টানা ৩০ মাস বেড়ে জুলাইয়ে কমল মজুরি প্রবৃদ্ধি

মূল্যস্ফীতি
কম আয় ও অদক্ষ শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় তারা খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার ফাইল ফটো

গত ২০২২ সালের জানুয়ারির পর থেকে টানা ৩০ মাস দেশে মজুরি প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী থাকার পর জুলাইয়ে তা কিছুটা কমেছে। সরকারি তথ্যে এমনটি জানা গেছে।

মূল্যস্ফীতির হার ও মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে ব্যবধান তিন দশমিক ৭৩ শতাংশ পয়েন্টে পৌঁছেছে। এটি অন্তত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মজুরি হার সূচকে দেখা গেছে, গত জুলাইয়ে স্বল্প মজুরি ও অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে সাত দশমিক ৯৩ শতাংশে। অন্যদিকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরে বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ১২ বছরে সর্বোচ্চ নয় দশমিক ৭৩ শতাংশে পৌঁছেছে। যদিও ২০২১ সালের জুলাই থেকে মজুরি ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়েছে। তবে গত ৩০ মাস ধরে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে তা ছাড়িয়ে গেছে।

কম আয় ও অদক্ষ শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় তারা খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন।

ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কামাল মুজেরি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও মজুরি প্রবৃদ্ধি কমার প্রবণতা কম ও সীমিত আয়ের মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গিয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'যখন উচ্চ মূল্যস্ফীতি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে তখন তা দারিদ্র্যের হার ও খাদ্য অভ্যাসের ওপর প্রভাব ফেলে।'

উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের পুষ্টিকর খাবার কমাতে বাধ্য করেছে।

তার মতে, এটি মোকাবিলার কৌশলগুলোর ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। ধীরে ধীরে কম আয়ের এবং স্বল্প দক্ষ মানুষদের সুযোগ কমিয়ে দেয়।

গত জুলাইয়ে দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সঙ্কট মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দেয়। গত ১৩ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

২০২৩ সালের মে থেকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের ওপরে। গত ফেব্রুয়ারি ছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রতি মাসে তা সাড়ে নয় শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

কৃষি খাতের শ্রমিকদের সামগ্রিক মজুরি প্রবৃদ্ধি জুলাইয়ে আট দশমিক ২১ শতাংশে নেমে আসে। এটি এর আগের মাসে ছিল আট দশমিক ৩৩ শতাংশ।

শিল্প খাতে মজুরি প্রবৃদ্ধি সাত দশমিক ৪২ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে সাত দশমিক ৫২ শতাংশ। সেবা খাতে জুনে মজুরি প্রবৃদ্ধি সাড়ে আট শতাংশ থেকে কমে আট দশমিক ২৭ শতাংশে নেমে এসেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার মান কমে গেছে। অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা বিশেষ করে শহরাঞ্চলের কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী।'

বিবিএস কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের ৬৩টি পেশায় দৈনিক ভিত্তিতে বেতন পাওয়া অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে কাজ করে।

বিভাগ হিসেবে মজুরি বেড়েছে রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ ও খুলনায়। কমেছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে।

মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকার বিষয়ে মুস্তাফা কামাল মুজেরি বলেন, 'সঠিক সময়ে সঠিক উদ্যোগ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় সাবেক সরকার মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারেনি।'

তার ভাষ্য, 'মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন যথেষ্ট নয়। এখানে একাধিক নীতিমালা সংহত করা প্রয়োজন।'

'বাজার স্থিতিশীল করতে হলে পর্যাপ্ত উৎপাদন নিশ্চিত করার বিকল্প নেই' বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ব্যবসায়ীদের বিশেষ করে আগের সরকারের সঙ্গে জড়িতদের আস্থা ফিরিয়ে আনা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য জরুরি। কারণ স্বাভাবিক কার্যক্রমে দ্রুত ফিরে আসা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি।'

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা করছেন অনেক সরকারপন্থি ব্যবসায়ী।

'এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে আস্থা বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি' উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, 'বাজারে সিন্ডিকেট কমিয়ে প্রতিযোগিতা বাড়াতে সহায়তা করাও সরকারের জন্য জরুরি।'

তিনি আরও বলেন, 'এ ছাড়া মুদ্রানীতির উদ্যোগগুলো পুনর্বিবেচনা করতে হবে। ক্রমবর্ধমান নীতি হার ও বাজারে এর প্রভাব সম্পর্কে আমাদের তাত্ক্ষণিক মূল্যায়ন প্রয়োজন।'

গত জুলাই থেকে ডিসেম্বরে মুদ্রানীতি নীতিতে রেখে সুদের হার সাড়ে আট শতাংশ অপরিবর্তিত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

তার মতে, 'এটি আর বাড়ানো উচিত নয়। কারণ তা ব্যবসায় প্রভাব ফেলবে।'

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের পরামর্শ—অন্তর্বর্তী সরকারকে সুশাসনের মাধ্যমে বাজার স্থিতিশীল করার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এ লক্ষ্যে শিগগিরই স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

নীতিনির্ধারকরা যাতে সঠিক উদ্যোগ নিতে পারেন তাই বিবিএসের তথ্যের যথার্থতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

What's causing the unrest among factory workers?

Kalpona Akter, labour rights activist and president of Bangladesh Garment and Industrial Workers Federation, talks to Monorom Polok of The Daily Star about the recent ready-made garments (RMG) workers’ unrest.

8h ago