বেলারুশে পরমাণু অস্ত্র: কোন দিকে যাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ

ইউক্রেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন, রাশিয়া, পরমাণু অস্ত্র, বেলারুশ, শি জিনপিং, ভ্লাদিমির পুতিন,
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দিন দিন আরও জটিল হচ্ছে। ছবি: এএফপি

ইউক্রেনে যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে না। বরং আরও নতুন উদ্যমে তা শুরুর প্রচেষ্টা দৃশ্যমান।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাম্প্রতিক মস্কো সফরে শান্তিবাদী মানুষের মনে আশা জেগেছিল। অনেকে ভেবেছিলেন, হয়তো 'যুদ্ধবিরতি'র ঘোষণা আসতে পারে।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। জিনপিংয়ের মস্কো ছাড়ার পর পরিস্থিতি 'পরমাণু সংঘাতের' আশঙ্কার দিকে গেছে।

সোমবার আল-জাজিরা জানায়, বেলারুশে পরমাণু অস্ত্র পাঠানোর বিষয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে ইউক্রেন 'কার্যকর ব্যবস্থা' নিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ অধিবেশনের অনুরোধ করেছে।

এরপর সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট পুতিন তার সমস্যাগুলো থেকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ঘোরাতে বেলারুশে কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র পাঠানোর মতো ভয়ংকর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।

বৈশ্বিক করোনা মহামারির পরপরই এমন যুদ্ধ পুরো বিশ্বকে সংকটে ফেলে দিলেও যুদ্ধ বন্ধে কোনো বিশ্বনেতা বা বিশ্ব সংস্থার কার্যকর 'দূতালি' এখনো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।

জাতিসংঘ ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দার পাশাপাশি অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানালেও তা কার্যত কোনো সুফল বয়ে আনেনি।

শক্তিশালী আঞ্চলিক জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন আক্রান্ত ইউক্রেনের পাশে দাঁড়ানোয় তারা 'নিরপেক্ষতা' হারিয়েছে বলে মনে করছে রাশিয়া ও এর মিত্ররা।

পরাশক্তি দেশগুলোর মধ্য থেকে 'সবার জন্য গ্রহণযোগ্য' উদ্যোগ দৃশ্যমান না হওয়ায় ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এই যুদ্ধ ধীরে ধীরে ৪০০তম দিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

'পরমাণু যুদ্ধের' আশঙ্কা

গত ২২ মার্চ চীনা প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের মস্কো ছাড়ার পরপরই ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন এক সংকটময় পরিস্থিতির দিকে মোড় নেয়। গত শনিবার রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আরটি জানায়, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন— চলতি গ্রীষ্মে প্রতিবেশী বেলারুশে পরমাণু অস্ত্র পৌঁছাবে।

রাশিয়া টোয়েন্টিফোর টিভিকে প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেছেন, 'পরমাণু অস্ত্র মজুত রাখতে বেলারুশে মস্কো উপযুক্ত স্থাপনা তৈরি করছে। এ কাজ আগামী ১ জুলাই শেষ হবে।'

বেলারুশের বার বার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র পাঠানো হচ্ছে উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট পুতিন আরও বলেন, 'তবে এর নিয়ন্ত্রণ বেলারুশের হাতে দেওয়ার পরিকল্পনা নেই।'

সংবাদ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ঠিক কবে পরমাণু অস্ত্র বেলারুশে পৌঁছাবে, সে বিষয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি।

একই দিনে রয়টার্স জানায়, ইউক্রেনে ন্যাটোর সামরিক সহায়তার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটিকে সতর্ক করতে হয়তো রুশ প্রেসিডেন্ট এমন ঘোষণা দিয়েছেন।

এতে আরও বলা হয়, এটা কোনো অপ্রত্যাশিত ঘোষণা নয়। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসনের পর থেকেই মস্কো শত্রুপক্ষকে পরমাণু হামলার হুমকি দিয়ে আসছে।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট পুতিনের এমন ঘোষণায় বিশ্বের শীর্ষ সামরিক শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। নাম প্রকাশ না করে মার্কিন এক জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেছেন, 'রাশিয়ার পক্ষ থেকে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।'

তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বার্তা সংস্থাটিকে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট পুতিনের এই ঘোষণাকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।

পরমাণু অস্ত্রবিরোধী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পেইন টু অ্যাবোলিশ নিউক্লিয়ার উইপনস রুশ প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণাকে 'ভয়াবহ বিপজ্জনক' হিসেবে মন্তব্য করেছে।

টুইটার বার্তায় সংগঠনটি বলেছে, পরমাণু অস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এটি মানবিক বিপর্যয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।

চীনা শান্তি প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ

যুদ্ধ বন্ধে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন ১২ দফা প্রস্তাব দিলেও তা নিয়ে বিবদমান পক্ষগুলোর তেমন আগ্রহ দেখা যায়নি।

তবুও শান্তিবাদী মানুষের আশা ছিল, বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী চীনের উদ্যোগে হয়তো যুদ্ধ বন্ধের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।

গত ২০ মার্চ শুরু হওয়া মস্কোয় চীনা প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের ৩ দিনের সফরে যুদ্ধ বন্ধের 'ক্ষীণ' আশা জাগলেও সেই সফরে বেইজিংকে মিত্র দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে বেশি আগ্রহী হতে দেখা গেছে।

এমন পরিস্থিতিতে চীনের 'শান্তি প্রচেষ্টা' কোনো পক্ষেরই আস্থা অর্জন করতে পারেনি বলে ধারণা করা যেতে পারে। এই প্রস্তাবকে ঘিরে যুদ্ধ বন্ধের নতুন সম্ভাবনা দেখা যাবে কি না— তা এখন প্রশ্ন সাপেক্ষ।

শি জিনপিংয়ের মস্কো সফরের প্রভাব

চীনা প্রেসিডেন্টের গত ২০ মার্চ শুরু হওয়া মস্কো সফর নিয়ে ২ দেশের সংবাদমাধ্যম ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আহ্বানের তুলনায় দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদারের বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে।

অনেকে আশা করেছিলেন—ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে বেইজিংয়ের ১২ দফা প্রস্তাব নিয়ে প্রেসিডেন্ট জিনপিং মস্কোয় জোরালোভাবে কিছু বলবেন। অনেকের আশা ছিল, তার সফরকে ঘিরে হয়তো মস্কো থেকে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসবে। কিন্তু বাস্তবে এসব কিছুই হয়নি।

সফরের প্রথম দিনে প্রেসিডেন্ট জিনপিং রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন বলে জানায় রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম তাস।

জিনপিংয়ের সফরের শেষ দিন ২২ মার্চ ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন, চীনা প্রেসিডেন্টের রাশিয়া সফর ক্রেমলিনের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে পশ্চিমের দেশগুলো কী ভাবল, তা নিয়ে মস্কো চিন্তিত নয়।

চীনা প্রেসিডেন্টের মস্কো সফর নিয়ে গত ২৪ মার্চ ফরেন পলিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠায় চীন রাজনৈতিক ঝুঁকিতে পড়ছে। তবে রাশিয়ার এই সংকটে চীন ইউরো-এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের পাশাপাশি মস্কো থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে বলেও এতে মন্তব্য করা হয়।

রুশ অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদনে গত ১৭ মার্চ রয়টার্স জানায়, পশ্চিমের নিষেধাজ্ঞায় বিপর্যস্ত রুশ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাজাখ সহযোগীদের কাছে ছুটছে।

এতে আরও বলা হয়, গত ১ বছরে কাজাখস্তান থেকে রাশিয়ায় রপ্তানি ৪ ভাগের ১ ভাগ বেড়ে ৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

গত ২৩ মার্চ মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজ জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শীতল সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে জিনপিংয়ের সফর মস্কোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রসারিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এতে আরও বলা হয়, প্রেসিডেন্ট পুতিনকে চলতি বছরেই বেইজিং সফরের আহ্বান জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট।

ব্রাসেলসভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ চীন-বিশ্লেষক আমান্দা সিয়াও সংবাদমাধ্যমটিকে বলেন, 'জিনপিংয়ের সফর দিয়ে পুতিন প্রমাণ করতে চান যে, তিনি আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন নন। অন্যদিকে, ওয়াশিংটনকে চীনা প্রেসিডেন্ট বোঝাতে চাচ্ছেন যে, ক্রমাগত মার্কিন চাপের পরও বেইজিং একা নয়।'

যুদ্ধ কি আরও জটিল হচ্ছে

গত ১ মার্চ থেকে রাশিয়ায় বসন্ত চলছে। আপাতদৃষ্টিতে 'রুশ বসন্ত' বিশ্ববাসীর জন্য কোনো সুখবর বয়ে আনছে না বলেই মনে হয়। পশ্চিমের সংবাদ প্রতিবেদনগুলোয় বলা হচ্ছে, শীত কেটে যাওয়ায় বিবাদমান পক্ষগুলো তীব্র হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ইউক্রেনের পক্ষ নেওয়া পশ্চিমের দেশগুলো আরও অত্যাধুনিক ট্যাংক, কামানসহ নতুন নতুন মারণাস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা দিচ্ছে। এমনকি, ইউক্রেনে যুদ্ধবিমান পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে ন্যাটো দেশ পোল্যান্ড ও স্লোভাকিয়া।

পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমগুলোয় ক্রমাগত বলা হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞার কারণে রুশ অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। তবে এর প্রভাব যুদ্ধক্ষেত্রে খুব একটা পড়ছে না। রুশ সেনারা ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ ভাষাভাষী ৪ অঞ্চলে সীমিত হয়ে থাকলেও সেসব অঞ্চল দখলমুক্ত করতে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন ইউক্রেনীয় সেনারা।

সম্প্রতি ডয়েচে ভেলের এক ভিডিও প্রতিবেদনে এক ইউক্রেনীয় সেনা বলেছেন, 'মনে হচ্ছে রুশদের গোলাবারুদ কখনোই ফুরাবে না।'

রুশ সেনাদের হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাচ্ছে না বলে অপর এক ভিডিও প্রতিবেদনে দাবি করেন পুতিনবিরোধী রুশ রাজনৈতিক কর্মীরা।

এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গণমাধ্যমকে বলেছেন, নতুন অস্ত্র না পেলে রাশিয়ার হামলার জবাব দেওয়া সম্ভব হবে না।

জাপানি দৈনিক ইউয়োমিউরি শিম্বুনকে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পূর্ব ইউক্রেনের পরিস্থিতি 'ভালো না'। তিনি আরও বলেন, 'মিত্রদের কাছ থেকে গোলাবারুদ পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।'

যুদ্ধ থামবে না বাড়বে

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বলা যেতে পারে যে আগামী দিনগুলোয় ইউক্রেন যুদ্ধ আরও জটিল রূপ নিতে পারে। ভয়াবহ শীত কেটে যাওয়ায় নতুনভাবে উদ্দীপ্ত ইউক্রেনের সেনারা। তারা নতুন অস্ত্র নিয়ে রুশ বাহিনীকে দখলকৃত সব অঞ্চল থেকে সরিয়ে দিতে চায়।

অন্যদিকে, রাশিয়া যেকোনো মূল্যে ধরে রাখতে চায় ক্রিমিয়াসহ ইউক্রেনের রুশ অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো। তাই আপাতদৃষ্টিতে যুদ্ধ থামার কোনো ইঙ্গিত মিলছে না।

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago