বাজারে সর্বনিম্ন চালের কেজি ৫০ টাকা, নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস

ছবি: সংগৃহীত

দেশে চালের দাম বেড়েছে। প্রায় এক বছর পর মোটা চালের দাম কেজিতে ৫০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় কম আয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা আরও কমেছে। অথচ তাদের চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে জীবিকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে।

চালের দাম বৃদ্ধির জন্য পাইকারি পর্যায়ে দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন খুচরা বিক্রেতারা। অন্যদিকে পাইকারদের দাবি, মিল পর্যায়ে চালের দাম বেড়েছে। আবার মিল মালিকরা বলছেন, আমন রোপণ ও ফসল কাটায় দেরির কারণে ধানের দাম বেড়েছে।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রোববার ঢাকায় খুচরা পর্যায়ে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৫১ টাকা কেজি দরে। গত নভেম্বরে যা ছিল ৫০ টাকা ও অক্টোবরে ৪৯ টাকা।

সরু চাল বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৬৮ টাকা ও মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫৬ টাকায়, বলছে টিসিবির তথ্য।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারের খুচরা বিক্রেতা ধীরেন বাবু দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, জাত ও মানভেদে মোটা চাল ৫১ থেকে ৫২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন তিনি।

কৃষকরা বলছেন, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফসল আমন রোপণ ও ফসল কাটায় কিছুটা দেরি হয়েছে। দেশে মোট ধান উৎপাদনের ৩৮ শতাংশেরও বেশি আসে এই মৌসুমে।

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার কৃষক মোহাম্মদ নাজিম ডেইলি স্টারকে জানান, তারা সাধারণত নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমন কাটা শুরু করেন এবং মাসের মাঝামাঝি তা শেষ হয়।

তিনি বলেন, 'কিন্তু এ বছর ডিসেম্বরের শুরুতে ফসল কাটা শেষ হয়েছে।'

জামালপুরে মোহাম্মদ রুবেল একটি স্কুলে কাজ করেন এবং তিনি তার জমিতে ধান চাষ করেছেন।

মোহাম্মদ রুবেল ডেইলি স্টারকে জানান, শ্রমিকরা গত শুক্রবার তার জমির ধান কাটা শেষ করেছেন।

এ দিকে ধীরেন বাবু বলেন, 'বাজারে নতুন চাল এলে দাম কমে যাবে।'

'নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুর দাম অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে' উল্লেখ করে ঢাকার মিরপুরের ভাসমান চা বিক্রেতা আব্দুর রব ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত শনিবার পাঁচ কেজি চাল কিনতে বাজারে গিয়েছিলাম। কিন্তু দাম বাড়তি দেখে চার কেজি কিনেছি। কারণ, আমাকে আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও আমাদের আয় প্রতি সপ্তাহে বাড়ে না।'

৫৩ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির ভাষ্য, জীবিকা নির্বাহ করা তার জন্য কতটা কঠিন হয়ে পড়েছে তা তিনি বর্ণনা করতে পারবেন না।

জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের কারণে মানুষ আগের মতো চা খান না জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমার কষ্টের কথা কাকে বলব?'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে, যা ছিল গত এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। অবশ্য নভেম্বরে তা কমে হয়েছে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

বগুড়ার শেরপুর উপজেলার মজুমদার অটো রাইস মিলের ব্যবস্থাপক রঞ্জন চক্রবর্তী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ধানের দাম বেশি হওয়ায় চালের দাম বেড়েছে।'

বর্তমানে মিল মালিকরা স্বর্ণা-৫ ধান মণপ্রতি এক হাজার ৯০ টাকায় কিনছেন। পরিবহন ও মিলিং খরচ বিবেচনায় নিলে মোটা চালের উৎপাদন খরচ দাঁড়ায় কেজিতে ৪৮ টাকা।

তিনি বলেন, 'তাই ৫০ টাকা কেজির কমে চাল বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না।'

কিন্তু, দুই সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের উত্তরাঞ্চলের অন্যতম প্রধান চাল উৎপাদনকারী অঞ্চল দিনাজপুরে ৫০ কেজির বস্তায় সব ধরনের চালের দাম কমেছে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা।

জেলা শহরের বাহাদুরবাজার ও রেলবাজার হাটের খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক কেজি গুটি স্বর্ণা (মোটা চাল) বিক্রি হচ্ছে ৪৩ টাকায়। এটি এক সপ্তাহ আগে ছিল ৪৮ টাকা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন মূল্যস্ফীতি বেশি, তখন দাম বৃদ্ধি সবসময় সরবরাহ-চাহিদার ওপর নির্ভর করে না।'

দিনাজপুরের বাহাদুরবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ফিরোজ আহমেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাজারে ধানের সরবরাহ কম থাকায় মিলগেটে কম পরিমাণে চাল পাওয়া যাচ্ছে।'

নওগাঁর চাল ব্যবসায়ী নীরদ বরণ সাহা ডেইলি স্টারকে জানান, সাম্প্রতিক সময়ে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে।

তিনি বলেন, 'সর্বশেষ অবরোধের আগে ট্রাকে আগুন দেওয়ার আশঙ্কায় পণ্য পরিবহনের জন্য যানবাহনের সংখ্যা দ্রুত কমে যায়। এতে মিল মালিকদের চাল-ভর্তি ট্রাক পাঠাতে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।'

তিনি আরও বলেন, 'অবরোধের কারণে ভাড়া বেড়ে ২৩ থেকে ২৪ হাজার টাকা হয়েছে। আমরা আসলে এখন অতিরিক্ত পরিবহন খরচের প্রভাব দেখতে পাচ্ছি।'

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'যখন মূল্যস্ফীতি বেশি, তখন দাম বৃদ্ধি সবসময় সরবরাহ-চাহিদার ওপর নির্ভর করে না।'

তার মতে, 'মূল্যস্ফীতির চাপ থাকলে ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফা করতে চান। এ কারণেই দাম বাড়ছে।'

তিনি মনে করেন, সরকার যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সঠিক ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। এ বিষয়ে সরকারকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

মূল্যস্ফীতির তীব্র চাপের মধ্যে দরিদ্র ও কম আয়ের মানুষের সুবিধায় কয়েকটি প্রকল্পের পরিধি বাড়াচ্ছে সরকার।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে জানা গেছে, গত ১ জুলাই থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সরকার খোলা বাজারে চার লাখ ৭৪ হাজার টন চাল ও আটা বিতরণ করেছে। আগের বছরে এটি ছিল তিন লাখ ২৩ হাজার টন।

একই সময়ে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় বিতরণ করা পণ্য ১৭ শতাংশ বেড়ে চার লাখ ৩৯ হাজার টন হয়েছে।

তারপরও চালের দাম বাড়তে দেখা যাচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ মনে করেন, 'বাজারে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা নেই। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি শুধু চাহিদা ও সরবরাহের মতো বিষয় দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।'

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা আলাদাভাবে সমাধান করা যাবে না। এটা বাজারের ব্যর্থতা। এভাবে চলতে থাকলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।'

এই স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, 'বিচারের আওতায় না আসায় সরকার ঘনিষ্ঠ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।'

পণ্য উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডেইলি স্টারকে বলেছেন, 'জাতীয় নির্বাচনের আগে পণ্যের দাম সাধারণত অস্থিতিশীল থাকে। অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে কেউ এটি ব্যাখ্যা করতে পারেন না।'

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Undergraduate admission tests under the cluster system faces uncertainty for the 2024-25 academic year, as several prominent universities have decided to withdraw and conduct their own admission tests independently. 

9h ago