রিজার্ভ কমছেই
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার প্রবণতা রোধে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমছে।
বুধবার পর্যন্ত মোট আন্তর্জাতিক রিজার্ভ (জিআইআর) ছিল ১৮ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার, যা সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট।
সাধারণত একটি দেশের তিন মাসের আমদানির অর্থ পরিশোধের মতো রিজার্ভ ধরে রাখা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একটি ন্যূনতম মানদণ্ড।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মাসিক আমদানি ব্যয় প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার।
তবে, বাংলাদেশের মোট রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার দায় কেটে নেওয়ার পর নিট আন্তর্জাতিক রিজার্ভের (এনআইআর) পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে আড়াই মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা যাবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার তাৎক্ষণিকভাবে এনআইআর ব্যবহার করতে পারে।
গত সপ্তাহে আমদানি বাবদ এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মাধ্যমে ১৬৩ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফলে রিজার্ভ আরও কিছুটা কমে গেছে। আকু হলো বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার ভারতসহ ১০টি দেশের জোট।
এই প্রেক্ষাপটে আইএমএফ ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ কর্মসূচির শর্তে জুনের জন্য এনআইআর লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ১৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে এনেছে।
রিজার্ভ কমছে কেন?
করোনা বিধিনিষেধের মধ্যে আমদানি ব্যয়, আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও বিদেশি মুদ্রার আয় মারাত্মকভাবে কমে যায়। কিন্তু প্রবাসী আয় বৃদ্ধির কারণে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে।
এরপর আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করলে এবং দেশের অর্থনীতি পুনরায় চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিজার্ভ কমতে শুরু করে।
এরপর ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে বিশ্বব্যাপী সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। যার প্রভাব পড়ে আমদানিনির্ভর দেশগুলোর ওপর, এতে বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে।
ব্যাংকাররা বলছেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অব্যবস্থাপনা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঘন ঘন নীতি পরিবর্তন ও অফিসিয়াল বিনিময় হার এবং অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের মধ্যে ব্যবধানও এজন্য দায়ী।
২০২১ সালের আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলার কমেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন প্রধান নির্বাহী বলেন, যখন বাজারে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১২০ টাকা ছিল, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১১০ টাকা নির্ধারণ করেছিল। এতে প্রবাসীরা অবৈধ পথে ডলার পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হন।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন দেশ যখন ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে, তখন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকার মান সমুন্নত রেখেছে। এটি ভালো সিদ্ধান্ত ছিল না।
এছাড়া ২০২২ সালের আগে ডলার ও টাকার বিনিময় হার নির্ধারণ করত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন এ হার নির্ধারণ করেছে।
এসব উদ্যোগ বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ব্যর্থ হলে গত সপ্তাহে ব্যাংকিং নিয়ন্ত্রক ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে। নতুন এই বিনিময় হার পদ্ধতিতে, ডলারের মিড রেট নির্ধারণ করা হয়েছে ১১৭ টাকা।
২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলার বাজারে বিক্রি করেছে। তবে এখন ব্যাংকগুলোকে ডলার দেওয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ সতর্ক।
অর্থনীতিতে প্রভাব
রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতার কারণে ফিচসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি গত বছর বাংলাদেশের রেটিং নেতিবাচক করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি বলেন, 'বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনৈতিক শক্তিমত্তার অন্যতম সূচক।'
তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ব্যাংকগুলো যখন কোনো দেশে বিনিয়োগ বা ঋণ দিতে চায়, তখন তারা প্রথমে সেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যাচাই করে।
প্রতিটি দেশের অন্তত তিন মাসের জন্য আমদানি বিল পরিশোধের মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার নিয়ম আছে। তার মতে, কোনো দেশের এই পরিমাণ রিজার্ভ না থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই রিজার্ভ সম্মানজনক না হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সেই দেশের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রত্যাশা
ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু হলে রিজার্ভ বাড়বে বলে আশা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হাবিবুর রহমান বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান লক্ষ্য ছিল।
নতুন বিনিময় হার আগামীতে রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়াতে সহায়তা করবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এ লক্ষ্যে আমরা নতুন পদ্ধতি চালু করেছি। এতে আর্থিক হিসাবের ঘাটতি কমে আসবে এবং রিজার্ভ বাড়বে।'
Comments