সরকারের নানা উদ্যোগের পরও কেন নিত্যপণ্যের দাম কমছে না

দেশের বাজারে আলু, ভোজ্যতেল, চিনি ও পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যের দাম দীর্ঘদিন ধরে উচ্চপর্যায়ে রয়েছে এবং ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। এতে মানুষের কষ্ট বাড়ছে। কারণ নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে তাদের লড়াই করতে হচ্ছে। বিশেষ করে দরিদ্র ও নিম্নআয়ের মানুষকে জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহে তীব্র লড়াই করতে হচ্ছে।

তবে মুদ্রানীতি কড়াকড়ি ও আমদানি কমিয়েও যখন মূল্যস্ফীতি রোধ করা সম্ভব হয় না, তখন সাধারণ মানুষের জন্য এই লড়াই আরও কঠিন হয়ে ওঠে।

সরকারি তথ্যে দেখা গেছে, সম্প্রতি নিত্যপণ্যের দাম আগের চেয়ে বেড়েছে।

ফলে নির্দিষ্ট ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য জীবনযাপনের লড়াইটা আরও তীব্র হয়েছে। এর পরিণতি উদ্বেগজনক হতে পারে।

এ বছরের নভেম্বরের শুরুতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রকাশিত ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন বা ২৬ শতাংশ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।

ওই প্রতিবেদনে ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এজন্য অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণগুলোকে দায়ী করেছে। এর মধ্যে একটি কারণ হলো আমদানি কমে যাওয়া।

এছাড়া অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর মধ্যে আছে বন্যার কারণে ফসলের ক্ষতি, এ সময়ে সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া বাজার সিন্ডিকেট আরেকটি কারণ। বাজার সিন্ডিকেটের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে।

রাজধানীর মিরপুর-১-এর কাঁচাবাজারের মুদি দোকানি কাউসার হোসেন বলেন, গত দুই-তিন মাস ধরে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। ফলে, মানুষ খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে লড়াই করছেন।

তিনি বলেন, 'আগে যারা তিন ডজন ডিম কিনতেন তারা এখন এক থেকে দেড় ডজন ডিম কিনছেন। আগে যারা পাঁচ কেজি আটা কিনতেন, তারা এখন দুই থেকে তিনি কেজি আটা কিনছেন।'

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে মাঝারি চাল, নন-ব্র্যান্ড খোলা সয়াবিন তেল, পাম তেল, আলু, পেঁয়াজ, রসুন ও এলাচের দাম বেড়েছে।

কৃষি বিপণন বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রতিদিন ৫৪টি পণ্যের খুচরা মূল্য প্রকাশ করা হয়। গতকাল তাদের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, গত বছরের চেয়ে ২৮টি পণ্যের দাম বেড়েছে এবং ১৩টির কমেছে।

মিরপুর কাঁচাবাজারে কেনাকাটা করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী তানিন হোসেন বলেন, 'অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম এখনো অনেক বেশি। আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে সরকারের আরও কিছু করা দরকার।'

তিনি মন্তব্য করেন, 'মানুষ যদি স্বস্তিবোধ না করেন, তাহলে দাম কমাতে যত ব্যবস্থা নেন কেন তা বিবেচ্য হবে না।'

মুদ্রানীতিতে কড়াকড়ি, শুল্ক কমানোর পথে সরকার

মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে গত ২২ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বা রেপো রেট আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করেছে।

এ নিয়ে ২০২২ সালের মে মাসের পর থেকে ১১ বার রেপো রেট বাড়ালো কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলত চাহিদা নিয়ন্ত্রণে ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রেপো রেট বাড়িয়েছে বাংলাদেশে ব্যাংক।

এদিকে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় গত তিন মাসে বেশ কয়েকটি পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে। শুল্ক কমানোর তালিকায় রয়েছে আলু, চিনি, ভোজ্যতেল, চাল ও পেঁয়াজ।

তবে মুদ্রানীতিতে কড়াকড়ি ও শুল্ক কমানো হলেও অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশে পৌঁছেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ১৬ পার্সেন্টেজ পয়েন্ট কমে নয় দশমিক ৩৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাজার পর্যবেক্ষণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা পর্যালোচনার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জেলা পর্যায়ে ১০ সদস্যের একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে।

এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামে খোলাবাজারে বিক্রয় কর্মসূচির মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রি করছে কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববাজারও ঊর্ধ্বমুখী

সম্প্রতি বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেল, পাম তেল, চিনি ও গমসহ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়েছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে পাম অয়েলের দাম টনপ্রতি ৯৪ ডলার বেড়েছে। একই সময়ে সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি ৫১ ডলার, গমের দাম ১৩ ডলার এবং চিনির দাম টনপ্রতি চার ডলার বেড়েছে।

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, শুল্ক কমার কারণে স্থানীয় বাজারে চিনির দাম কিছুটা কমেছে এবং আরও কমবে।

তিনি আরও বলেন, 'গত দেড় মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। তাই সরকার আমদানি শুল্ক কমালেও দেশের বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বেশি থাকতে পারে।'

তসলিম শাহরিয়ার বলেন, বিশ্ববাজারে গমের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও সম্প্রতি কিছুটা কমেছে। গমের আমদানি বেড়েছে।

বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা

ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস ও মরিচের বাজার বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য অদক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করেছে একটি বাণিজ্য সংগঠন।

এছাড়া অক্টোবরে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) জানিয়েছে, পণ্য উৎপাদন খরচের ক্রমাগত উচ্চ মূল্য, অদক্ষ বাজার ব্যবস্থা, পণ্য পরিবহনের উচ্চ হার, বাজার আধিপত্য ও উৎপাদনকারীদের খুচরা বাজারে প্রবেশাধিকার স্বল্প সুযোগ ইত্যাদি কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।

ডিসিসিআই সুপারিশ করে, মধ্যস্থতাকারীদের তৎপরতা কমিয়ে ও অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যপণ্য আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। বিশেষ করে যেসব পণ্যের উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য নেই।

ছাড়া স্থানীয় ও আমদানি করা খাদ্যপণ্যের নগদ মেমোর জন্য ট্র্যাকিং সিস্টেম বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি উৎপাদন খরচ কমাতে সার, তেল ও বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, যেকোনো উদ্যোগের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার ফলাফলের ওপর। অন্তর্বর্তী সরকার মূল্য নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও ফলাফলের নিরিখে এখনো বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়েনি।

তার ভাষ্য 'আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির চাপ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বাজার শান্ত করতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।'

পণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও সরবরাহে তথ্যগত ঘাটতি রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তিনি বলেন, 'সুদের হার বাড়ানোর একটা সীমা আছে, কারণ এটি এমনিতেই অর্থনীতিকে অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারকে সেদিকেও নজর রাখতে হবে।'

Comments

The Daily Star  | English

July proclamation after intensive discussions: Asif Nazrul

He said all the leaders who joined today's meeting had told them to take time to prepare the documentation

3h ago