সবজির দামবৃদ্ধির দায় কার?

সবজির দামবৃদ্ধির দায় কার?
স্টার ফাইল ফটো

গতকাল বাজারে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন দিনমজুর আজিজুল হক। কারণ কয়েকদিনের ব্যবধানে পেঁপের দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।

রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বরে পরিবার নিয়ে বসবাসকারী আজিজুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় একমাত্র পেঁপেই আমার সাধ্যের মধ্যে ছিল। এভাবে চলতে থাকলে সামনে আমরা আর কোনো সবজিই কিনতে পারব না।'

মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও ঢাকার বাজারগুলোতে পেঁপের দাম কেজিপ্রতি ৩০-৫০ টাকা।

তবে মানিকগঞ্জের যে কৃষকরা পেঁপে চাষ করছেন, তারা দাম পাচ্ছেন অর্ধেক। সরবরাহ শৃঙ্খলের এমন অকার্যকারিতার ফলে এক বছরের বেশি সময় ধরে নিম্ন আয়ের এসব মানুষের জীবনে সংকট আরও বেড়েছে।

এমনই একজন চাষি মনির হোসেন মানিকগঞ্জে তার ১৮৫ শতক জমিতে গাজর, পেঁপে, ধনিয়া ও মুলা চাষ করেছেন।

মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চিদিং চরে এক দালালের কাছে গাজর ১৩ টাকা, পেঁপে ১৭ টাকা, ধনেপাতা ২৫ টাকা ও মুলা ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন তিনি।

শীতকালীন ফসল কাটার জন্য তিন লাখ টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে মনির মুনাফা করেছেন এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা।

'এই মুনাফা দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে আমাকে ঋণ নিতে হবে', বলেন মনির।

আব্দুর রাজ্জাকের কাছে নিজের উৎপাদিত ফসল বিক্রি করা মনির জানান, তিনি নিজে, তার স্ত্রী ও ছেলের পরিশ্রমের কথা বিবেচনা করলে এই এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা মুনাফা 'খুবই সামান্য'।

মনিরের সবজি ঢাকার কারওয়ান বাজারের পাইকারি বাজারে নিয়ে আসেন রাজ্জাক, যেখানে তিনি গাজর প্রতি কেজি গড়ে ১৮ টাকা, পেঁপে প্রতি কেজি ২২ টাকা, ধনেপাতা ৩০ টাকা ও মুলা ১৬ টাকা কেজি দরে পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন।

পাইকারি বিক্রেতারা খুচরা পর্যায়ের সবজি বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন, যাদের কাছ থেকে কেনে ভোক্তারা।

ঢাকার কাঁচাবাজারের খুচরা পর্যায়ের সবজি বিক্রেতাদের কাছে গড়ে গাজর ২২ টাকা, পেঁপে ২৪ টাকা, ধনিয়া ৪০ টাকা ও মুলা ১৭ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

ঢাকার কাঁচাবাজারগুলোতে, যেখানকার ৫০ শতাংশ সবজিই আসে মুন্সীগঞ্জ, হেমায়েতপুর, ঝাউচর, জধুরচর, বয়লাপুর ও আশুলিয়া থেকে, সেখানে প্রতি কেজি গাজর ৩০-৪০ টাকা, পেঁপে ৩০-৫০ টাকা, ধনেপাতা ৫০-৮০ টাকা ও মুলা ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, খামার থেকে কাঁচাবাজারে যাতায়াতের সময় প্রায় সব সবজির দাম দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেড়েছে।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সবজির এমন মূল্যবৃদ্ধির পেছনে মূলত সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থার দুর্বলতাই দায়ী।'

উন্নত সরবরাহ শৃঙ্খল, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং তথ্য প্রবাহের অভাবে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে নামমাত্র দামে বিক্রি করছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, 'মধ্যস্বত্বভোগীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে উৎপাদিত ফসল চড়া দামে বিক্রি করছে, যার জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শহুরে দরিদ্ররা।'

প্রায় দুই বছর ধরে চলমান উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী কম পুষ্টিকর, নিম্নমানের খাবার গ্রহণ করছে, যার ফলে শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট নানা ঝুঁকি সৃষ্টি করবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের মার্চ থেকে শহরে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের ওপরে এবং শহরাঞ্চলে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও নয় শতাংশের ওপরে রয়েছে।

অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, 'বাজারের অসঙ্গতি দূর করতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা এবং শক্তিশালী বাজার ব্যবস্থাপনা নীতিমালা প্রণয়নে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখছি না।'

একজন মধ্যস্বত্বভোগী তাজা পণ্যের দামে কতটা বেশি নিতে পারবে, সে বিষয়ে বিধানসহ একটি উন্নত সরবরাহ শৃঙ্খল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির আহ্বান জানান তিনি।

মানিকগঞ্জ থেকে আসা মধ্যস্বত্বভোগী রাজ্জাকের ভাষ্য, কৃষক মনিরের কাছ থেকে কেনা তাজা ফসলের প্রতি কেজিতে গড়ে পাঁচ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়ানোর অধিকার তার আছে।

'আমাকে শ্রমিক নিতে হয়েছিল, ট্রাক ভাড়া করতে হয়েছিল, কারওয়ান বাজারে ফসল বিক্রি করার জন্য আমাকে কমিশন দিতে হয়েছিল। সব মিলিয়ে প্রতি কেজিতে আমার গড় ব্যয় চার টাকা ৭০ পয়সা।

অনেক সময় হাইওয়েতেও চাঁদাবাজির শিকার হতে হয় মধ্যস্বত্বভোগীদের।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি সবজি বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, পচন ও ক্ষয়ক্ষতি রোধসহ বিভিন্ন খাতে খরচ বাড়ায় মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে কেনা সবজির ওপর ১৫ শতাংশ অর্থ যোগ করা ছাড়া তার কাছে কোনো বিকল্প নেই।

পাইকারদেরকে কাঁচাবাজার কর্তৃপক্ষকেও একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিতে হয়।

তিনি বলেন, 'আমাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য বেশিরভাগ সময় আমরা কাঁচাবাজার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে মূলধন নিই এবং তাদের পাঁচ শতাংশ হারে সুদ দিতে হয়। সবকিছু হিসাব করলে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম ১৫ শতাংশ বাড়তি দামে সবজি বিক্রি করা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।'

খুচরা পর্যায়ের সবজি বিক্রেতারাও বলছেন, তারা যে দাম নির্ধারণ করেন, এর চেয়ে কম নেওয়ার কোনো সুযোগ তাদের নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মিরপুরের শেওড়াপাড়ার এক সবজি বিক্রেতা বলেন, 'কৃষক যে দামে ফসল বিক্রি করে, তা নিয়ে আমরা চিন্তাও করি না।'

তিনি জানান, তারা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছ থেকে যে দামে কেনেন, তার ওপর নির্ভর করে তারা তাদের বিক্রির দাম নির্ধারণ করে থাকেন।

'আমি যদি মুনাফা না করি, তাহলে কীভাবে আমার ব্যবসা ও আমার পরিবার চালাব?', বলেন তিনি।

হতাশাগ্রস্ত আজিজুলের মনেও ঘুরছে একই ধরনের প্রশ্ন। বলেন, 'গত কয়েক বছরে আমার আয় বাড়েনি, কিন্তু দাম বেড়েছে সবকিছুর। আকাশছোঁয়া দামের এই সময়ে আমরা কীভাবে বাঁচব?'

Comments

The Daily Star  | English

Drug sales growth slows amid high inflation

Sales growth of drugs slowed down in fiscal year 2023-24 ending last June, which could be an effect of high inflationary pressure prevailing in the country over the last two years.

17h ago