যতদিন গাজার ক্ষমতায় হামাস, ততদিন যুদ্ধ: নেতানিয়াহু

জাতির উদ্দেশে ভাষণে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের ওয়েবসাইট
জাতির উদ্দেশে ভাষণে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ছবি: নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের ওয়েবসাইট

'যুদ্ধ শেষ করতে রাজি হওয়ার সঙ্গে হামাসের কাছে আত্মসমর্পণের পার্থক্য নেই' বলে মন্তব্য করেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি তা কখনো করবেন না বলেও জানিয়েছেন।

নেতানিয়াহুর ভাষ্য—হামাস যতদিন গাজার ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হবে।

দেশের জনগণের উদ্দেশে দেওয়া পূর্বে ধারণকৃত ভাষণে নেতানিয়াহু এসব কথা জানান।

ভাষণে গাজাযুদ্ধ নিয়ে সার্বিকভাবে ইসরায়েলি নেতার মনোভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা গেছে।

আজ রোববার টাইমস অব ইসরায়েল, সিএনএন ও আল জাজিরাসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশ করেছে।

ভাষণের প্রেক্ষাপট

গাজার খান ইউনিসের আশ্রয় শিবিরে ইসরায়েলের বিমান হামলা। ছবি: এএফপি
গাজার খান ইউনিসের আশ্রয় শিবিরে ইসরায়েলের বিমান হামলা। ছবি: এএফপি

নেতানিয়াহুর কার্যালয় তার এই ভাষণকে 'কূটনীতিক বিষয় নিয়ে (প্রধানমন্ত্রীর) বিশেষ বিবৃতি' বলে আখ্যা দিয়েছে।

গত চার মাস দেশের মাটিতে গণমাধ্যমের সামনে সংবাদ সম্মেলনে হাজির হননি নেতানিয়াহু।

তাকে সরাসরি প্রশ্ন করারও সুযোগ পাননি দেশটির কোনো সাংবাদিক। ইহুদিদের পবিত্র পাসওভার উৎসব শেষ হওয়ার ও যুদ্ধবিরতির নতুন প্রস্তাব হামাস নাকচ করার দুই দিন পর নেতানিয়াহুর এই আগে ধারণ করা ভিডিও বক্তব্য প্রচার করা হলো।

মূলত, হামাসের নতুন চুক্তিতে সম্মতি না দেওয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নেতানিয়াহুর এই ভাষণ দেওয়া।

যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েল বলেছিল হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের অর্ধেককে মুক্তির বিনিময়ে আবারও গাজায় সাময়িক যুদ্ধবিরতি হবে।

ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠনটি জানায়, গণহত্যা বন্ধ হওয়ার নিশ্চয়তা নেই বা গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি নেই—এমন কোনো 'আংশিক চুক্তি' তারা মেনে নিবে না।

হামাস 'নির্বোধ নয়', তাদের ধোঁকা দেওয়া সম্ভব না

হামাস সদস্যদের কড়া প্রহরায় মরদেহ হস্তান্তর শেষ হয়। ছবি: এএফপি
হামাস সদস্যদের কড়া প্রহরায় মরদেহ হস্তান্তর শেষ হয়। ছবি: এএফপি

নেতানিয়াহুর যুক্তি, বর্তমান পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি দেওয়া হলে হামাস আবারও সামরিক সক্ষমতা অর্জন করবে।

তিনি দাবি করেন, হামাসকে 'ধোঁকা' দেওয়া সম্ভব না। অর্থাৎ, যুদ্ধে সাময়িক বিরতি দিয়ে জিম্মিদের উদ্ধার করে এনে আবারও সামরিক অভিযান শুরু করা সম্ভব হবে না।

কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন—হামাস এমন কিছু শর্ত দিয়েছে যার সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের সংযোগ আছে। সেসব শর্ত মেনে নিলে বাকি জিম্মিরা মুক্তি পাবেন, কিন্তু প্রয়োজন হলেও গাজায় হামলা চালাতে পারবে না ইসরায়েল। কেননা, দেশটিকে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গাজায় হামলা না করার অঙ্গীকার করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, 'যারা হামাসকে ধোঁকা দিয়ে কার্যসিদ্ধির কথা বলছেন, তারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না।'

জিম্মি মুক্তি দিয়ে স্থায়ীভাবে যুদ্ধ বন্ধের চক্রান্ত করছে হামাস, এমন দাবি তোলেন নেতানিয়াহু।

তিনি অভিযোগ করেন, হামাস বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার সর্বশেষ চুক্তিকে স্থায়ীভাবে গাজার যুদ্ধ বন্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

এই অপচেষ্টার অংশ হিসেবে তারা দাবি করেছে, ইসরায়েলি সেনাদের গাজা থেকে সরে যেতে হবে।

নেতানিয়াহু যুক্তি দেন, যুদ্ধ বন্ধ হলে এই সংঘাত থেকে ইসরায়েল যা অর্জন করেছে, তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।

হামাসের সঙ্গে প্রতারণা মেনে নেবে না বিশ্ব সম্প্রদায়

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে লেবানন প্রসঙ্গে বৈঠক করছে নিরাপত্তা কাউন্সিল। ছবি: রয়টার্স
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে লেবানন প্রসঙ্গে বৈঠক করছে নিরাপত্তা কাউন্সিল। ছবি: রয়টার্স

নেতানিয়াহুর ভাষায়—হামাসের দাবি, মিসর-গাজা সীমান্তের ফিলাডেলফি করিডর ও ওই অঞ্চলকে ঘিরে ইসরায়েলের তৈরি করা নিরাপদ অঞ্চল (বাফার জোন) থেকেও ইসরায়েলি সেনাদের সরে যেতে হবে। হামাস 'আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তার' দাবি করেছে, যাতে জিম্মিরা মুক্তি পাওয়ার পর ইসরায়েল নতুন করে আবারও হামলা চালাতে না পারে।

তার ভাষ্য, 'অনেকেই বলছেন, হামাসের সঙ্গে ছলনা করতে। গাজা ও ফিলাডেলফি করিডর ছেড়ে চলে যান, অঙ্গীকার করুন আর যুদ্ধে যাবেন না। এরপর সব জিম্মি মুক্তি পেলে, আবারও যুদ্ধ শুরু করুন।'

হামাসকে 'ঘৃণ্য খুনের দল' হিসেবে উল্লেখ করে নেতানিয়াহু বলেন, 'কিন্তু তারা নির্বোধ নয়।'

'তারা অলঙ্ঘনীয় আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তা চাচ্ছে। এর মধ্যে এ ধরনের ছলনার সুযোগ নেই, যা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ সুপারিশ করছেন,' যোগ করেন তিনি।

'এই লোকগুলো আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, অন্য যেকোনো দেশ কিংবা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ ধরনের প্রতারণা মেনে নেবে না। এটা বাস্তবায়ন হলে আর কখনোই (হামাসের বিরুদ্ধে) যুদ্ধে ফেরা সম্ভব হবে না।'

'তখন আর আমাদের যুদ্ধের বৈধতা থাকবে না। মিথ্যে অঙ্গীকার বলে কিছু নেই। আমরা যদি যুদ্ধ থামানোর অঙ্গীকার করি, তাহলে আমরা আর গাজায় সামরিক অভিযানে ফিরতে পারব না।'

হামাসকে নির্মূল না করার পরিণাম

সেনাদের সঙ্গে উত্তর গাজা পরিদর্শনে নেতানিয়াহু। ছবি: এএফপি (১৫ এপ্রিল, ২০২৫)
সেনাদের সঙ্গে উত্তর গাজা পরিদর্শনে নেতানিয়াহু। ছবি: এএফপি (১৫ এপ্রিল, ২০২৫)

জিম্মি মুক্তির বিষয়ে হামাসের দাবি মেনে নিলে এই যুদ্ধ থেকে ইসরায়েলের সব অর্জন মুছে যাবে বলে দাবি করেন নেতানিয়াহু।

'অসংখ্য সেনা নিহত ও আহত হয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগেই আমাদের এসব অর্জন।'

প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ইসরায়েল যদি হামাসের সামরিক সক্ষমতা ধ্বংসের কাজ শেষ না করে তাহলে সংগঠনটি অনতিবিলম্বে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামলা চালাবে এবং নাগরিকদের জিম্মি করার চেষ্টা চালাবে।

নেতানিয়াহু আরও বলেন, 'হামাসকে গাজার ক্ষমতায় রেখে দিলে তা ইসরায়েলের জন্য বড় পরাজয় ও ইরানের জন্য বিজয় হিসেবে বিবেচিত হবে।'

হামাসের কাছে 'নতি স্বীকার' করা হবে না

ইয়েমেনে মার্কিন ও ইসরায়েলি পতাকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ। ছবি: এএফপি
ইয়েমেনে মার্কিন ও ইসরায়েলি পতাকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ। ছবি: এএফপি

'আপনাদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি খুনিদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করব না। তারা হলোকাস্টের পর ইহুদি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছে। এ ধরনের নতি স্বীকার আমাদের দেশ ও দেশের জনগণকে বিপদে ফেলবে।'

হামাসের দাবির কাছে 'আত্মসমর্পণের' আহবানের প্রতি নিন্দা জানান নেতানিয়াহু।

তিনি আরও জানান, এ ধরনের দাবির মাত্রা বেড়েছে। প্রতিদিনই হামাসকে নির্মূল করা বা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার চেয়ে জিম্মিদের মুক্তির বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে অসংখ্য চিঠি পাচ্ছেন বলে উল্লেখ করেন।

নেতানিয়াহু বলেন, 'এ ধরনের দাবি মেনে নিলে ইসরায়েল গত বছর গাজার দক্ষিণাঞ্চলের শহর রাফায় প্রবেশ করতে পারতো না। ফিলাডেলফি করিডরের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারত না। হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে পেজার হামলা চালাতে পারত না। হামাসের নেতাদের হত্যা করতে পারত না। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারত না। সার্বিকভাবে, ইরানের এত বড় ক্ষতি করতে পারত না।'

তিনি বলেন, ইসরায়েল 'অস্তিত্ব সংকটের' মধ্যেই বেঁচে থাকতে বাধ্য হতো।

অন্যান্য বিষয়

গাজায় নিহত ফিলিস্তিনির মরদেহকে ঘিরে স্বজনদের আহাজারি। ছবি: এএফপি
গাজায় নিহত ফিলিস্তিনির মরদেহকে ঘিরে স্বজনদের আহাজারি। ছবি: এএফপি

প্রায় ১২ মিনিটের বক্তব্যে নেতানিয়াহু আরও জানান, ইরান যাতে কোনোভাবেই পরমাণু অস্ত্র না পায়, তা তিনি নিশ্চিত করবেন। ইরানের পরমাণু অবকাঠামোয় হামলা না চালানোকে 'ব্যর্থতা' হিসেবে উল্লেখ করা এবং এ ধরনের সমালোচনাকে তিনি 'ভণ্ডামি' বলে উল্লেখ করেন।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি জিম্মি পরিবারের সদস্যদের সংগঠন 'দ্য হোস্টেজেস অ্যান্ড মিসিং ফ্যামিলিস ফোরাম' কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

তাদের দাবি, বাকি জিম্মিদের ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা নেই নেতানিয়াহুর।

তারা জানান, 'অনেক শব্দ ও শ্লোগান শোনা গেলেও সহজ বিষয় লুকানো সম্ভব নয়—নেতানিয়াহুর হাতে কোনো পরিকল্পনা নেই।'

Comments

The Daily Star  | English

Cops get whole set of new uniforms

The Inspector General of Police (IGP) has issued a comprehensive new dress code titled Police Dress Rules, 2025, detailing rank-wise uniforms and accessories for all Bangladesh Police members.

5h ago