‘বাজারে গেলে হিসাব মেলে না’
মাসে দুই বার রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে সংসারের বাজার করেন সোবহানবাগের বাসিন্দা কাজী বেলাল হোসেন (৫০)। চলতি মাসের শুরুর দিকে বেতন পেয়েই একবার বাজার করেছেন। গতকাল শুক্রবার আবার কারওয়ান বাজারে এসেছিলেন পরের দুই সপ্তাহের জন্য।
তার সঙ্গে যখন দেখা হলো, তখন বাজারের তালিকার সঙ্গে টাকার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত তিনি।
জিজ্ঞেস করতেই উদ্বিগ্ন বেলাল বলেন, 'বাসা থেকে এত হিসাব করে আসলাম। কিন্তু কিছুই তো মিলছে না। বাজারের হিসাব আজকাল মেলাতেই পারি না।'
'বাসা থেকে বাজারের তালিকা নিয়ে আসি। কিন্তু কোনোদিনই সবকিছু নিয়ে যেতে পারি না। টাকায় কুলায় না। পরিমাণে কম কিনতে হয় কিংবা কিছু না কিছু বাদ দিতে হয়,' বলেন তিনি।
কাল তিনি আদা কিনতে পারেননি বলে জানান।
চাকরিজীবী বেলাল মাসে বেতন পান ৪০ হাজার টাকা। স্ত্রী ও দুই ছেলে-মেয়ে নিয়েও এই টাকায় তিনি মাস চালাতে পারছেন না বলে জানান।
তিনি বলেন, 'বাসা ভাড়া, ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচের পর হাতে যা থাকে, তা দিয়েই সারা মাস পার করতে হয়। এলাকার বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেশি, তাই কারওয়ান বাজারে আসি একটু কম দামে কেনার জন্য।'
'তাও গত প্রায় এক বছর হলো, বাজারে এলেই আর কোনো হিসাব মেলাতে পারি না,' যোগ করেন তিনি।
বাজারে দেখা হয় নর্দ্দা-কালাচাঁদপুর এলাকার বাসিন্দা এক দম্পতির সঙ্গে। মিল্লাত হোসেন স্ত্রী সালমা বেগম ও শ্যালক দিদারকে নিয়ে এসেছেন মাসের বাজার করতে।
সালমা বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের মতো নিম্নআয়ের লোকদের জন্য কারওয়ান বাজার থেকে বাজার করা সুবিধাজনক। কারণ এখানে পাইকারি দরে জিনিসপত্র তুলনামূলক একটু কম দামেই পাওয়া যায়।'
এ বাজারে এসে কতটা সাশ্রয় হলো, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এলাকা থেকে একটু কম দামে জিনিসপত্র পাব বলে এখানে এসেছি। কিন্তু আসলে দাম অত কম না। যা হিসাব করে এসেছিলাম, তার সবকিছু কিনতে পারিনি।'
তিনি জানান, রোজাকে সামনে রেখে ডাল, ছোলা, চিনিসহ ১৬ ধরনের পণ্য কিনলেও, আলু ও পেঁয়াজ কেনা হয়নি তাদের। তার আগেই টাকা শেষ। সব সবজিও কেনা হয়নি।
সালমা বলেন, 'আসলে এখন আর টাকার সঙ্গে বাজারের সামঞ্জস্য হয় না। আমাদের আয় কম হওয়ায়, জিনিসপত্রও কিনি কম করে। মাসে আমাদের ৫ কেজি পেঁয়াজ আর ১০ কেজি আলু লাগে। তাও আজ আলু-পেঁয়াজ কিনতে পারিনি।'
তার স্বামী মিল্লাত হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাজারে গেলে হিসাব মেলে না। বাসায় গিয়ে বোঝাতে পারি না। তাই এবার স্ত্রীকে বাজারে নিয়ে এসেছি।'
এক সপ্তাহের বাজার করতে আড়াই হাজার টাকা নিয়ে এসেছিলেন তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা আব্দুল ওহাব (৬৫)। মাছ-মাংস-সবজি কিনেছেন।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত এক-দেড় বছর ধরে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়েছে। কিন্তু আমাদের আয় তো বাড়েনি। পাঁচ বছর আগেও ১০০০-১২০০ টাকায় যে বাজার করতে পারতাম, এখন আড়াই হাজার টাকায়ও তা হয় না।'
শুক্রবার রাজধানীর কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, ইব্রাহীমপুর, কচুক্ষেত ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অনেক চাকরিজীবী এসেছেন মাসের কিংবা সপ্তাহের বাজার করতে।
এর মধ্যে অনেককেই দেখা গেছে বিভিন্ন দোকানে ঘুরছেন, কিন্তু কিনছেন না। দাম যাচাই করছেন, কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারছেন না।
এসব বাজারের পাইকারি ও খুচরা বেশ কয়েকজন দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শবে বরাত ও রোজাকে সামনে রেখে কেউ কেউ এখনই বাজার করে নিচ্ছেন।
তারা জানান, গত বছরের তুলনায় বিভিন্ন জিনিসপত্রের দাম দেড়গুণ থেকে দুইগুণ বেড়েছে।
তবে গত দুই সপ্তাহ আগে পর্যন্ত জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও, এখন বেশিরভাগ পণ্যের দাম স্থিতিশীল আছে।
টিসিবির আজকের মূল্য তালিকা অনুযায়ী, সাধারণ মানের খেজুরের কেজি ২৫০-৮৫০। গত বছর এই দাম ছিল ১৫০-৩৫০ টাকা।
চিনির কেজি ১৪০-১৪৫ টাকা। গত বছর এই সময়ে চিনির দাম ছিল ১১০-১২০ টাকা কেজি। আলুর দাম আজ ৩০-৪০ টাকা কেজি। গত বছর আলুর কেজি ছিল ২০-২৫। দেশি পেঁয়াজের কেজি ১১০-১৩০ টাকা, যা গত বছর ছিল ৩০-৩৫ টাকা কেজি।
রসুনের কেজি ২০০-২৬০ টাকা, গত বছর যা ছিল ১০০-১৪০ টাকা কেজি। আদার কেজি ২৫০-২৮০ টাকা, যা গত বছর ছিল ১৫০-১৮০ টাকা কেজি।
ছোলার কেজি এখন ৯৫-১১০ টাকা, গত বছর ছিল ৯০-৯৫ টাকা। এ ছাড়া, অন্যান্য মসলা জাতীয় পণ্যের দাম ২০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে গত এক বছরে।
Comments