রামগড়-সীতাকুণ্ড সংরক্ষিত বন

রাস্তা প্রশস্তে কাটা হচ্ছে পাহাড় ও সাড়ে ৪ হাজার গাছ

রামগড় সীতাকুণ্ড সংরক্ষিত বন
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর বন বিভাগের মৌখিক অনুমোদন নিয়ে বড়ইয়ারহাট থেকে বন সংলগ্ন রামগড় পর্যন্ত পাহাড় ও গাছ কেটে রাস্তা প্রশস্ত করার কাজ শুরু করেছে। ছবি: স্টার

রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য চট্টগ্রামের রামগড়-সীতাকুণ্ড সংরক্ষিত বনাঞ্চলের একটি অংশ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন বিভাগ।

বন বিভাগের মৌখিক অনুমোদন নিয়ে ইতোমধ্যেই বড়ইয়ারহাট থেকে বন সংলগ্ন রামগড় পর্যন্ত পাহাড় ও গাছ কেটে রাস্তার কাজ শুরু করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।

প্রকল্প নথি অনুযায়ী, ১৮ ফুট প্রশস্ত ৩৮ কিলোমিটার রাস্তাটি ৩৮ ফুট প্রশস্ত করা হবে। এই রাস্তায় থাকবে নয়টি সেতু ও ২৩টি কালভার্ট। প্রকল্পে সম্ভাব্য খরচ হবে এক হাজার ১০৭ কোটি টাকা।

প্রকল্প কর্মকর্তারা দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, খাগড়াছড়িতে সদ্য উদ্বোধন হওয়া রামগড় স্থলবন্দর দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতে পণ্য পরিবহন সহজ করতে এই রাস্তাটি প্রশস্ত করা হচ্ছে।

বন বিভাগের প্রাক্কলনে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পের জন্য প্রায় চার হাজার ৬৩০টি পরিপক্ব গাছ কাটাতে হবে, ১৮ হাজার ঘনমিটার মাটি কাটতে হবে ও ১৫ হাজার ৫০০ গাছের চারা অন্যত্র স্থানান্তর করতে হবে।

গত বছরের ২১ ডিসেম্বর প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমির হোসেন চৌধুরী চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে চিঠিতে বলেন, ২৬ কোটি ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ নিয়ে ৯০ একর জমি যেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরকে হস্তান্তর করা হয়।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এস. এম. কায়চার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা এই জমি হস্তান্তরের সুপারিশ করেছি। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এখনো ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ করেনি বলে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে এটি হস্তান্তর করিনি।'

পরিবেশবাদী সংস্থা ধারার সদস্য-সচিব শরীফ জামিল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধ করার জন্য কপ-২৬ এর প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে এসব বনভূমি (উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য) লিজ দিচ্ছে।'

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তাটি সমতল করার জন্য শ্রমিকরা ইতোমধ্যেই মাটি কাটছেন। বনায়ন প্রকল্পের অধীনে রোপণ করা বেশ কয়েকটি গাছ কেটে রাস্তার দুপাশে ফেলে রাখা হয়েছে এবং পাহাড়ও কাটা হয়েছে।

করেরহাট ফরেস্ট অফিসের রেঞ্জ অফিসার তরিকুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনা থাকায় আমরা নির্মাণ কাজে বাধা দিতে পারি না।'

বন বিভাগের তথ্য অনুসারে, রামগড়-সীতাকুণ্ড সংরক্ষিত বনে ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১২৩ প্রজাতির পাখি, আট প্রজাতির সরীসৃপ ও ২৫ প্রজাতির গাছ আছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক কামাল হোসেন এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই বন নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং এ নিয়ে পাঁচটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যে রাস্তা এখন আছে সেটাই তো বহু বছর আগে বনভূমিতে তৈরি করা হয়েছিল। এটা আরও প্রশস্ত করা হলে ভবিষ্যতে বনের অস্তিত্বই শেষ হয়ে যাবে। এই রাস্তাটি এরই মধ্যে কাঠ চোরাচালানের জন্য নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে। এই সংরক্ষিত বন ধ্বংস না করে বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরকে।'

'আমরা প্রাথমিকভাবে এই বনভূমি ব্যবহারের অনুমতির জন্য তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। পরবর্তীতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের অনুরোধ করেছিলেন যে রাস্তাটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য প্রশস্ত করা দরকার এবং আমরা যেন এই জমি ব্যবহারে তাদের অনুমতি দেই।'

তিনি আরও বলেন, 'চট্টগ্রামের বনগুলো এমনিতেই দখলের চাপে আছে। এর আগে মিরসরাইয়ে অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ ২২ হাজার ৫০০ একরেরও বেশি বন উজাড় করেছে।'

চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় ১৩ হাজার ১৩০ একর বনভূমি প্রভাবশালীদের দখলে আছে।

তার মধ্যে সংরক্ষিত বনভূমিতে নতুন এই রাস্তা প্রশস্তকরণ প্রকল্প জেলার বনভূমির জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর হবে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবাদীরা।

পরিবেশবাদী সংস্থা ধারার সদস্য-সচিব শরীফ জামিল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বন উজাড় বন্ধ করার জন্য কপ-২৬ এর প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে এসব বনভূমি (উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য) লিজ দিচ্ছে।'

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য ১৭৪ একর জমি চেয়েছি। বন বিভাগ দিয়েছে ৯০ একর জমি।'

তিনি আরও বলেন, 'প্রকল্পের জন্য এই বনভূমি ব্যবহার করা ছাড়া আমাদের বিকল্প নেই।'

চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক বিপুল কৃষ্ণ দাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা ৯০ একর জমি হস্তান্তর করতে রাজি হয়েছি এই শর্তে যে এটি শুধুমাত্র রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য তা ব্যবহার করা হবে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কখনই এই জমির মালিকানা পাবে না।'

তিনি আরও বলেন, 'আমরা প্রাথমিকভাবে এই বনভূমি ব্যবহারের অনুমতির জন্য তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। পরবর্তীতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের অনুরোধ করেছিলেন যে রাস্তাটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য প্রশস্ত করা দরকার এবং আমরা যেন এই জমি ব্যবহারে তাদের অনুমতি দেই।'

Comments