গানের সঙ্গে গ্ল্যামার একজন শিল্পীর জন্য প্লাস পয়েন্ট, দোষের কিছু না: কোনাল

গানের সঙ্গে গ্ল্যামার একজন শিল্পীর জন্য প্লাস পয়েন্ট, দোষের কিছু না: কোনাল
সোমনূর মনির কোনাল। ছবি: ছবি: শেখ মেহেদি মোর্শেদ/স্টার

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীতশিল্পী সোমনূর মনির কোনাল। সময়ের সবচেয়ে আলোচিত এই শিল্পীর কণ্ঠে ঈদের আলোচিত 'প্রিয়তমা' সিনেমার 'ও প্রিয়তমা' গানটি  শ্রোতাপ্রিয়তায় শীর্ষে ও ট্রেন্ডিংয়ে এক নম্বরে অবস্থান করছে। 

অল্প সময়ের মধ্যে ইউটিউবে ৩৮ মিলিয়ন ভিউ অতিক্রম করেছে গানটি। চলতি বছরে প্লেব্যাকের আলোচিত কণ্ঠশিল্পী 'সুরমা সুরমা', 'মেঘের নৌকা' গানেও নিজের গানের ক্যারিয়ারে অন্যমাত্রা যোগ করেছে। সম্প্রতি এক আলাপচারিতায় সংগীত জীবনের সূচনা থেকে শুরু করে নিজের একান্ত সংগীতভাবনা, গানের জীবন, করোনা মহামারির সময়ে সংগীতের মানুষদের অবস্থা ও চলতি সময়ের নিজের শ্রোতাপ্রিয় গান নিয়ে একান্ত অনেক কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে।

গানের সঙ্গে আপনার সখ্যতার সূচনা হলো ঠিক কবে থেকে? 

কোনাল: একেবারেই ছোটবেলা থেকে গান শেখা শুরু করেছি আমার মায়ের কাছে। তিনি নজরুল সংগীত শিখতেন। আমার মায়ের ১৯৯৪ সালে 'নুরজাহান' নামে গণসংগীতের একটা অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল। বাবার কর্মসূত্রে তারপর আমরা কুয়েত চলে যাই। আমাদের পেছনে সময় দিতে গিয়ে, সংসার সামলাতে সামলাতে গানের সঙ্গে আর থাকা হয়নি মায়ের। এ কারণে মা চাইতেন তার মেয়ে সংগীতশিল্পী হোক। মায়ের স্বপ্ন মেয়ের ভেতর দিয়ে তিনি দেখেছেন হয়তো। 

মেয়ের সেই স্বপ্নের এখনকার অবস্থা কী? 

কোনাল: মনে হয় স্বপ্নটা অনেক বড় দেখে ফেলেছি। একটু একটু করে ছোট ছোট করে সেই স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। এইভাবেই স্বপ্নগুলো পূরণ করতে চাই। কারণ স্বপ্নেরতো শেষ নেই। আমার প্রতিটা অর্জন, শুধু যে অ্যাওয়ার্ড সেটা কিন্তু নয়। আমার পাশের বাসার আন্টি
আমার মাকে যখন বলে আপনি কোনালের মা। কী ভাগ্য আপনার সেই কারণে মাকে তারা ভালোবাসে শ্রদ্ধা করে এটাও একটা স্বপ্নপূরণ। অনেক বড় পাওয়া আমার জন্য।

আমাদের বর্ষীয়ান শিল্পীদের অনেকেই বলেন, নতুন কণ্ঠশিল্পীরা ঠিকমতো গান শিখছে না, চর্চা করছে না। আমাদের সময়টায় ভালো ছিল। একটা তুলনা যুগে যুগে শুনে আসছি। নিজের আয়নায় দাঁড়িয়ে কী মনে হয় নিজের প্রতি সুবিচার করছেন? আগের শিল্পীদের তুলনা করার বিষয়টা কী মনে হয়? 

কোনাল: আমার যেটা মনে হয় সেই সব  শ্রদ্ধাভাজন শিল্পীদের প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাই, তাদের স্ট্রাগলটা ছিল তাদের মতো। এখন আমাদের স্ট্রাগলটা একেবারেই আমাদের মতো। আমাদের সেইসব শ্রদ্ধেয় শিল্পীদের এখনকার মতো গ্লোবালাইজেশনের সঙ্গে  প্রতিযোগিতা কর‍তে হয়নি। সারা দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয়। কোথায় কী গান হচ্ছে, তারা কী পোশাক পরছে মুহূর্তেই সবাই শুনছে, দেখছে। কোথাও কোনো স্কুলে গান করতে গেলে সেখানকার শ্রোতারা বিটিএস সম্পর্কে জানে তাদের সমর্থক তারা। এইসব শ্রোতাদের কোনোকিছুতে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সারা দুনিয়ার সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। আমাদের লিজেন্ডের হয়তো শুধু  ভারতীয় শিল্পীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হতো। কিন্তু আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও সারা দুনিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে গান করে যেতে হচ্ছে। 

বলা হয়, এই সময়ের গান কালজয়ী হবে না, এখনকার কণ্ঠশিল্পীরা ভালো গাইছে না। তাদের গান বেশিদিন টিকবে না। এই বিষয়গুলো কী কারণে বলা হয়? এই কথাগুলোর কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে হয়। এই সব নিয়ে আপনার অভিমত কী? 

কোনাল: তার জন্য আসলে কালটা যেতে দিতে হবে। না হলে কীভাবে বোঝা যাবে এই গানটা  কালজয়ী হচ্ছে কি না। একটা সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, শ্রদ্ধেয় আইয়ূব বাচ্চু, আজম খানরা যখন প্রথম গান শুরু করেন তাদের গান নিয়ে অনেক আজে বাজে কথা শুনতে হয়েছিল। অথচ তাদের গানের মাধ্যমেই একটা বিপ্লব, রেঁনেসা নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের এখনকার গান নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেন। এসব কিছুর জন্য সময়কে যেতে দিতে হবে, কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তারপরেই হয়তো কালজয়ী গান পাওয়া যাবে।

একটা কথা খুব শোনা যায় এখনকার গান কী শোনার নাকি দেখার? আপনার গান মানুষ শুনবে নাকি দেখবে। এটা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা কী? 

কোনাল: আমার কাছে গানটা প্রথমত অবশ্যই শোনার। কিন্তু এই অডিওটাকে প্রচারের জন্য বেশি মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভিডিও করা আমি দোষের কিছু দেখি না। তবে আমার কাছে গানটা প্রথমে অবশ্যই শোনার। শ্রদ্ধেয় রুনা লায়লা ম্যাম যেমন প্রতিটা গানের সঙ্গে কেমন পোষাক পরতে হবে, কেমন  এক্সপ্রেশন, কোন ধরনের অলঙ্কার লাগবে, কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে, হাতটা কতটা নাড়াতে হবে সবকিছু ঠিকঠাক মতো জানতেন। এর পাশাপাশি লতাজি (লতা মুঙ্গেশকর) তার নিজের মতো করেই গান করতেন। প্রতিমা বন্দোপাধ্যায় তার গানে উঁচুতে কিংবা নিচুতে একেবারে নির্বিকারভাবে গান করতেন। এগুলো ছিল তাদের নিজস্বতা। গানটাই তাদের কাছে মুখ্য ছিল। সেই কারণে আমি মনে করি প্রথমে গানটা শোনার। 

আমার সমসাময়িক কণ্ঠশিল্পীদের তুলনায় আমার গানের মিউজিক ভিডিওর সংখ্যা খুব কম। অডিও কোম্পানিগুলোর কাছে মিউজিক ভিডিওর স্বত্ব ৬০ বছরের জন্যে লিখে দিতে হয়। গানগুলো ১০০টার বেশি মাধ্যমে ব্যবহার করছে। এখানে নিয়মনীতি শিল্পীর অনুকূলে নয়। আমাদের সংগীতের সংগঠনগুলো সেইভাবে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে চায় না। আমরাও কথা বলছি না। সে কারণে আমি মিউজিক ভিডিও করার বিষয়ে কম আগ্রহী। 

গানের সঙ্গে গ্ল্যামারের সম্পর্ক কী?

কোনাল: গানের সঙ্গে কারও গ্ল্যামার থাকলে অবশ্যই সেটা তার জন্য প্লাস পয়েন্ট, দোষের কিছু না। আমাদের পাশের দেশের শিল্পী শ্রেয়া ঘোষাল, সুনিধী চৌহান, নিতী মোহান, সুরকার সেলিম সুলেমান গানের পাশাপাশি নিজেদের জিম করার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করছেন। গান করতে হলে শরীরকে অবশ্যই ফিট রাখতে হবে। কারণ একজন শিল্পীকে স্টেজে পারর্মম করতে হলে অনেক ফিট থাকতে হয়। টানা ১ ঘণ্টা গান করতে হলে অনেক এনার্জী লাগে। ধরুন একজন গ্ল্যামারাস শিল্পী, তিনি হয়তো অনেক দেশে গিয়ে শুটিং করে গানের মিউজিক ভিডিও নির্মাণ করলেন। গান যদি তিনি ভালো গাইতে না পারেন, সেই মিউজিক ভিডিও দর্শক দেখবে? দেখবে না। নজীর আছে, দেখেনি। তাই শুধু গ্ল্যামারাস হলে হবে না গানটাও ভালো জানতে হবে। আশাকরি বোঝাতে পেরেছি। 

গান যেহেতু আপনার পেশা, গান কী স্বচ্ছল জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পারে?  

কোনাল: একদম দিতে পারে না। ভারতের কিশোর কুমারের ছেলে অমিত কুমার যে রয়্যালিটি পান সেটা দিয়ে তারা স্বচ্ছল জীবন যাপন করতে পারেন। আমরা সেটা পারি না।

আমি যেহেতু সিনেমার গান বেশি করি। সিনেমার গানে শিল্পী, গীতিকার, সুরকার এককালীন একটা টাকা পান। সিনেমার গানের সব স্বত্ব প্রযোজকের। 

টেলিভিশন লাইভে গান করলে সামান্য কিছু পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। অনেকে টেলিভিশন সম্মানিও দিতে চান না। টেলিভিশন লাইভে গাওয়া গানগুলো তারা সারা বছর প্রচার করে। ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে সেই গানগুলো চালান। কিন্তু শিল্পীরা নতুন করে কোনো অর্থ পাচ্ছেন না এইসব মাধ্যম থেকে। 

তাহলে শিল্পীদের আয়ের উৎস কী? 

কোনাল: আমাদের শিল্পীদের কনসার্ট করে অর্থ আয় করতে হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কনসার্ট, করপোরেট শো করে এই অর্থ আয় করতে হয়। এখানে যারা পরিচিত শিল্পী তাদের মূলত ডাকা হয়। শিল্পীদের চেয়ে যন্ত্রশিল্পী, যারা বাজান তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। সবাইতো আর নিয়মিত শো করতে পারেন না। কেউ কেউ নিয়মিত আমাদের সঙ্গে বাজাচ্ছেন।

অনেকেই স্টুডিওতে গিয়ে বাজান। তারা খুব বেশি আয় করেন এমন বলা যায় না। একটা হতাশার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হচ্ছে। এটা কোভিডের সময় দেখা গিয়েছিল কী খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে।

সব শিল্পীরা তো এইসব কনসার্টের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডাক পাচ্ছেন না। যারা পরিচিত তারা শুধু ডাক পাচ্ছে। বিদেশের কনসার্টেও এমন অবস্থা হয়। আয়োজকরা পরিচিতদের নিয়ে যেতে চান?  

কোনাল: একদম ঠিক, সবাইকে তো আর কনসার্ট করতে ডাকা হয় না। পরিচিত শিল্পীরাই গান করেন। বিদেশে অনুষ্ঠানের বিষয়ে আয়োজকদের বিষয়ে বলি, আমাদের জন্য শুধু শিল্পীদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়, যারা আমাদের সঙ্গে বাজাবেন তাদের বিষয়ে আয়োজকদের চরম অনীহা দেখা যায়। কিন্তু ভারতের শিল্পীদের মাঝারি মানের কোনো অনুষ্ঠানের জন্য তাদের যথাযথভাবে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মিউজিশিয়ান, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে তাদের সহকারীদের নিয়ে যাওয়া হয়। ভারতের সংগঠনগুলো এই বিষয়ে খুব সচেতন। তাদের কেউ অপমান করলে তারা সেটার সুষ্ঠু বিচার করে। আমাদের সিনিয়ার শিল্পীদের অনেকেই নিজেরা একা একা মিউজিশিয়ান ছাড়া বিদেশে কনসার্ট করতে চলে যান। তার ফল এখন আমরা নতুনরা ভোগ করছি। আয়োজকরা আমাদের বিষয়ে বলেন, স্পন্সর নেই। আমাদের সংগঠনগুলো শক্তিশালী হলে এমন হতো না। আমরা নিজেরাই সম্মান চাই না মনে হয়। বিদেশে গিয়ে অন্য যন্ত্র যন্ত্রশিল্পীদের সঙ্গে গান করে আমাদের গান খারাপ হলে সব দোষ আমাদের ওপর চাপানো হয়। যা খুবই দুঃখজনক। 

করোনা মহামারির সময়ে উপমহাদেশের শিল্পীদের মতোই আমাদের শিল্পীদের সব কনসার্ট, গানের অনুষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। খারাপ একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আপনারা তখন কেমন অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছেন? 

কোনাল: আমরা খুব বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছি সেই সময়। সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে আমার যন্ত্রশিল্পীরা। আমরা শিল্পীরা একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে এই অবস্থা থেকে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল শিল্পীদের মধ্যে। 

ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত আলোচিত 'প্রিয়তমা' সিনেমার 'ও প্রিয়তমা' গানটি বর্তমানে শীর্ষে অবস্থান করছে, ট্রেন্ডিংয়ে ১ নম্বরে রয়েছে অনেকদিন। সবচেয়ে কম সময়ে কোটি ভিউ পার করেছে গানটি। 

কোনাল: 'ও প্রিয়তমা' গানটি শ্রোতারা এত পছন্দ করছেন তাদের কাছে আমার অনেক কতজ্ঞতা। গানটি মাঠঘাট, পাড়া-মহল্লা সবখানে গানটা বাজতে শোনা যাচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমার প্রিয় অনেক মানুষই গানটা গেয়ে পোস্ট করছেন
লাখ লাখ টিকটক তৈরি হচ্ছে গানটি নিয়ে। হাজার হাজার শ্রোতা গানটি কভার করেছেন। এই গানটির জন্য মেগাস্টার শাকিব খান, নির্মাতা হিমেল আশরাফসহ গানের সহশিল্পী বালাম ভাইসহ পুরো টিমের কাছে কৃতজ্ঞতা।  

 

Comments

The Daily Star  | English

4 years could be maximum one can go before election: Yunus tells Al Jazeera

Says govt's intention is to hold election as early as possible

30m ago