গ্যাস সংকটে অকার্যকর ১৬৩১ কোটি টাকা ব্যয়ের কম্প্রেসার স্টেশন

ছবি: স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

বিভিন্ন জেলায় পর্যাপ্ত চাপে গ্যাস সরবরাহের উদ্দেশে সরকার ২০১৬ সালে দুটি কম্প্রেসার স্টেশন নির্মাণ করলেও গ্যাস সংকটে ব্যয়বহুল এসব যন্ত্রপাতি অব্যবহৃতই থাকছে।

অপর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের কারণে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গার কম্প্রেসার স্টেশনটি গত ৮ বছরে কখনোই ব্যবহৃত হয়নি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে স্থাপিত অন্য কম্প্রেসার স্টেশনটি ২০২৩ সালে মাত্র ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ সময় ধরে ব্যবহার করা হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) ১ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা ব্যয়ে এসব স্থাপনা নির্মাণ করেছে। ব্যয়ের বেশিরভাগই ঋণ হিসেবে নেওয়া হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে।

দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড এসব স্টেশন নির্মাণ করেছে। পেট্রোবাংলার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, এসব যন্ত্রের আয়ুষ্কাল ২৫ বছর। এরইমধ্যে যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ সময় পার হয়ে গেছে।

পেট্রোবাংলার কারিগরি কমিটির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত যন্ত্রপাতি পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও সার্ভিসিংয়ের জন্য পাঁচটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে আরও ৩০৯ কোটি টাকা দিতে হয়েছে।

আশুগঞ্জের কম্প্রেসার স্টেশনের মাধ্যমে স্বল্প চাপে পাওয়া গ্যাস রাজধানী এবং আশপাশের এলাকায় উচ্চ চাপে সরবরাহ করার কথা। ঢাকা, গাজীপুরে ব্যবহৃত গ্যাসের উদ্বৃত্ত অংশ এলেঙ্গা স্টেশনের মাধ্যমে যমুনা নদীর ওপারে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে সরবরাহ করার কথা।

আমদানি করা এলএনজি ও বিশেষত সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে পাওয়া গ্যাস ৬৫০ পিএসআই (পাউন্ড পার স্কয়ার ইঞ্চি) চাপে পেলে কমপ্রেসার স্টেশনগুলো এক হাজার পিএসআই পর্যন্ত চাপে তা সরবরাহ করতে সক্ষম।

কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্টেশনগুলো সর্বনিম্ন যে ৬৫০ পিএসআই চাপে গ্যাস পাওয়ার কথা, সেটাই পাচ্ছে না।

২০১৬ সালের ১৬ মে থেকে আশুগঞ্জ স্টেশনটি চালু হয়। এরপর থেকে ২০২২ সালের শেষ পর্যন্ত সময়ে স্টেশনটি ২০১৯ সালেই সর্বাধিক ৯৪ শতাংশ সময় চলেছে। এরপর থেকে এই স্টেশনটি ব্যবহারের হার কমেই চলেছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে জিটিসিএলে জমা দেওয়া প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ঢাকা ও গাজীপুরের গ্রাহকদের বিপুল ব্যবহার শেষে যে পরিমাণ গ্যাস অবশিষ্ট থাকে, তা এলেঙ্গা স্টেশন পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত না।

এতে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালে এলেঙ্গায় গ্যাসের গড় চাপ ছিল গড়ে ৩৬৭ পিএসআই। এমনকি ২০১৬ সালে যখন স্টেশনটিতে পরীক্ষামূলকভাবে গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তখনই প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ চাপ ছিল।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, দৈনিক প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফডি) চাহিদার বিপরীতে জাতীয় গ্রিডে বর্তমানে ২৭০০ এমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ করা হয়।

বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের মধ্যে গ্যাসের আমদানি কমে যাওয়ার পাশাপাশি দেশিয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়ায় এই বিপুল পরিমাণ ঘাটতি হয়েছে।

যেহেতু কম্প্রেসার স্টেশনগুলো আর্থিকভাবে পেট্রোবাংলা ও জিটিসিএলের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে, তাই কারিগরি কমিটি সুপারিশ করেছে যেন এলেঙ্গা স্টেশনের কম্প্রেসার যন্ত্র আপাতত বন্ধ রেখে কেবল গ্যাস মিটারিং এবং সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যবহার করা হয়।

এমনকি ২০২৬ সালের পর ভারত থেকে এলএনজি আমদানি সাপেক্ষে এলেঙ্গা স্টেশনটিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যেকোনো উপযুক্ত স্থানে স্থানান্তরের সুপারিশও করেছে কমিটি।

গত বছরের অক্টোবরে গঠিত এই কমিটি যাচাই করে দেখেছে, যন্ত্রগুলোর ডিজাইন পরিবর্তন করে সর্বনিম্ন চাপের পরিমাণ কমিয়ে আনা যায় কি না। কিন্তু তারা বলেছে, এতে তেমন কোনো কাজ হবে না। বরং ডিজাইন পরিবর্তন করতে আরও ৭২ লাখ ইউরো খরচ হতে পারে।

এর পরিবর্তে কমিটি সুপারিশ করেছে যেন বিদেশি সংস্থার পরিবর্তে স্থানীয় প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্টেশনগুলোতে নিয়োগ করা। এতে স্টেশনগুলোর পরিচালন ও অন্যান্য ব্যয় কম হবে।

প্রকল্প নথি অনুসারে, স্কটল্যান্ডের ইএসডি সিমুলেশন ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে জিটিসিএলের ২৫ জন প্রকৌশলীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা।

যদিও কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ দ্য ডেইলি স্টারের কাছে দাবি করেন, ২৫ জন কর্মকর্তার সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আর যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তারা দুর্গম অঞ্চলে অবস্থানের কারণে স্টেশনগুলোতে কাজ করতে আগ্রহী হননি।

তিনি বলেন, 'কেউ কেউ চাকরিও বদলে অন্য কোথাও চলে গেছেন। কারণ, গ্যাসখাতের প্রকৌশলীদের চেয়ে বিদ্যুৎখাতের প্রকৌশলীদের বেতন অনেক বেশি।'

'কম্প্রেসার স্টেশনগুলোর কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়ার। পর্যাপ্ত গ্যাস পেলে স্টেশনগুলো যেভাবে চলার কথা সেভাবেই চলবে', যোগ করেন তিনি।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, 'আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে স্টেশনগুলোর পরিচালন ব্যয় কমানো। তবে এ স্টেশনগুলোর বিষয়ে কী করা হবে, সে বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।'

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলমের মতে, জনগণের অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়।

'তারা গ্যাসের প্রাপ্যতা নিশ্চিত না করেই একের পর এক প্রকল্প নিচ্ছে। এগুলো অনেকটা সেইসব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মতো, যেগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জ পায়', বলেন শামসুল আলম।

এ ধরনের অযৌক্তিক বিনিয়োগের কারণে গত কয়েক বছরে গ্যাস ট্রান্সমিশন ফি তিনগুণ বেড়েছে, যা গ্যাস বিলের সাথে সাধারণ মানুষকে বহন করতে হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শামসুল আলম বলেন, 'এগুলো আমরা কার কাছে বলবো? মহান আল্লাহর কাছে বিচার চাওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই।'

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'এসব স্থাপনা নির্মাণ জনগণের অর্থের অমার্জনীয় অপচয়।'

প্রকল্পে বিনিয়োগের সিংহভাগ উৎস হিসেবে এখানে এডিবি ছিল। তারা বাংলাদেশের জন্য 'ভ্যালু ফর মানি' নয়, বরং অর্থ ঋণ ব্যবসা করতেই বেশি আগ্রহী ছিল কি না সে প্রশ্ন উঠতে পারে, বলছিলেন তিনি।

তিনি বলেন, 'আরও হতাশার বিষয় হলো, সরকার এদের ঋণের ফাঁদে পা দিচ্ছে, যার কারণ সম্ভবত এডিবির কর্মকর্তাদের সঙ্গে ক্ষমতাধরদের একটি অংশের আঁতাত ছিল। এখন এই সাদা হাতির বোঝার দায় থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে না।'

Comments

The Daily Star  | English

BNP not in favour of banning any political party: Fakhrul

'Who are we to ban a political party? The people will decide,' says the BNP leader

38m ago