উচ্চ মূল্যস্ফীতির বাজারে মিনি-প্যাকেই ভরসা
কয়েক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়ছে দেশের মানুষ। পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে অনেকে নানাভাবে খরচ কমানোর চেষ্টা করছেন। যেমন—অনেকে শ্যাম্পুর বোতল ছেড়ে মিনি-প্যাক ব্যবহার করছেন। অনেকে আবার পরিবারের সদস্যদের কাপড় পরিষ্কার করতে সস্তা ডিটারজেন্ট বেছে নিচ্ছেন।
এই খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০২২ সাল থেকে ভোক্তারা এসব পণ্যের ব্যবহার কমাতে শুরু করে। এরপর ২০২৩ সাল জুড়ে তা অব্যাহত ছিল। আর সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালের শেষের দিকে এসে তীব্র আকার ধারণ করে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে ও সংসারের খরচ কমাতে ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পু থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রসাধনী পণ্যের ছোট বোতল, মিনি-প্যাক কিংবা সস্তা কোনো পণ্য বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন ভোক্তারা। যদিও এই বিকল্প উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়।
তবে মানুষ যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির যাঁতাকল থেকে মুক্তি পেতে চাচ্ছেন, তখন সরকার কিছু ব্র্যান্ডের পণ্যসহ ৪৩টি পণ্য ও পরিষেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়াতে তাড়াহুড়ো করছে। এতে মধ্য ও নিম্নমানের পণ্যের ব্যবহার আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এখানে উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে দেশের মানুষের লড়াই শুরু হয় এবং তখন থেকে মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের ওপর ঘোরাফেরা করছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে।
ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের সাম্প্রতিক এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভোক্তাদের ব্যয়ের অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে প্ররোচিত করছে। বিশেষ করে কন্ডিশনার, ডিটারজেন্ট, শ্যাম্পু, বাইরের খাবারসহ বিভিন্ন প্রসাধনীর মতো অপ্রয়োজনীয় পণ্য ব্যবহারে।
দেশের ফাস্ট মুভিং কনজ্যুমার গুডস (এফএমসিজি) কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২০২৪ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে তাদের বিক্রি প্রায় পাঁচ শতাংশ কমেছে।
জানতে চাইলে ইউনিলিভার বাংলাদেশের ফ্যাব্রিক ক্লিনিং বিভাগের প্রধান হোসেন মোহাম্মদ সাররাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধি ভোক্তাদের জীবনযাত্রায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এতে এফএমসিজি বাজারে প্রভাব পড়েছে।
'এই পরিস্থিতিতে গ্রাহকরা প্রথমে প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করছেন, তারপর এফএমসিজি নিয়ে ভাবছেন,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'যেসব ক্রেতা ভালো ব্র্যান্ডের পণ্য ব্যবহার অব্যাহত রাখতে চাচ্ছেন, তারা মিনি-প্যাক কিনছেন। আবার অনেকে ভালো মানের ডিটারজেন্ট বাদ দিয়ে সস্তা ডিটারজেন্ট কিনছেন। যার প্রভাব পড়েছে পুরো এফএমসিজি খাতে।'
'২০২২ সাল থেকে এই প্রবণতা শুরু হয়। ২০২৩ সালেও অব্যাহত ছিল এবং ২০২৪ সালে আরও তীব্র হয়,' বলেন তিনি।
তার ভাষ্য, 'যাদের মিনি-প্যাক কেনারও সামর্থ্য নেই, তারা আবার তুলনামূলক সস্তা ব্রান্ড বেছে নিচ্ছেন। আমরা আশা করেছিলাম, মানুষ ৫০০ গ্রাম প্যাক থেকে এক কেজি বা দুই কেজি ওয়াশিং পাউডার প্যাক বেছে নেবেন, কারণ এতে ব্যয় সাশ্রয় হয়। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা।'
হোসেন মোহাম্মদ সাররাম জানান, আমরা ব্যাচেলর ও ট্রাভেল প্যাক হিসেবে ১৫০ গ্রামের টুথপেস্ট টিউব চালু করেছি। এখন অনেক পরিবার এই প্যাক ব্যবহার করছে।
মিনি-প্যাক আরও জনপ্রিয় হয়েছে
হোসেন মোহাম্মদ সাররামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ সালে প্রতিদিন শ্যাম্পু বিক্রির ৬০ শতাংশ ছিল মিনি-প্যাক। কিন্তু বর্তমানে প্রতিদিনের শ্যাম্পু বিক্রির ৭৫ শতাংশই মিনি-প্যাকে হয়।
তিনি বলেন, ২০২৩ সালের মুনাফার পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ কমেছে।
২০২৪ সালেও কিছুটা কমেছে বলে জানান তিনি।
তার তথ্য অনুযায়ী, দাম বাড়ার কারণে তাদের ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ গ্রাহক অন্য ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকছেন।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের হেড অব মার্কেটিং জেসমিন জামানও একই ধরনের কথা জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক ক্রেতা মিনি-প্যাকের দিকে ঝুঁকছেন, আবার অনেকে ব্র্যান্ড পরিবর্তন করে নিম্নমানের পণ্য বেছে নিচ্ছেন।
প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াছ মৃধা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষ এখন বড় প্যাক বাদ দিয়ে ছোট প্যাকের দিকে ঝুঁকছেন।
'তারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে।'
তিনি বলেন, 'সংসারের খরচ মেটাতে অপ্রয়োজনীয় পণ্য ব্যবহারে তাদের এখন ভারসাম্য বজায় রাখতে হচ্ছে, তাই তারা ছোট প্যাকের দিকে ঝুঁকছেন।'
তার ভাষ্য, 'ভোক্তাদের বাজেট এখন সীমিত। কারণ সাম্প্রতিক সময়ে তাদের প্রকৃত আয় বাড়েনি। এজন্য তারা ব্যয় ও বাজেটের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছেন।'
'বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা এফএমসিজি পণ্যের দাম বাড়ায়নি। তবুও এসব পণ্যের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য কমেছে,' বলেন তিনি।
খুচরা বিক্রিতে ধাক্কা
ঢাকার মিরপুরের খুচরা বিক্রেতা জাকির হোসেন আরিফ বলেন, দাম বাড়ার কারণে আগে যেসব ক্রেতারা ৪০০ গ্রাম ওজনের সানসিল্ক শ্যাম্পুর বোতল কিনতেন, তারা এখন ২০০ গ্রাম ওজনের বোতল বেছে নিচ্ছেন।
একইভাবে আগে যারা নিভিয়া ক্রিমের ৪০০ গ্রামের কনটেইনার কিনতেন, তারা এখন ২০০ গ্রাম ক্রিম কিনছেন।
'গত বছরও একই প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, তবে এবার প্রতিদিনই সেই সংখ্যা বাড়ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবারের শীত মৌসুমের শুরুতে বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ কমে গেছে। গত বছর আমরা গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেয়েছি, তবে এবার পর্যাপ্ত পণ্য থাকা সত্ত্বেও, ক্রেতা অনেক কম। আমদানি করা কন্ডিশনার, ময়েশ্চারাইজার, ক্রিম ও এ ধরনের পণ্যের বিক্রিও কমে গেছে।'
ছোট ছোট বিলাসিতাকে বিদায়
ঢাকার ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা সাহানা পারভীন বলেন, ব্র্যান্ডেড কসমেটিকসের দাম বৃদ্ধির কারণ আজকাল সাশ্রয়ী বিকল্প বেছে নিতে হচ্ছে।
তার ভাষ্য, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সংসারের ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই কম দামি পণ্য বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছি। তবে আমাদের হাতে বিকল্প পণ্যের সংখ্যাও সীমিত।'
রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার মমতাজ বেগম বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ব্যয় বাড়ায় প্রসাধনী পণ্যের বাজেট কমাতে হয়েছে।
'এখন আর দামি প্রসাধনী কিনে অতিরিক্ত খরচ করার সামর্থ্য নেই। বাজেটের কথা মাথায় রেখে ছোট ছোট শখকে বিদায় বলতে হচ্ছে। তাই ব্যয় সাশ্রয়ে মিনি-প্যাক বেছে নিচ্ছি।'
সস্তা বিকল্প নিয়েও শঙ্কা
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে।
তিনি মন্তব্য করেন, '৪৩টি পণ্য ও সেবার ওপর সরকার সম্প্রতি ভ্যাট বাড়ানোর যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা ভোক্তাদের বর্তমান পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তুলবে। এতে তারা আরও সস্তা ও নিম্নমানের বিকল্পের দিকে ঝুঁকবে।'
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতি চলমান থাকলে মানুষ বিকল্প হিসেবে সস্তা পণ্যের খোঁজ করেন।
তিনি আরও বলেন, 'এ সময় তারা মূলত মৌলিক চাহিদাগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।'
এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ভোক্তারা খরচ কমাতে প্রথমে এফএমসিজি, জামাকাপড় ও জুতোর পেছনে খরচ কমাতে শুরু করে। কারণ তারা খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখে পড়তে চান না। কারণ তারা জানে, খাদ্য সংকটের মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তাদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হবে। এজন্য তারা প্রথমেই এফএমসিজির খরচ কমিয়েছেন।
(এই প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে ভাষান্তর করেছেন রবিউল কমল)
Comments