে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬৭ জন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আশঙ্কা, নিন্দা

গাজার নুসেইরাতের আশ্রয় শিবিরে গরম খাবারের অপেক্ষায় ফিলিস্তিনিরা। ছবি: এএফপি
গাজার নুসেইরাতের আশ্রয় শিবিরে গরম খাবারের অপেক্ষায় ফিলিস্তিনিরা। ছবি: এএফপি

ইসরায়েলের নতুন এই পরিকল্পনায় আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গত সোমবার তিনি বলেন, 'এই পরিকল্পনায় আমি আতঙ্কিত।' তার মতে, এই পরিকল্পনার 'অনিবার্য পরিণতি হলো আরও বেসামরিক মানুষ মারা পড়বেন এবং গাজা আরও ধ্বংসযজ্ঞের মধ্য দিয়ে যাবে।'

গুতেরেসের বরাত দিয়ে জাতিসংঘের মুখপাত্র ফারহান হক বলেন, 'ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ গাজা।'

গত মঙ্গলবার ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জঁ-নোয়েল বাখো ইসরায়েলের এই পরিকল্পনাকে 'অগ্রহণযোগ্য' বলে মত দিয়ে জানান, ইসরায়েলি সরকার 'মানবিক আইন লঙ্ঘন করছে।'

আজ বুধবার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের বিরোধিতা করে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, 'চীন ফিলিস্তিন-ইসরায়েল পরিস্থিতি নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমরা গাজায় ইসরায়েলের চলমান সামরিক অভিযানের বিরোধিতা করি। আমরা আশা করি, সংশ্লিষ্টরা ধারাবাহিক ও কার্যকর যুদ্ধবিরতির চুক্তি বাস্তবায়ন করবে।'

'আরেক নাকবা'

১৯৪৮ সালে নাকবার সময় হাইফা ছেড়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। ফাইল ছবি: সংগৃহীত
১৯৪৮ সালে নাকবার সময় হাইফা ছেড়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। ফাইল ছবি: সংগৃহীত

বিশ্লেষকদের মতে, এই নতুন পরিকল্পনা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল গঠন ও ফিলিস্তিনিদের গণহারে তাদের নিজ ভূখণ্ড থেকে বিতাড়ণের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এটি 'মহাবিপর্যয়' বা 'নাকবা' নামে পরিচিত।

সামনেই আসছে 'নাকবা' বা 'মহাবিপর্যয় দিবস'। প্রতি বছর ১৫ মে বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিরা 'নাকবা দিবস' পালন করেন। প্রায় ৭৭ বছর আগে তাদের ওপর নেমে এসেছিল ঘর হারানোর দিন।

সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। সেই নির্যাতন-দখলদারত্ব আজও তাড়া করছে তাদের।

১৯৪৮ সালের ১৪ মে বদলে যায় মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে ইহুদিদের জন্য নতুন রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এতে সহায়তা করে যুক্তরাজ্য। নতুন রাষ্ট্রটির নাম রাখা হয় ইসরায়েল। ইহুদিদের মতে, নতুন রাষ্ট্র গঠন করে তারা 'ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি'তে ফিরে এসেছেন। এই ভূমি তাদের।

ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরদিন থেকেই স্থানীয় আরব অধিবাসীদের ওপর নেমে আসে মহাবিপর্যয় বা আল-নাকবা। ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠী ও সেনারা ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য হত্যা-লুট-অগ্নিসংযোগ শুরু করেন। প্রাণভয়ে লাখো ফিলিস্তিনি বাড়িঘর, সহায়-সম্পত্তি ছেড়ে পালাতে থাকেন। প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি জর্ডান, লেবানন ও সিরিয়ায় উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেন।

অবধারিতভাবেই, বিশ্লেষকরা নেতানিয়াহু সরকারের নতুন পরিকল্পনার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী নাকবার মিল খুঁজে পেয়েছেন।

Comments