কিডনি ডায়ালাইসিস নিয়ে চমেক হাসপাতালে যা চলছে

ডায়ালাইসিসের খরচ বৃদ্ধির প্রতিবাদে চমেক হাসপাতালে গতকাল কিডনি রোগী ও স্বজনদের বিক্ষোভ করেন। ছবি: রাজিব রায়হান/স্টার

জহিরুল ইসলামকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ডায়ালাইসিস সেন্টারে সেবা নিতে হয়। কিডনি ফেইলিউরের রোগী জহিরুল আগে প্রতি সেশনে ৫১০ টাকায় ডায়ালাইসিস সেবা পেতেন। 

তাকে প্রতি মাসে ৮টি সেশন নিতে হয়। তাই ডায়ালাইসিসের জন্য তার মাসিক ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৮০ টাকা।

হঠাৎ করে কেন্দ্র পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করে, জানুয়ারি থেকে জহিরুলকে প্রথম ৪ সেশনের প্রতিটির জন্য ২ হাজার ৯৩৫ টাকা এবং বাকি ৪ সেশনের প্রতিটির জন্য ৫৩৫ টাকা দিতে হবে। অর্থাৎ জহিরুলের ডায়ালাইসিসের জন্য পরিবারকে প্রতি মাসে ১৩ হাজার ৮৭০ টাকা খরচ করতে হবে। 

২০১৭ সালে চমেক হাসপাতালে একটি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপনে ভারতীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর মেডিকেডস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে একটি পিপিপি চুক্তি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

স্বামীর চিকিৎসার বাড়তি টাকা কীভাবে জোগাড় হবে, সে চিন্তায়  দিশেহারা হয়ে পড়েন জহিরুলের স্ত্রী নীলু বেগম। নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জের বাসিন্দা নীলু জীবিকা নির্বাহের জন্য গৃহকর্মীর কাজ করেন। এই দম্পতির একটি মেয়ে আছে। এদিকে অসুস্থতার কারণে জহির কাজ করতে পারেন না।   

নীলু বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি জানি না কীভাবে স্বামীর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করব।'

পিপিপি সেন্টারে ডায়ালাইসিস ফি ৩ গুণ বাড়ানো হয়েছে জেনে জহিরুলের মতো অনেক রোগী ও স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এর প্রতিবাদে গত রোববার থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা।

গতকাল মঙ্গলবার চমেক হাসপাতালের সামনের রাস্তায় রোগী ও স্বজনরা বিক্ষোভ করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জও করে। 

পাঁচলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদেকুর রহমান ডেইলি স্টারকে জানান, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মঙ্গলবার রাতে একজনকে আটক করে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ।

জানা গেছে, চমেক হাসপাতালের নেফ্রোলজি ওয়ার্ডে মাত্র ৪টি ডায়ালাইসিস মেশিন আছে এবং দিনে ৩ সেশনে সর্বোচ্চ ১২ জন রোগী ডায়ালাইসিস সেবা নিতে পারে। মোট ৩৬ জন রোগী নিয়মিত এই ৪টি মেশিন থেকে ডায়ালাইসিস সেবা নিতে পারে। তবে ডায়ালাইসিস রোগীর সংখ্যা এর ১০ গুণেরও বেশি। 

২০১৭ সালে চমেক হাসপাতালে একটি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপনে ভারতীয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর মেডিকেডস প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে একটি পিপিপি চুক্তি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। 

ভারতের হায়দ্রাবাদত্তিক প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর মেডিকেডস মূলত চিকিৎসা সরঞ্জাম ও সেবা সংক্রান্ত ব্যবসা করে।

চমেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, কোম্পানিটি ৩১টি ডায়ালাইসিস মেশিন স্থাপন করেছে। সেখানে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সুপারিশ করা দরিদ্র রোগীদের প্রতি সেশনে ৪৮৬ টাকা ব্যয়ে ডায়ালাইসিস সেবা দেওয়া হতো এবং সরকার প্রতি সেশনে রোগীদের জন্য ২ হাজার ১৮০ টাকা ভর্তুকি দিয়ে আসছিল।

চুক্তি অনুযায়ী কোম্পানিটি ১০ বছর পর কেন্দ্রটি সরকারের কাছে হস্তান্তর করবে। 

এদিকে কেন্দ্রটি রোগীদের অংশের ফি বাড়িয়ে ৫১০ টাকা করে এবং সরকারের ভর্তুকি ২৭৮৫ টাকা করা হয়।

রোগীরা সেই ফি নিয়ে অসন্তুষ্ট না হলেও, কোম্পানির কর্মকর্তারা চলতি মাস থেকে প্রথম ৪ সেশনের প্রতিটির জন্য ২ হাজার ৯৩৫ টাকা এবং বাকি ৪ সেশনের প্রতিটির জন্য ৫৩৫ টাকা দিতে হবে বলে জানায়। 

তবে এ বিষয়ে স্যান্ডর মেডিকেডসের কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি।

নাম প্রকাশ না করে তাদের এক কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, তারা কোনো ফি বাড়ায়নি বরং রোগীদের জন্য সরকারের ভর্তুকি সীমিত করা হয়েছে। 

যোগাযোগ করা হলে চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার ২০১৭ সালে পিপিপি ভিত্তিতে দুটি ডায়ালাইসিস সেন্টার স্থাপন করে। একটি ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে এবং অন্যটি চমেক হাসপাতালে। এ দুটি সেন্টার পরিচালনার জন্য স্যান্ডর মেডিকেডসের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার।'

চুক্তি অনুযায়ী, কোম্পানিটি প্রতি বছর দুটি কেন্দ্রে মোট ১৯ হাজার ডায়ালাইসিসের সেশন (ঢাকায় ১২ হাজার ৫০০ এবং চট্টগ্রামে ৬ হাজার ৫০০) পরিচালনা করবে। 

তিনি বলেন, 'করোনা মহামারির সময় লকডাউনে রোগীরা এক শহর থেকে অন্য শহরে যেতে পারছিলেন না এবং অনেক প্রাইভেট ক্লিনিক তখন ডায়ালাইসিস সেবা দিচ্ছিল না। তখন চমেক হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যায়। সেশন সংখ্যা ৪-৫ গুণ বৃদ্ধি করা হয়।'

'কোম্পানি দাবি করছে যে তারা ৬ হাজার ৫০০ সেশনের জায়গায় ৩৬ হাজার সেশন ডায়ালাইসিস সেবা দিয়েছে,' যোগ করেন তিনি।

হাসপাতাল পরিচালক বলেন, 'আমরা তাদের কাছে নথি চেয়েছিলাম এবং বলেছিলাম যে আমরা এত রোগীর জন্য ভর্তুকি দিতে পারব না।'

'তারা ঘোষণা করেছে যে সরকার রোগীদের জন্য ভর্তুকি দেবে না। তখন  রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে,' যোগ করেন তিনি।

এ অবস্থায় পিপিপি কেন্দ্রের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আজ বুধবার নেফ্রোলজি ওয়ার্ডে ৩টি নতুন ডায়ালাইসিস মেশিন স্থাপন করেছে। 

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম বলেন, 'মোট ২৬ জন নতুন রোগী এই মেশিনগুলো থেকে ডায়ালাইসিস সেবা পাচ্ছেন।'

'আমরা ১৫ দিনের মধ্যে আরও ১০টি মেশিন স্থাপন করব এবং এতে করে আমরা ৬০ জন নতুন রোগীকে ডায়ালাইসিস সেবা দিতে পারব,' যোগ করেন তিনি।

যোগাযোগ করা হলে চমেক হাসপাতালের নেফ্রোলজি ওয়ার্ডের প্রধান অধ্যাপক ডা. নুরুল হুদা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ডায়ালাইসিসের জন্য একজন রোগীকে ৬ মাসের জন্য ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। এর অর্থ হলো প্রতি সেশনের জন্য একজন রোগীকে ৪১৬ টাকা দিতে হয়।'

Comments

The Daily Star  | English
education in Bangladesh

As a nation, we are not focused on education

We have had so many reform commissions, but none on education, reflecting our own sense of priority.

15h ago