ভাতের থালায় টান
টানা ২ বছর করোনা মহামারির সঙ্গে লড়াই করেছে মানুষ। সেই ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছিল আগেই। এখন লাগামহীন মূল্যস্ফীতির সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে শ্বাস পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
ঘরে ঘরে হানা দেওয়া এই বাজারদরের আগুনে নিম্নবিত্তের মানুষ থেকে মধ্যম আয়ের পরিবার—সবার হাত পুড়ছে। বিপরীতে পাকস্থলিতে বাঁধা জীবনটাকে চালিয়ে নিতেই কমে আসছে জীবনের আঁচ। এখন একজন নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে কেবল ৩ বেলা খাবার জোটানোই কঠিন হয়ে পড়েছে।
দেশে ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোটা চালের দাম ছিল গড়ে কেজি প্রতি ২৬ টাকার কম। বাড়তে বাড়তে ২০২০-২১ অর্থবছরে একই চালের দাম ৫২ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ, এ সময়ের মধ্যে চালের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। একইভাবে ভোজ্যতেল, চিনিসহ নিত্যপণ্য এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির দাম বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তথ্য-উপাত্ত বলছে, একই সময়ে শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে। তবে এই বাড়তি আয় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয়ে।
চাল, ডাল ও তেলের দামে অস্বস্তি আগে থেকেই ছিল। এ তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে পেঁয়াজ, আটা, ময়দা, মুরগি, ডিমসহ আরও কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। বেড়েছে রান্নার গ্যাস, জ্বালানি তেল, সাবান ও টুথপেস্টের মতো নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীর দামও।
এ অবস্থায় জীবনটাকে কোনোভাবে চালিয়ে নিতে আপাত 'অপ্রয়োজনীয়' খরচ কাটছাঁট করেও নিস্তার মিলছে না নিম্ন আয়ের মানুষের। টান পড়ছে ভাতের থালাতেও।
গত বুধবার দুপুরে রাজধানীর পান্থপথ সিগন্যাল এলাকায় কথা হচ্ছিল রিকশাচালক মো. রহমানের সঙ্গে। ফুটপাতের খাবারের দোকানে এক প্লেট ভাতের সঙ্গে কেবল পুঁইশাকের তরকারি দিয়ে খাচ্ছিলেন তিনি।
আর কিছু নেবেন কিনা জানতে চাইলে রহমান বলেন, 'জিনিসপত্রের যে দাম তাতে আর কিছু নেওয়ার কোনো সামর্থ্য নেই। প্রতিদিন এগুলোই খাই।'
শেষ কবে মাছ-মাংস খেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'টানা ৩ মাস ধরে মাছ-মাংস খাইনি। প্রতিদিন যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে কোনোভাবে এগুলো খেয়ে বেঁচে আছি। মাঝে মধ্যে যেদিন আয় একটু বেশি হয় সেদিন ডিম খাই। তবে সপ্তাহে ২-১ দিনের বেশি না।'
কথায় কথায় জানা যায়, রহমান ৩০ বছর ধরে রাজধানীতে রিকশা চালান। বাড়ি বগুড়ায়। থাকেন হাজারীবাগে। প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে আয় করেন ৬০০-৭০০ টাকার মতো। এরমধ্যে রিকশার জমা, থাকা ও ৩ বেলা খেতেই তার প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ হয়ে যায়। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানসহ ৫ জন থাকেন। তাই তিনি যে আয় করেন তাতে 'ভালো-মন্দ' খাওয়ার সুযোগ হচ্ছে না।
রহমানের ভাষ্য, এমন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকাটাই কঠিন হয়ে পড়ছে তার জন্য।
শুক্রবার সন্ধ্যায় বাংলামোটর এলাকা থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় যাওয়ার জন্য একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ডাকেন এই প্রতিবেদক। চালক ভাড়া চান ৩৫০ টাকা। ভাড়া এত বেশি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'জিনিসপত্রের যে দাম তাতে পোষায় না।'
পরে ৩০০ টাকা চুক্তিতে চালক আনোয়ার হোসেনের অটোরিকশায় চড়ে বসে যা জানা গেল, তা হলো- স্ত্রী ও ২ সন্তান নিয়ে কমলাপুরে এলাকায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে থাকেন আনোয়ার হোসেন। ছেলের বয়স ১৫ বছর। মেয়েটি ছোট। বয়স্ক মা থাকেন গ্রামের বাড়িতে। তার জন্যও প্রতি মাসে খরচ পাঠাতে হয় তার। মা থাকেন। সেখানেও খরচ বহন করতে হয় আনোয়ার হোসেনকে।
আনোয়ার হোসেন বলেন, 'খাবারসহ সব জিনিসের দাম বাড়তি। যা আয় করি তাতে শাক-সবজি দিয়ে কোনোভাবে ৩ বেলা খেতে পারি। আগে মাসে কমপক্ষে ২ বার গরুর মাংস খেতাম। গত ২ মাস ধরে গরুর মাংস কিনতে পারিনি। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ৩ বেলা খাওয়াই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।'
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। শুধু আমদানি পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নয়; দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত জিনিসপত্রের দামও বাড়ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি দাম মানুষের ওপর বোঝা হয়ে যাচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি মূল্যস্ফীতির চাপ সাধারণ মানুষের খরচ কত বাড়িয়ে দিয়েছে, তার একটি হিসাবও দেয়। বলা হয়, মাছ-মাংস না খেয়েও ঢাকা শহরের ৪ সদস্যের একটি পরিবারকে এখন খাবার কিনতে মাসে গড়ে ৯ হাজার ৫৯ টাকা খরচ করতে হয়। মাছ-মাংস খেলে ওই পরিবারের খাবারে খরচ হয় ২২ হাজার ৪২১ টাকা। এটি চলতি অক্টোবর মাসের হিসাব। গত পৌনে ৪ বছরে খাবার কেনায় ওইসব পরিবারের খাবার খরচ ২৭ থেকে ৩৮ শতাংশ বেড়েছে।
সিপিডির এই হিসাবের সঙ্গে চাকরিজীবী মো. সিদ্দিকের দেওয়া বক্তব্যের মিল পাওয়া যায়।
ডেমরায় বাবা-মা, বোন ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন মো. সিদ্দিক। তার মাসিক আয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'খুবই প্রয়োজন- এমন জিনিস ছাড়া খরচ করার উপায় নাই। রেস্টুরেন্ট, ট্যুর এগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। আব্বা-আম্মার ওষুধের জন্য একটা বড় খরচ হয় প্রতিমাসে। সেটাও গত ২ মাসে গড়ে ২০ শতাংশ বাড়ছে। আয় বাড়েনি। চলাটা খুব কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ভালোমন্দ তেমন কিছুই খেতে পারি না।'
গত শুক্রবার রাজধানীর সবচেয়ে বড় পাইকারি কাঁচাবাজার কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকা দরে। খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকায়।
গরুর মাংস বিক্রেতা রমজান আলী বললেন, '৩ মাস আগেও দৈনিক কমপক্ষে ১০০ কেজি মাংস বিক্রি করতাম। এখন ৫০ কেজিও বিক্রি করতে পারি না। মানুষ মাংস খুব কম কিনছেন। আমাদের আয়ও অনেক কমে গেছে।'
সস্তায় প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য নিম্ন আয়ের মানুষের এতদিনের ভরসা ছিল পোলট্রি মুরগি ও ডিম। শুক্রবার কারওয়ান বাজারে সেই পোল্ট্রি মুরগিও বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকায়। আর প্রতি ডজন মুরগির ডিমের দাম ছিল ১৪০ টাকা এবং হাঁসের ডিম ২০০ টাকা।
Comments