গ্যাসের সংকট তীব্র: জ্বলছে না বাসাবাড়ির চুলা, উৎপাদন ব্যাহত কারখানায়

গ্যাসের সংকট তীব্র: জ্বলছে না বাসাবাড়ির চুলা, উৎপাদন ব্যাহত কারখানায়
প্রতীকী ছবি | সংগৃহীত

২০২০ সালের এপ্রিলের পর এবারই দেশে গ্যাসের সরবরাহ সর্বনিম্ন। সারা দেশের শিল্পকারখানা ও বাসাবাড়িতে গ্যাসের যে তীব্র সংকট চলছে, তা বোঝানোর জন্য পেট্রোবাংলার একটি তথ্যই যথেষ্ট। সেটি হলো—প্রায় তিন হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে চলতি মাসে গড়ে সারা দেশে দুই হাজার ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে।

এই সরবরাহ ২০২১ সালের শেষ ছয় মাসের গড় সরবরাহ থেকেও কম, যখন ডলারের অভাবে স্পট মার্কেট থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বন্ধ ছিল। এলএনজির দামও তখন ছিল আকাশছোঁয়া।

গত অক্টোবর থেকে শীত শুরু হওয়ায় সারা দেশে বিদ্যুতের চাহিদা কমেছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎখাতে কমেছে গ্যাসের চাহিদাও। তবে তার মানে এই নয় যে, বিদ্যুৎখাতের বেঁচে যাওয়া গ্যাস অন্য খাতগুলো বেশি পাচ্ছে।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা বলছেন, এই গ্যাস সংকটের পেছনে দেশীয় উৎপাদন কমে যাওয়া একটা কারণ। পাশাপাশি এলএনজি আমদানির পরিমাণও কমেছে। খুব নিকট ভবিষ্যতে এই সংকট থেকে উত্তরণের পথও দেখতে পাচ্ছেন না তারা।

তারা বলছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে গ্যাস সরবরাহের উন্নতি হবে। তবে তখন গ্যাসের চাহিদা আরও বাড়বে। ফলে ধৈর্য ধরা ছাড়া কোনো সমাধান দেখাতে পারছেন না তারা।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নারায়ণগঞ্জের একটি রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের কারখানা টোটাল ফ্যাশনের কথা। গ্যাস সংকটে তাদের উৎপাদন কমেছে তিন ভাগের এক ভাগে।

কারখানার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, তারা শুধুমাত্র শুক্রবারে গ্যাসের চাপ পান। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় তা কোনো কাজে লাগে না। সপ্তাহের অন্যান্য দিনে তাদের বয়লার চালু রাখার মতো পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া যায় না।

দেশের অন্যতম স্টিল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম বলছে, গ্যাস সংকটে তাদের জ্বালানি চাহিদার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ডিজেল ব্যবহার করতে হয়, যাতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়।

প্রতিষ্ঠানটির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত ডেইলি স্টারকে বলেন, তাদের প্রতি টন রড উৎপাদন করতে খরচ বেড়েছে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত।

'আমরা এখন পর্যন্ত রডের দাম বাড়াইনি। তবে যেভাবে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে হয়তো দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে', বলেন তিনি।

সিরামিক শিল্পের অন্যতম প্রধান উপকরণই গ্যাস। ফলে চলমান সংকটে এই ইন্ডাস্ট্রির ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

ফার সিরামিকস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরফান উদ্দিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের কারখানায় গ্যাসের চাপ কমপক্ষে ১০ পিএসআই (চাপের একক) থাকতে হয়। কিন্তু দিনের বেলা বেশিরভাগ সময়ই চাপ থাকে দুই থেকে চার পিএসআই। ফলে আমাদের পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে।'

এই কারখানাটি গাজীপুরের ভবানিপুর এলাকায় অবস্থিত। ইরফান বলেন, 'আমাদের শিল্পটি একটু ব্যতিক্রম। ধরুন, এখানে একটি ব্যাচের পণ্য উৎপাদন শুরু হয়েছে। হঠাৎ গ্যাসের চাপ কমে গেলে ওই পুরো ব্যাচের পণ্যগুলো নষ্ট হবে। এতে করে নতুন কাঁচামালের পাশাপাশি এই লসটিও আমাদের হিসাব করতে হয়।'

রান্নার জন্য গ্যাসের হাহাকার পুরো ঢাকাজুড়ে।

পুরান ঢাকার হোসনে দালান এলাকার জাহাঙ্গীর হোসেন বাবু জানান, চলমান গ্যাস সংকটে ভোররাত ৩টা পর্যন্ত তাকে রান্না করতে হয়।

'আমরা প্রতি মাসে বিল দিচ্ছি, কিন্তু আমরা পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছি না। যদিও আমাদের এলাকায় বেশিরভাগ জায়গায় গ্যাসের সংযোগ আছে, তবে বাসিন্দারা এলপিজি ব্যবহার করছে। কিন্তু এলপিজির ব্যয় বহন করা আমার জন্য সম্ভব না। তাই আমাকে ভোররাত তিনটা থেকে সাড়ে তিনটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, যখন গ্যাসের কিছুটা চাপ থাকে', বলেন তিনি।

উত্তরাখানের মাদারবাড়ি এলাকার দোতলা ভবনে ভাড়াটিয়াদের নিয়ে থাকেন মোহাম্মদ হাসান। তাদের বাসায় সারাদিন গ্যাস না থাকায় বাধ্য হয়ে তারা ছাদে মাটির চুলায় জ্বালানি কাঠ দিয়ে রান্না করছেন।

ভাসানটেক বিআরপি এলাকার প্রায় দুই হাজার ৫০ পরিবারের কেউ জ্বালানি কাঠ, আবার যাদের আয় ভালো, তারা এলপিজি ব্যবহার শুরু করেছে। কারণ তাদের এলাকায় গ্যাস থাকে রাত দেড়টা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত সময়ে।

ওই এলাকায় সাড়ে সাত হাজার টাকা মাসিক ভাড়ায় দুই বেড রুমে একটি ফ্ল্যাটে থাকেন হাসনা বানু। তিনি বলেন, 'রান্না করার জন্য আমাদের মধ্যরাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হয়। অথচ আমরা দিনের সব সময় ব্যবহারের জন্যই গ্যাসরে বিল পরিশোধ করছি।'

আজিমপুরের বেসরকারি চাকরিজীবী সোহেল রানা প্রতিদিন দুপুরের খাবার খেতে বাসায় আসতেন। এখন তাকে বাইরে খেতে হচ্ছে। কারণ গ্যাসের অভাবে তার স্ত্রী দিনের বেলা রান্না করতে পারছেন না।

বিরক্ত নিয়ে রানা বলেন, 'এভাবে বেশিদিন বাইরে খাওয়ার মতো সামর্থ্য আমার নেই।'

রাজধানীর কামরাঙ্গীচর, ডেমরা, পূর্ব দোগাইর, হাজীনগর, কোলাটিয়া, পূর্ব শেওড়াপাড়া, মিরপুর, শ্যামলী, পল্লবী, বনশ্রী, গেন্ডারিয়া, নবাবগঞ্জ, নারিন্দা, মোহাম্মদপুর ও ভাসানটেকসহ পুরান ঢাকার সর্বাধিক এলাকা ঘুরে গ্যাসের সংকট দেখা গেছে।

এই দুর্ভোগ শিগগিরই কমার সম্ভাবনা নেই বলে পেট্রোবাংলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এলএনজি আমদানি করে দুটি ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে তা আবার গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে একটি টার্মিনাল গত ১ নভেম্বর থেকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ আছে।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান বলেন, 'শিগগিরই এটি চালু হবে। এটি চালু হলে গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা বাড়বে।'

দুটো টার্মিনাল মিলে গ্যাস সরবরাহ করে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর যেটি চলছে, সেটি বর্তমানে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো সরবরাহ করছে।

পেট্রোবাংলার আরেক শীর্ষ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরবরাহ প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো বাড়বে, যা চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত হবে না।

সবচেয়ে বেশি উৎপাদনকারী বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রসহ স্থানীয় ক্ষেত্রগুলোতেও গ্যাসের উৎপাদনও কমছে।

স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার।

তিনি বলেন, 'তবে আমরা উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কাজ করছি। আমাদের ২০২৬ সালের মধ্যে প্রায় ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে আমরা ইতোমধ্যে প্রায় ৭০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন করছি।'

তাৎক্ষণিক গ্যাস সংকট মোকাবিলায় এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলেও উল্লেখ করেন জনেন্দ্র নাথ সরকার।

বর্তমানে ডলার মজুতের যে অবস্থা, এমন পরিস্থিতিতে সরকারের আমদানি বাড়ানোর সম্ভাবনাও কম।

গত ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, তিন মাসের বেশি আমদানি বিল মেটানোর জন্য যথেষ্ট এই রিজার্ভ যথেষ্ট।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট ২০২৪ এ গবেষণায় অংশ নেওয়া ৭০টি বাংলাদেশি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতিকে অর্থনীতি ও তাদের ব্যবসার জন্য এক নম্বর হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছে।

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানী লিমিটেডের কর্মকর্তাদের মতে, ২০২৪ সালে সরকার স্পট মার্কেট থেকে ২৪টি এলএনজি কার্গো আমদানি করার পরিকল্পনা করেছে। 

গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে স্পট মার্কেট থেকে মোট ২৩টি কার্গো কেনা হয়েছে।

বাংলাদেশ ওমানের সঙ্গে ১০ বছরের আমদানি চুক্তি এবং কাতারের সঙ্গে ১৫ বছরের আমদানি চুক্তির মাধ্যমে এলএনজি আমদানি করে। গত বছর দুটি দেশ থেকে মোট ৫৬টি এলএনজি কার্গো এসেছিল, যা ২০২২ সালের মতোই। ২০২১ সালে ৬৪টি এলএনজি কার্গো এসেছিল।

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka cannot engage with non-state actors: foreign adviser

Md Touhid Hossain also emphasised that peace and stability in the region would remain elusive without a resolution to the Rohingya crisis

36m ago