এলএনজি টার্মিনালে কারিগরি ত্রুটিতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ, শনিবারের মধ্যে সমাধানের আশ্বাস

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়, সিএনজি-রিফুয়েলিং পাম্পগুলোর সামনে আজ শুক্রবার সিএনজিচালিত অটোরিকশার দীর্ঘসারি দেখা গেছে। ছবি: স্টার

মহেশখালীর ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এতে গৃহস্থালি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানায় তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলা সূত্র জানায়, প্রায় আড়াই মাসের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ শেষ করে মহেশখালীতে একটি এলএনজি টার্মিনাল চালু করার মুহূর্তে এতে  কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ে। এতে চালু করা যায়নি গ্যাস সরবরাহ। 

অন্যদিকে, যে টার্মিনালটি থেকে এতদিন গ্যাস সরবরাহ হচ্ছিল, রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য সেটি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। ফলে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে সারাদেশে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

তবে, আগামীকাল শনিবার দুপুরের মধ্যে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন রূপান্তরিত প্রকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) কর্তৃপক্ষ।

 

বর্তমানে মহেশখালীতে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল চালু আছে। এগুলোর প্রতিটির ক্ষমতা ৫০০ এমএমসিএফ/ডি। একটি পরিচালনা করে সামিট গ্রুপ। অপরটি পরিচালনা করে মার্কিন কোম্পানি এক্সেলারেট এনার্জি।     

এক্সেলারেট এনার্জি পরিচালিত টার্মিনালটিতে গত ১ নভেম্বর থেকে আড়াই মাস রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলে। তখন থেকে সামিট পরিচালিত টার্মিনালটি থেকে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত ছিল। কিন্তু, গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় প্রায় তিন মাস ধরে দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন চট্টগ্রাম নগরবাসী। 

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে এই দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। 

বার্নারে গ্যাস না থাকায় বন্দরনগরীর আসকার দীঘির পাড় এলাকার বাসিন্দা মুমু ঘোষ কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। তিন বছরের শিশুর জন্য খাবার তৈরি করতে পারেননি তিনি। মধ্যরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলেও গ্যাস সরবরাহ আর চালু হয়নি। 

বাচ্চা কাঁদতে থাকায় ওই রাতেই মুমুর স্বামী খাবার কিনতে বাইরে গেলেন। কিন্তু ততক্ষণে আশেপাশের সমস্ত রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে।

পরে, শহরের জামাল খান এলাকার বাসিন্দা শিশুটির নানী ইনডাকশন কুকারে খাবার রান্না করে নাতির জন্য পাঠান।

মুমু দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভেবেছিলাম মাঝরাতে গ্যাস আসবে, অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু এটা জানতাম না যে সারারাত আর গ্যাস আসবে না।'

এমনকি আজ শুক্রবার রাত আটটা পর্যন্তও গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি।

মুমু ঘোষ আরও বলেন, 'অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় আমরা ভোগান্তিতে আছি। কিন্তু গতকাল ও আজকের মতো এত খারাপ অবস্থা ছিল না।'

'বৃহস্পতিবার রাতে রান্না করতে পারিনি, শুক্রবার সকালে, দুপুরে রান্না করেতে পারিনি,' বলেন তিনি।  

বৃহস্পতিবার রাত থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় মুমুর মতো বন্দরনগরীর প্রায় সব এলাকার বাসিন্দারা দুর্ভোগে পড়েছেন।

শহরের অলংকার এলাকার বাসিন্দা আলী আব্বাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'অক্টোবরের শেষদিক থেকে গ্যাস সরবরাহ বিঘ্ন হচ্ছিল। কিন্তু, বৃহস্পতিবার সকালে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং বিকেল ৪টার দিকে আবার আসে। কিন্তু রাত ৯টার দিকে আবার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত আসেনি।'

তিনি বলেন, 'আমরা গ্যাসের দাম দেই, কিন্তু ভোক্তা হিসেবে কোনো সুবিধা পাই না।'

চুলায় গ্যাস সরবরাহ না থাকায় নগরীর রেস্তোরাঁগুলোর সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। কিন্তু, রেস্তোরাঁগুলো চাহিদা অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করতে না পারেনি। এতে অনেককেই খালি হাতে ঘরে ফিরতে হয়েছে।  

মোমিন রোড এলাকার বাসিন্দা দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, 'আমি আন্দরকিল্লা এলাকায় তিনটি রেস্তোরাঁয় গিয়েছি কিন্তু খাবার পাইনি এবং এখন খাবার কিনতে চকবাজারে যাচ্ছি।'

গ্যাস সরবরাহ না থাকায় শুধু গৃহস্থালি নয়, ব্যবসা ও শিল্পকারখানাও সমস্যায় পড়েছে। সিএনজি-রিফুয়েলিং স্টেশনগুলো অচল হয়ে পড়েছে এবং গতরাত থেকে পাম্পগুলোর সামনে সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। 

কদমতলী এলাকার একটি সিএনজি-রিফুয়েলিং স্টেশনের সামনে দীর্ঘ সারি দেখা যায়। সেখানে দেখা হয় অটোরিকশা চালক মো. ফোরকানের সঙ্গে। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি আট ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু গাড়িতে গ্যাস ভরতে পারিনি। গতকাল মধ্যরাত থেকে পাম্পে গ্যাস নেই।'   

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) কর্মকর্তারা জানান, কক্সবাজারের মহেশখালী এলাকায় একটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল চালুর সময় কারিগরি ত্রুটির কারণে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। 

তারা জানান, টার্মিনালটি আড়াই মাস পর রক্ষণাবেক্ষণ কাজ শেষে চালুর অপেক্ষায় ছিল। 

কেজিডিসিএলের জেনারেল ম্যানেজার (ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস) শফিউল আজম খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এক্সেলারেট এনার্জি পরিচালিত এলএনজি টার্মিনালটি আড়াই মাস ধরে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ ছিল। রক্ষণাবেক্ষণ শেষে টার্মিনালটি চালু করার সময় বৃহস্পতিবার রাতে সেখানে কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ে। ত্রুটি সমাধানে কাজ চলছে।'

সংকট মোকাবিলায় অন্য টার্মিনালটি কেন চালু করা হচ্ছে না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'রক্ষণাবেক্ষণের প্রস্তুতির জন্য অন্য টার্মিনালটি ইতোমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।'

যোগাযোগ করা হলে আরপিজিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারিগরি ত্রুটি সারাতে কাজ চলছে। আশা করছি শনিবারের মধ্যে গ্যাস সরবরাহ আবার শুরু হবে।' 

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সানাউল রাব্বির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রযুক্তিগত ত্রুটি যেকোনো যান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো সময় ঘটতে পারে। তবে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিকল্প চিন্তা থাকা উচিত।'

'গ্যাস সরবরাহের বিকল্প উৎস রাখা হলে, এ সংকট সৃষ্টি হতো না,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

11h ago