সিলেটে ঘন ঘন বন্যা: কী বলছে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত-বাংলাদেশের যৌথ গবেষণা
সিলেটে ঘন ঘন আকস্মিক বন্যার কারণ হিসেবে কেউ দায়ী করছেন ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ককে, কেউ দায়ী করছেন এ অঞ্চলের নদ-নদীর নাব্যতা সংকটকে, আবার কেউ দায়ী করছেন ভারতের অতিবৃষ্টির পানিকে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টার, নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটি, ভারতের ইন্সটিটিউট অব ট্রপিক্যাল মিটিওরোলজি এবং বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের গবেষণায় উঠে এসেছে এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ এক তথ্য।
গত ডিসেম্বরে রয়্যাল মেটিওরোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত এ গবেষণায় বলা হয়, গত চার দশকে ভারতের মেঘালয়-আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে থাকলেও একদিনে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের ঘটনা চার গুণ বেড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টাচ্ছে, যা সিলেট অঞ্চলে ঘন ঘন আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি করছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। একদিনে অতি ভারী বৃষ্টিপাত বলতে গবেষণায় ১৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাতকে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকও একদিনে অতিবৃষ্টির ঘটনা বৃদ্ধিকে সাম্প্রতিক বন্যা ও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
২০২২ সালের ১৭ জুন সিলেট অঞ্চলে যে প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয় সেদিন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে একদিনে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল।
প্রবল এ বৃষ্টিপাতের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই প্রবল পানির তোড়ে তলিয়ে যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ভয়াবহ বন্যাকবলিত হয় সিলেটের ৮৪ ভাগ এবং সুনামগঞ্জের ৯৪ ভাগ এলাকা।
গত ২৯ মে চেরাপুঞ্জিতে একদিনে ৬৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। সেই রাতেই সিলেট জেলার পাঁচটি উপজেলা প্লাবিত হয় আকস্মিক বন্যার পানিতে।
এই বন্যার প্রভাব থাকতেই গত ১৩ জুন আবারও একদিনে ৩৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয় চেরাপুঞ্জিতে। তার ফলে পরদিনই বন্যা পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে দেখা দেয় সিলেটে।
তবে কেবল মেঘালয়ে নয়, গত ৯ জুন সিলেট শহরে তিন ঘণ্টায় ২২০ মিলিমিটার বৃষ্টির ফলে নগরীতে দেখা দেয় তীব্র জলাবদ্ধতা। পরে ১৩ জুন এর পুনরাবৃত্তি ঘটে। ৬ ঘন্টার ব্যবধানে ২২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে আবারও জলাবদ্ধ হয় নগরীর বেশিরভাগ নিম্নাঞ্চল।
সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই গত ঈদের আগের রাত থেকে সিলেট ও মেঘালয়জুড়ে শুরু হয় প্রবল বৃষ্টিপাত। মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৩৯৫ মিলিমিটার, সিলেটের লালাখালে ৩৩৩ মিলিমিটার, জাফলংয়ে ৩২৭ মিলিমিটার, জকিগঞ্জে ১৯১ মিলিমিটার এবং সুনামগঞ্জের লাউড়েরগড়ে ১৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়।
একদিনে আবারও অত্যধিক বৃষ্টিপাতের ফলে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারে প্রবল বন্যা দেখা দিয়েছে, যাতে এখন পর্যন্ত অন্তত ২১ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন, বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, 'এই অঞ্চলে একদিনে ভারী বৃষ্টিপাত, বিশেষ করে আমাদের উজানে ভারতের মেঘালয়ে একদিনে ভারী বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটলেই বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীব্যবস্থার এত স্বল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ পানি পরিবহন করতে পারে না।'
আবহাওয়া অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজীবও এর সঙ্গে একমত পোষণ করেন।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের সিলেট নগরীতে সুরমা নদী উপত্যকায় বন্যার ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত একটি ম্যাপিংয়ে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সুরমা নদী নগরী এলাকায় প্রতি সেকেন্ডে ৩২১.৩৫ কিউবিক মিটার পানি পরিবহন করতে পারে যা অতিবৃষ্টির পানি পরিবহনের জন্য যথেষ্ট নাব্য নয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, 'উজান থেকে নেমে আসা অতিবৃষ্টির পানি ধরে রাখতে ও পরিবহনে হাওর ও নদী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু ক্রমাগত অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প সংযুক্ত হাওরগুলোকে বিচ্ছিন্ন পকেট হাওর করে ফেলছে, ফলে বন্যা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'শুধু নদী-হাওর নয়, নগরী ও শহর এলাকায় খাল দখল ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফলে অতিবৃষ্টিতে চরম জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়াও পাহাড়-টিলা কাটা ও অবাধে বৃক্ষনিধনের ফলে ভূমিক্ষয় দেখা দিচ্ছে, যা নদী-হাওরসহ সব ধরনের জলাভূমির তলদেশ ভরাট করে বন্যা পরিস্থিতি দুর্বিষহ করে তুলছে।'
বন্যা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ এ অধ্যাপক আরও বলেন, 'একদিনে ভারী বৃষ্টিপাতের ঘটনা বাড়তে থাকলে সামনে কঠিন দিন আসবে আর এ জন্য এই মুহূর্তেই যথাযথ পরিকল্পনা ও কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন।'
Comments