গম সংকটে রংপুর বিভাগে আটা-ময়দার উৎপাদন কমেছে ৮০ শতাংশ

রংপুরের একটি ময়দা মিলে অল্প পরিসরে উৎপাদন চলছে। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/ স্টার

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে গম আমদানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে স্থানীয় বাজারে দেশের দ্বিতীয় প্রধান এই খাদ্যশস্যের সরবরাহ কমে গেছে।

এ অবস্থায় দেশের উত্তরাঞ্চলের আটা-ময়দা মিলগুলো উৎপাদন চালু রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশে চাহিদার তুলনায় কম গম উৎপাদিত হওয়ায়, মিলগুলো মূলত আমদানিকৃত গমের ওপর নির্ভরশীল।

পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশিরভাগ মিল উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। আর কয়েকটি মিল ব্যাংক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পরিচালনা ব্যয় কমাতে সাময়িক উৎপাদন স্থগিত রেখেছে।

সক্ষমতার তুলনায় ৮০ শতাংশ উৎপাদন কমে গেছে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর বিসিক শিল্প নগরীর খলিল অটো ফ্লাওয়ার মিলের।

নীলফামারীর সৈয়দপুরে খলিল অটো ফ্লাওয়ার মিল সক্ষমতার মাত্র ২০ শতাংশ উৎপাদন করছে। ছবি: আসাদুজ্জামান টিপু/ স্টার

মিলটির সত্ত্বাধিকারী আমিনুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'স্বাভাবিক সময়ে সপ্তাহে ৭ দিন মিল চালু রেখে আমরা দৈনিক গড়ে ৪৫ টন আটা ও ময়দা উৎপাদন করতে পারতাম। কিন্তু বর্তমানে বাজারে গমের সংকটে আমরা সপ্তাহে ২ থেকে ৩ দিন মিল চালু রাখছি। সক্ষমতার মাত্র ২০ শতাংশ উৎপাদন করতে পারছি।'

তিনি জানান, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে উত্তরাঞ্চলের মিলগুলো যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছে। এজন্য তারা হয় উৎপাদন কমিয়ে ফেলেছে, নয়তো মিল বন্ধ করে দিয়ে স্বাভাবিক সময়ের অপেক্ষা করছেন।

নীলফামারী জেলায় মোট ১৭টি আটা-ময়দা মিল আছে। এর মধ্যে ১০টি বর্তমানে উৎপাদন স্থগিত রেখেছে।

বাকিগুলো উৎপাদনে থাকলেও, লোকসান কমাতে সেগুলো উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। শুধু নিজেদের বাজার টিকিয়ে রাখতেই তারা উৎপাদন চালু রেখেছেন বলে জানা গেছে।

আটা-ময়দা মিল মালিক সূত্র জানায়, রংপুর বিভাগের ৮ জেলা রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ে মোট প্রায় ১৫০টি ছোট-বড়, নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত গম ভাঙানোর মিল আছে।

মিলগুলোতে আটা ও ময়দা ছাড়াও সুজি এবং গো-খাদ্যের জন্য উপজাত হিসেবে গমের ভুষি উৎপাদিত হয়। দেশে গম উৎপাদন কম হওয়ায় সুজি এবং ভুষিও আমদানিকৃত গমের ওপর নির্ভরশীল।

রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার সোনালি ফ্লাওয়ার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এখন আমরা সরাসরি চট্টগ্রাম কিংবা মংলা বন্দরের আমদানিকারকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাশিয়া কিংবা ইউক্রেন থেকে আমদানিকৃত গম বেশি দামে কিনছি। বর্তমানে এত দূর থেকে উত্তরাঞ্চলে পরিবহন, লোড-আনলোড চার্জ, লেবার খরচ, সব মিলিয়ে প্রতি টন গমের ক্রয়মূল্য পরছে ৫৪ হাজার টাকা। অথচ স্বাভাবিক সময়ে তা ছিল ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে।'

তিনি বলেন, 'প্রতি টন ময়দা আমরা পাইকারিভাবে ৫৫ হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করছি। কেনা দামের সঙ্গে কর্মচারী বেতন, বিদ্যুৎ বিল, যন্ত্রাংশ ক্রয় পরিচালন ব্যয় যোগ করলে পুরোটাই লোকসান।'

মিল মালিকরা জানান, তারা সাধারণত ভারত থেকে আমদানি করা গমের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। কিন্তু নিজ দেশে উৎপাদন কম হচ্ছে উল্লেখ করে ভারত কয়েক মাস আগে গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। তাই তারা বিকল্প হিসেবে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকা থেকে আমদানি করা গমের দিকে ঝুঁকেছেন।

নীলফামারী সদর, রংপুরের তারাগঞ্জ এবং পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার বিভিন্ন খুচরা বাজার পরিদর্শন করে দেখা যায়, আটা-ময়দা বিক্রির পরিমাণ অনেক কমে গেছে।

নীলফামারী জেলা সদরের বড় বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র ডেইলি স্টারকে জানান, বর্তমানে প্রতি কেজি আটা ও ময়দা বিক্রি হচ্ছে যথাক্রমে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় ও ৭০ থেকে ৭৫ টাকায়।

তিনি বলেন, '১ কেজি মোটা চালের দাম ৫২ টাকা। দাম কম হওয়ায় স্বল্প আয়ের ক্রেতারা আটা-ময়দা কেনা প্রায় বাদ দিয়েছেন। তারা চাল কিনছেন।'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশে বার্ষিক গম উৎপাদন ১ লাখ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টন। এটা আমাদের চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল।

দেশের চাহিদা মেটাতে বিদেশ থেকে প্রতি বছর আমাদের ৬ থেকে ৭ লাখ টন গম আমদানি করতে হয়।

দিনাজপুর জেলা সদরের পাটোয়ারী ফ্লাওয়ার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহন পাটোয়ারী গমের চলমান সংকট সম্পর্কে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই সংকটের মধ্যেও কিছু মজুদদার ও আমদানিকারক বেশি মুনাফার আশায় বিপুল পরিমাণ গম গোপন স্থানে মজুদ করে রেখেছে। সরকার সেগুলো উদ্ধারের ব্যবস্থা করলে হয়তো আটা-ময়দার মিলগুলো আরও ২ মাস উৎপাদন চালাতে পারত।'

যোগাযোগ করা হলে রংপুর বিভাগের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. আশরাফুল আলম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারের হাতে যথেষ্ট খাদ্য মজুদ আছে। এতে আগামী কয়েকমাস অভ্যন্তরীণ খাদ্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব।'

তিনি বলেন, 'সরকার নিজস্ব চ্যানেলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গম কিনছে, যেন ভিজিএফ, কাবিখাসহ বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যায়।'

'বর্তমানে সরকার মাত্র ১৮ টাকা কেজি দরে খোলা বাজারে আটা বিক্রি করছে, যেন সাধারণ মানুষের কষ্ট একটু কমে,' বলেন তিনি।

তবে বেসরকারিভাবে গম আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'এ সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে।'

Comments

The Daily Star  | English
IMF loan conditions

IMF conditions: Govt pledges to track graft in tax admin

The government has pledged a series of sweeping reforms to meet International Monetary Fund conditions for the next instalment of its $5.5 billion loan, including a public survey to measure corruption in tax administration and a phased reduction of subsidies on electricity, fertiliser, remittances and exports.

7h ago